সংস্কারের পর সুসজ্জিত মাঘেন ডেভিড সিনাগগ। রবিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
হিব্রু ভাষায় ‘শালোম আলাখেম’ বলে শান্তির গান ধরলেন স্কুলপড়ুয়া উজমা, জেবা, মাশফা, ইউসরা, শুভস্মিতারা। পোলক স্ট্রিটের বেথ এল সিনাগগের কাঠের বেঞ্চিতে সেরাহ সাইলাসের গাল বেয়ে তখন অঝোর ধারা।
‘‘হানাহানির দুনিয়ায় এমনও হয়! মুসলিম মেয়েরা হিব্রুতে গাইছে, এ বোধহয় কলকাতাতেই সম্ভব!’’— বার বার বলছিলেন তিনি। ওই মেয়েদের শিক্ষায়তন জিউয়িশ গার্লস স্কুলে সাড়ে চার দশক আগে ‘হেড গার্ল’ ছিলেন অধুনা কানাডাবাসী সেরাহ। আসলে কিছুই হারায়নি অতীতের! কবেকার দেশান্তরী মেয়েকে বলে গেল রবিবার দুপুরের কলকাতা।
দু’বছর বন্ধ থাকার পরে ১৫০ বছরের ঐতিহ্য-স্মারক, বড়বাজারের দু’টি ইহুদি উপাসনালয়— বেথ এল ও মাঘেন ডেভিড সিনাগগের জরাজীর্ণ নোনাধরা শরীরেও লেগেছে নতুন যৌবনের ছোঁয়া। চোখধাঁধানো স্তম্ভ, ঘষা কাচ, দেওয়ালের কারুকাজ, ঝাড়লণ্ঠন— সব আগের মতো। কলকাতার ইহুদি জনসংখ্যা কমতে কমতে জনা কুড়িতে ঠেকেছে। ‘‘কিন্তু মাঘেন ডেভিডের মতো সিনাগগ স্থাপত্য এশিয়ায় আর নেই’’— বললেন শহরে আগত ইজরায়েলি র্যাবাই বা পুরোহিত ডেভিড রিভকিন।
শহরের ক্ষীয়মান ইহুদিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের তদারকিতে কয়েক শো বছরের আয়ু ফিরে পেয়েছে সিনাগগ দু’টি। ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল কারমনকে পাশে নিয়ে ইহুদিদের ধ্রুপদী শিঙা র্যামস হর্নে ফুঁ দিলেন র্যাবাই রিভকিন। দ্বার খুলল সিনাগগের। কলকাতার ইহুদিদের তরফে জো কোহেন বলছিলেন, ‘‘জানি না, আমরা কত দিন টিকব এখানে। তবে কলকাতার ইহুদিদের ইতিহাস বাঁচাতে বেথ এল-এ একটা সংগ্রহশালা হবে।’’
সেই ইতিহাসই কয়েক ঘণ্টার জন্য যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। সেরাহর হাতে সিপিয়া-রঙা ছবি! ‘‘এই দেখ, বেথ এল-এই আমার মা-বাবার বিয়ে হয়েছিল।’’ মা ইজরায়েলে, সেরাহ কানাডায়, তাঁর ভাই বেঙ্গালুরুতে— ছিটকে যাওয়া পরিবারটিকে কলকাতার শিকড়ই যেন বেঁধে রেখেছে।
ইজরায়েলবাসী সত্তরোর্ধ্ব দন্ত-চিকিৎসক ড্যানি ডয়েশেরও এই প্রথম কলকাতা আসা! নাহুমের কেক, ছাতাওয়ালা গলি, লালবাজার, বৌবাজারের সব গল্প তাঁর মুখস্থ। বৃদ্ধ থেমে থেমে বললেন, ‘‘মায়ের কাছে কত বার শুনেছি! মা হানাহ জোশুয়া দারুণ বাহাদুর ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ২২ বছর বয়সে একা কলকাতা ছেড়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন।’’ ক্যারল এজরা, মোজেল ফ্রিডম্যানদেরও দাদু-দিদিমা-মাসি-কাকা এ শহরের মাটির নীচে শুয়ে আছেন। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ থেকে কলকাতায় এসে নারকেলডাঙার ইহুদি সমাধিক্ষেত্রেও যাবেন তাঁরা। চৌরঙ্গি লেনের হুইলচেয়ার বন্দি ৮৬ বছরের হিল্ডা অকল্যান্ড বা জোকার বাসিন্দা, ষাটোর্ধ্ব ক্যাথলিন উইনিপেটার্সদের সঙ্গে ওঁদের দিব্যি জমে গেল।
তা এত কলকাতা-কলকাতা করার আছেটা কী? একটু উসকে দিতেই রে-রে করে ওঠে বিদেশ থেকে আসা এ শহরের গত জন্মের মুখগুলি। বউবাজারের বো স্ট্রিটের সে-কালের বাসিন্দা সেরাহ দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘‘কানাডায় গিয়েই অ্যান্টি-সেমিটিজম বা জাতিবিদ্বেষ কাকে বলে বুঝতে পারি! হিন্দু-মুসলিম-বাঙালি-গুজরাতি-অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে মিলেমিশে থেকেছি। এখানে কখনও নিজেদের পর মনে হতো না।’’
ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূতও মনে করিয়েছেন, ভারতে ইহুদিদের বরাবরের শান্তিতে বসবাসের স্মৃতি। তিনি বললেন, ‘‘এ হল অতীতকে ধন্যবাদ বলা, আবার ভবিষ্যতের সঙ্গে নতুন সংলাপের মুহূর্ত!’’ ভারত ও ইজরায়েলের জন্য একযোগে ইহুদি রীতিতে প্রার্থনা করলেন তিনি। স্রেফ সাবেক ইতিহাস নয়, দুই দেশের টাটকা বন্ধুত্বের স্মারক হয়ে থাকল কলকাতার সিনাগগ।