ভোট উৎসবের বাদ্যি বেজে উঠলেই আমার মনে পড়ে যায়, অঝোর বৃষ্টিতে ভেজা কুড়ি বছর আগেকার সেই বুন্দেলখন্ডের ভোট। সবচেয়ে ভালো শাড়িটি পরে, খোঁপায় পিতলের কাঁটা ও ফুল, টিকমগড়ের তিন আদিবাসী রমণী এসেছেন ভোট দিতে। বহু পথ হেঁটে, মাঠ-বন পেরিয়ে। আমি কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক। সেটা ব্যালট পেপারের যুগ। জড়োসড়ো হয়ে তাঁরা বেরোতেই ‘হাউজ দ্যাট’ ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রিসাইডিং অফিসার— ধরেছি এ বার হাতেনাতে! কী হল? মোহর লাগিয়েছেন ব্যালট পেপারে, কিন্তু বাক্সে না ফেলে আঁচলে লুকিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন ওই তিন জন। কেন এমন? চাপে পড়ে বাক্সে কাগজ ফেলে তো এলেন, কিন্তু মহিলাগণ একেবারে হতাশ! এত পথ হেঁটে, এত সেজেগুজে ফিরে গিয়ে গ্রামে দেখাবেন কী? ভোট দেওয়ার প্রমাণ যে রয়ে গেল বাক্সেই!
কুড়ি বছরে সারা দেশ এগিয়েছে অনেকটা। ব্যালট বাক্স গিয়ে এসেছে ইভিএম, ইভিএমকে নিঁখুত করতে ভিভিপ্যাট, তার উপরে সেলফি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভোটার-নৃত্য তো আছেই! সর্বোপরি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য মুখ্য নির্বাচনী অফিস মিলে এত বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, যে ভোট না দিয়ে উপায় নেই। আমেরিকায় শুনলাম ছাপ্পা ভোট প্রায় অলীক, কারণ ভোট দেওয়াটাই কঠিন। আমাদের দেশের মতো ভোটের দিন বাধ্যতামূলক ছুটি নেই। মালিক বা সংস্থা ছুটি দিলে তবেই যাওয়া। গিয়ে নিজের পরিচয় দাখিল করাও যথেষ্ট তদন্তসাপেক্ষ। ফলে দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্তের পক্ষে ভোট দিতে পারাটাই একটা বিরাট কৃতিত্ব।
এখানেও কিছু সমস্যা আছে, তবে ডিজিটাল মাধ্যমের জন্য তার সমাধান সহজতর হয়েছে। যাঁরা জায়গা বদলেছেন দুই ভোটের মাঝখানে, তাঁরা অনলাইন অথবা অফলাইনে নির্বাচন কমিশনের ফর্ম ভরে ঠিকানার প্রমাণ-সহ যথা সময়ে জমা দিলে তবেই নাম উঠবে ভোটার তালিকায়। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আজকাল যতটা সময় ও অভিনিবেশ দিই, তার এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে এ কাজ হয়ে যায়। তাও অনেকে পেরে উঠি না। ফলে ভোট দেওয়া হয়ে ওঠে না। তাতে একটা সুবিধে হয়। অদায়বদ্ধতার আনন্দ। সব দলের নিন্দেমন্দ করে ছুটি কাটানো। মুম্বই-এর মত শহরে যেখানে পান থেকে চুন খসলে সমালোচনায় মুখর হন শিক্ষিত উচ্চবিত্ত, সেখানে ভোটের দিন ঘর থেকে বার হতেই তাঁদের মহা অনীহা। এত ঝামেলা পোয়ানোর সময় আমাদের কই — এই মানসিকতার ফলে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রথম বার মুম্বই-এ ভোটের হার ছোঁয় ৫০ শতাংশ।
বাংলায় আমরা বেশ গর্ব করি, আমাদের পরিচারিকারাও ভোটের ছুটির সঙ্গে আরও সপ্তাহখানেক জুড়ে দেশে যান ভোট দিতে। সবটাই কি আর তার উৎসব? ছেলে, মেয়ে, শ্বশুর, শাশুড়ি ওখানে থাকে, গিয়ে ভোটটা না দিলে কি আর টিকতে পারবো মা? নীচু গলায় বলে, মেয়েটা বড় হয়েছে। সে যে স্থানীয়, ভোটাধিকার ব্যবহার হল তার অকাট্য প্রমাণ। সুরক্ষাকবচও বটে। যাদের ভোট দেওয়া, বিপদে-আপদে তারা দেখবে। যদি না-ও দেখে, অন্তত আগ বাড়িয়ে বিপদ ডেকে আনবে না। ভারতের যাযাবর শ্রেণীর অধিকাংশই ভোট দিতে পারে না পরিচয়পত্র এবং রেশন কার্ডের মত জরুরি নথি না থাকার ফলে। তাঁদের সমস্যা নিয়েও রাজনীতিকদের মাথাব্যথা নেই।
ভোটারের কত মানসিক দ্বন্দ্ব। কাকে ভোট দিই, পার্টিকে না মানুষটাকে? পার্টি দেখে ভোট দিলাম, বিপুল জয়ের উৎসব হল, কিন্তু ও হরি— মানুষটা লোকসভায় গিয়ে একটিবারও মুখ খুলল না গো! এমপি তহবিলের টাকাও খরচ করেছে নামমাত্তর। এ দিকে আমাদের গ্রামের স্কুলটি পড়োপড়ো, নিকাশি নালা,কালভার্ট নেই! এ মুখো হলই না আর, তা কাকে কী বলি!
অন্য পার্টির মানুষটা ভালো, পড়াশুনো করেছে, বিদ্যেবুদ্ধি আছে, কিন্তু জিতবে কী আর? মাঝখান থেকে ভোটটাই নষ্ট হবে। কী বলো? প্রার্থীরা সব কোটিপতি। পার্টির সঙ্গে নিজের টাকা না ঢাললে কি জেতা যায়?
ভাল মানুষ, সৎ মানুষের জায়গা কই আর নির্বাচনে?
রাজনৈতিক দলের জন্য এখন নির্বাচন মানে যেনতেন প্রকারেণ জেতা। জয় ছাড়া অন্য কোনও লক্ষ্য নেই। বুথপিছু মার্জিনের জন্য আগাম ইনাম ঘোষণা হচ্ছে। তবু, মনটা খুঁতখুত করে নাকি? ভালো মানুষটাকে সবাই মিলে ভোট দিলে, যদি সে না-ও জেতে,আরও ভাল মানুষ হয়তো আসবে রাজনীতিতে। তবে বেশি দেরি না করাই ভাল। কয়েকবার ভোটে দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন বিদূষী, সৎ মহিলা ব্যাঙ্কার। তখন তাঁর বরাতে জুটেছিল তির্যক মন্তব্য। তাঁর অকাল মৃত্যুর পরে মানুষের আক্ষেপ উথলে উঠেছিল সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে। আহা, ইনি যদি আমাদের প্রতিনিধি হতেন!
নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের অপরাধমূলক ইতিহাসের বিবৃতি জনসমক্ষে আনা বাধ্যতামূলক করেছেন। এটা ভাল পদক্ষেপ। কিন্তু অপরাধীকে ভোট না দেওয়ার দায় কে বইবেন? স্থানীয় থানা-পুলিশ সারা বছর রক্ষা করবেন কি ভোটারকে? সন্ত্রাসের চেহারা যে দেখেছে, যাকে রুজি-রোজগার-পরিবার বাঁচিয়ে চলতে হয়, সে কোন দিকে যাবে? নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকা না আত্মরক্ষার তাগিদ? বিশেষত,
যখন অপরাধী বিশেষে পুলিশ গরম জল আর অ্যাসিডের ফারাক করতে পারে না?
ভোটারের তা হলে অনেক দায়। পরিচয়পত্রে ঠিকানা দাখিলের, ভোটার লিস্টে নাম তোলার, ঠিক দিনে অন্য কেউ স্বর্গ থেকে নেমে এসে দিয়ে ফেলার আগেই নিজের ভোটটি দেওয়া, আর ক্ষেত্রবিশেষে ভোটের সঙ্গে মেশিনের প্রিন্ট আউট মেলানো। ভোটের সময়ে ও পরে সমাজবিরোধীদের হাতে হত বা আহত না হয়ে বেঁচে থাকা। দায় তো পুরোটা তারই— এই প্রৌঢ়, জীর্ণ গণতন্ত্রকে নিজের কাঁধে বয়ে, পায়ে পায়ে ভারতীয় সংবিধানের ভূমিকার দিকে এগোনো! তবু রামচন্দ্র গুহ বলবেন, আমাদের ডেমোক্রেসি ফিফটি-ফিফটি!
সাধে কী মুম্বই-এর রইসরা ভোট দেন না। কে বইবে বাপ গণতন্ত্রের বোঝা!