এভাবেও বেঁচে থাকা যায় প্রমাণ করলেন দমদমের চক্রবর্তী পরিবার। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে সমর চক্রবর্তীর আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি পরিবার। কিন্তু এরই মাঝে মাথা ঠান্ডা রেখে মরণোত্তর দেহ দানের সিদ্ধান্ত নেন সমর বাবুর নিকটজনেরা। আর সেই সিদ্ধান্তেই নতুন জীবন ফিরে পেলেন হাওড়ার বোটানিক্যাল গার্ডেন অঞ্চলের ৪৬ বছরের মাধুরী সাহা
লিভারের কঠিন ও জটিল অসুখে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিলেন মাধুরী। গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট ও লিভার বিশেষজ্ঞ ডা মহেশ গোয়েঙ্কার তত্ত্বাবধানে চিকিতসা চলছিল। তিনিই বলেছিলেন রোগীকে বাঁচাতে গেলে অবিলম্বে লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। ই এম বাইপাসের ধারে বেসরকারি হাসপাতালে মাধুরী যখন কোমায়, ঠিক সেই সময়েই সমরবাবু ডায়ালিসিসের জন্যে ভর্তি হয়েছিলেন নাগের বাজারের এক বেসরকারি হাসপাতালে। ডায়ালিসিস চলাকালীনই আচমকা ম্যাসিভ ব্রেন স্ট্রোক হয় তাঁর। চিকিৎসকদের যাবতীয় চেষ্টা বিফল করে দিয়ে মস্তিষ্কের মৃত্যু হয় তাঁর।
কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা প্রতীম সেনগুপ্তই মরণোত্তর দেহদান করে মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানান। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি দাদা সুজিত চক্রবর্তী ও ভাই সায়ন চক্রবর্তী। পরিবারের সবাইকে বুঝিয়ে মৃত ভাইয়ের অঙ্গ বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী হন। চক্রবর্তী পরিবার রাজি হওয়ার পরই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া মাধুরীর স্বামী রামপ্রসাদ সাহার কাছে জানতে চাওয়া হয়, অবিলম্বে লিভার প্রতিস্থাপনে রাজী কিনা। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেনি হাওড়ার সাহা পরিবার। ব্রেন ডেথ হওয়া সমর বাবুকে আনা হয় অ্যাবাইপাসের হাসপাতালে। ব্রেন ডেথের সত্যতা যাচাই করতে দু’বার অ্যাপনিয়া টেস্ট করে মস্তিষ্কের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরই বিভিন্ন অঙ্গ পরীক্ষা করে দেখা হয় তা দান করার উপযুক্ত কিনা। ডায়বিটিসের রোগী সমরের বিকল কিডনির পাশাপাশি হার্টের অবস্থাও বিশেষ ভালো ছিল না। শুধুমাত্র সুস্থ লিভার ও কর্ণিয়া প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রামপ্রসাদ সাহা জানান, যাদের এতো বড় মন যাদের তাদের আমার আত্মার আত্মীয় মনে হয়। রক্তের সম্পর্ক না থেকেও একজন অচেনা মানুষকে বাঁচাতে চক্রবর্তী পরিবার যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তাতে আমি ও আমার ছেলে অভিভূত। এ ছাড়া হাসপাতাল ও ডাক্তার বাবুদের যে সহযোগিতা পেয়েছি তাতে কখনও মনে হয়নি যে খারাপ কিছু হতে পারে।
লাগাতার ১০ ঘন্টা ধরে লিভার প্রতিস্থাপন সার্জারি করা হয়। দিতে হয় ৪০ ইউনিট রক্ত। সারা রাত হাসপাতালের প্রায় ৬০ জন চিকিতসক ও সহায়ক কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দক্ষতায় সফল হল ক্যাডাভার লিভার ট্র্যান্সপ্ল্যান্টেশন। ২৭ জুলাই সকালে অ্যাপোলো হাসপাতালে এই নিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গ্যাসট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের অধিকর্তা ডা মহেশ গোয়েঙ্কা জানালেন, ‘‘যে পূর্ব ভারতে এটিই প্রথম সফল ক্যাডাভার লিভার প্রতিস্থাপন। এখনও পর্যন্ত মোট ১৮ টি সফল যকৃত প্রতিস্থাপন হয়েছে। এখনও বেশ কয়েকজন ক্রনিক লিভার ডিজিজের রোগী যকৃত প্রতিস্থাপনের জন্যে অপেক্ষা করছেন। হাসপাতালের সিইও ডা রূপালি বসু জানালেন, ‘‘দুর্ঘটনা বা অন্য কারণে ব্রেন ডেথ হলে সে মানুষটির দেহদান করা হলে অনেক অসুস্থ মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। অথচ এই ব্যাপারে বেশিরভাগ মানুষের কোনো সচেতনতাই নেই। এর আগে বেশ কয়েকজন ব্রেন ডেথ হওয়া মানুষের আত্মীয়দের কাছে দেহ দানের জন্য আর্জি জানানো হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে রাজি হলেও পরে তারা পিছিয়ে যান। অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে দেহদান করলে পরজন্মে নাকি কিডনি, লিভার বা চোখ ছাড়া জন্ম হবে। সমর চক্রবর্তী ও তাঁর পরিবার সকলের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। মরণোত্তর দেহদান ও সলিড অরগ্যান (লিভার, কিডনি, হার্ট,ইন্টেস্টাইন ইত্যাদি) ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের ব্যাপারে সব থেকে এগিয়ে রয়েছে স্পেন ও ইটালি। ওই দেশে প্রতি দশ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৩৫ জনের প্রতিস্থাপন করা হয়। আমেরিকাতে প্রতি ১০ লক্ষে ১৪ জনের এবং আমাদের দেশে মাত্র দশমিক চার জনের প্রতি দশ লক্ষে। ভারতবর্ষে ব্রেন ডেথ ও অরগ্যান ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের নিরিখে সব থেকে এগিয়ে আছে চেন্নাই। আর সবথেকে পেছনে আমাদের বাংলা। সব শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কাছে আবেদন মরনোত্তর দেহদানের ব্যাপারে সচেতন হন। সমর বাবুর দুটি কর্ণিয়া দু’জন দৃষ্টিহীন মানুষকে দেখার সুযোগ করে দেবে। আশা করা যাচ্ছে মাধুরী সাহা দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন।’’
আরও পড়ুন: কী ভাবে আঘাত, বয়ান মেলাচ্ছে পুলিশ