India Against Corruption

দুর্নীতি বিদায়ের রাজনীতি

গণতন্ত্রে শাসকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সর্বত্র। আড্ডা, খবরের কাগজ, জনসমাবেশে নিয়মিত চলে দুর্নীতির উচ্চ ফলনশীল চাষ। সর্বদাই বয়ানটি প্রায় এক: দুর্নীতিতে ভরে গেল দেশ।

Advertisement

তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৪ ০৬:১০
Share:

মনে আছে, জন অরণ্য ছবির সেই দৃশ্যটা? বাড়ির বড় বৌয়ের তত্ত্বাবধানে লোডশেডিংয়ে খেতে বসেছেন বৃদ্ধ বাবা ও দুই ছেলে, কথা চলছে ঘুষ নিয়ে। বাবা বলছেন, “তুই যে অর্ডারটা পাবি, সেটা কী বেসিসে পাবি? তোর মালটা ভাল বলে, না কি রেটটা ভাল বলে, না কি তুই মানুষটা ভাল বলে?” ছেলের উত্তর, “ঘুষটা ভাল বলে।”

Advertisement

দুর্নীতি বা ‘ভ্রষ্টাচার’ শব্দটির সঙ্গে ভারতীয়দের পরিচয় সত্যিই দীর্ঘ কালের। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গুন্নার মির্দাল ১৯৬৮-তে প্রকাশিত দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এক সমাজতাত্ত্বিক সন্দর্ভে বিষয়টিকে প্রথম বিশদে তুলে ধরেন। তিনটি বিষয়ের কথা বলেন, ১) দুর্নীতিকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা মুখে মুখে বানানো কিস্‌সা, ২) দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও আইনগত নিদান ও বিধান, ৩) দুর্নীতি বিষয়ক তথ্য ও তার বিচিত্র রকমফের।

গণতন্ত্রে শাসকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সর্বত্র। আড্ডা, খবরের কাগজ, জনসমাবেশে নিয়মিত চলে দুর্নীতির উচ্চ ফলনশীল চাষ। সর্বদাই বয়ানটি প্রায় এক: দুর্নীতিতে ভরে গেল দেশ। অথচ দুর্নীতির মাথায় যে বসে, সে আইনের নাগালের বাইরে। ১৯৭৪ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণ ইন্দিরা গান্ধীর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে সর্বাত্মক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন তা ছিল একাধারে দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনও। দুর্নীতিরাজকে যুক্ত করা হয়েছিল গণতন্ত্রের সঙ্কট ও বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে। বস্তুত, দুর্নীতি বেলাগাম হওয়ার পথ পায় স্বৈরশাসনে। আবার দুর্নীতি দমনের যূপকাষ্ঠেও প্রায়শ বলি হয় গণতন্ত্র। সরকারি দুর্নীতিকে জনসমক্ষে বেআব্রু করে বিরোধী গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে, নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক বা সামরিক ক্ষমতাবলে।

Advertisement

ইউপিএ সরকারের আমলে কমনওয়েলথ, টুজি, কয়লা, একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। সেই অভিযোগ নিয়ে ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট করাপশন’-এর দেশব্যাপী সর্বাত্মক আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের সাফল্যের সিঁড়ি বেয়েই দেশে অতি-দক্ষিণপন্থার পুনরুত্থান। দুর্নীতির দাওয়াই হিসাবেই নোটবন্দির মতো দমনমূলক নীতির প্রবর্তন এবং অজস্র মানুষের জীবনে বিপর্যয়। অর্থাৎ, দুর্নীতি নামক ছুরিটি যেতেও কাটে আসতেও কাটে।

এ রাজ্যে এখন সবচেয়ে চর্চিত বিষয়টির নাম দুর্নীতি। শুধু আজ কেন বিগত এক দশক ধরে এ রাজ্যে কাগজ বা টিভি খুললেই কেবল দুর্নীতির খবর। কিন্তু দুর্নীতির পিছনে কারণগুলো কী? মানবোন্নয়ন সূচকের সঙ্গে দুর্নীতির যোগাযোগ বেশ ওতপ্রোত। অর্থাৎ, যে সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান, আয়, আয়ু ইত্যাদি যত বেশি সুরক্ষিত, সেখানে এই রোগের ছোঁয়াচ তত কম।

উদাহরণ স্বরূপ, অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের কর্মচারীর বেশি। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ঘুষের টাকা উসুল করতে ভোগ্যপণ্যে ভেজাল মেশাবেন, বা মূল্য বৃদ্ধি করবেন। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হলে কর্মচারীর ক্রয়ক্ষমতা আরও হ্রাস পাবে। ফলত তিনি আরও বেশি ঘুষ নেবেন। এই ভাবে এক দুষ্ট চক্র গোটা সমাজকে গ্রাস করে। দুর্নীতিগ্রস্তের কঠোর শাস্তিবিধান তাই সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। কিছু দুর্নীতিবাজ তাতে জব্দ হয় বটে, তবে দুর্নীতির বিলোপ হয় না।

তা হলে এই দুষ্ট চক্র ভাঙার উপায়? উপায় একটিই— মানবোন্নয়ন সূচকের বৃদ্ধি। গত শতকের ষাটের দশকে কেরলের উদাহরণ অনুধাবনযোগ্য। কয়েক বছরের মধ্যে একটা রাজ্য সাক্ষরতা, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যু, জন্মনিয়ন্ত্রণ, লিঙ্গসাম্যে বিশ্বের উন্নত দেশগুলির সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল। কেরল যদি পারে, পশ্চিমবঙ্গ নয় কেন? আসল কথা হল রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

দুর্নীতিকে সমূলে বিনাশ করতে চাইলে সম্পদ উৎপাদন ও তার সুবণ্টন দরকার, বিশেষত গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগণের মধ্যে। আর অবশ্যই চাই শিক্ষা। কর্মস্থান বা বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতিও জনগণের অর্থ নয়ছয়ের নামান্তর। চাই স্বাস্থ্যসুরক্ষাও। ভারতে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। দরিদ্র সমাজে এই হার আরও অনেক বেশি। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে দেনার দায়ে আকণ্ঠ ডুবে থাকা ও দুর্নীতির দায়ে জর্জরিত একটি সরকারের পক্ষে কি সম্ভব দুর্নীতির দুষ্টচক্রের বিনাশ?

অন্য দিকে, সাম্প্রতিক আন্দোলনে আমরা কী দেখলাম? যে-হেতু পাখির চোখ হয়েছে দুর্নীতি, একটা সম্পূর্ণ নতুন সংস্কৃতি, নতুন এক আঙ্গিক মঞ্চের সম্মুখজমির দখল নিল। তথাকথিত ‘নিম্নবর্গ’-এর দুষ্টাচার দেখতে দেখতে যে মন ক্লান্ত, তা অন্তত কিছু দিন রাজনীতির এক শিষ্ট রূপ দেখার অবকাশ পেল। বহু কাল পর এও দেখা গেল রাজনীতির অঙ্গনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত খুব একটা অবজ্ঞার পাত্র নয়। দিল্লির আম আদমি পার্টিও গড়ে উঠেছিল প্রধানত মধ্যবিত্তদের নিয়ে, ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট করাপশন’ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। রাজনীতিজীবীর হাত বদলে তরুণ পেশাজীবীর হাতে ছিল রাশ, যাঁদের না ছিল আর্থিক সঙ্গতি, না কোনও শক্ত সংগঠন। ভারতের প্রথম পলিটিক্যাল স্টার্টআপ-কে দেখে বোঝা গিয়েছিল, নয়া উদারবাদী যুগের সঙ্গে ভাল খাপ খায় পেশাদারদের এই সংগঠন।

অতএব নতুন দল গড়তে হবে নতুন দিগ্‌দর্শন দিয়েই। পুঁজি বিশেষ কিছু না থাকলেও মাথায় সঠিক দিশা ও বুকে গতানুগতিকের বাইরে ভাবার স্পর্ধা নিয়ে। এবং সেই ভাবনাকে নিয়ে গভীর আবেগ ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে। আজকের স্টার্টআপ পলিটিক্স-এর পাথেয় হতে হবে এ রকমই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement