Organ Donation

ঘরেই যখন বসত করেন উমা

প্রবল বাধা দেন বাবা-মা, অসীম ও শেফালি সামন্ত। তাঁদের এক পরিচিতের সাহায্যে নাছোড়বান্দা মেয়ে পাঁশকুড়ার মঙ্গলদাড়ি গ্রাম থেকে রাজধানীতে পৌঁছে যান।

Advertisement

জয়তী রাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:১৯
Share:

ভালবাসা: দিশা ও লিসা সামন্ত। নিজস্ব চিত্র

গ্রামের বাড়িতে একা থাকতে থাকতে দুশ্চিন্তার পাহাড় জমছিল। তারই মধ্যে ফোনে এসেছিল সংবাদটা। মা পারবেন না। বাবাও না। ডাক্তার জানিয়েছেন, তাঁদের কারও যকৃৎ-ই দেওয়ার উপযুক্ত নয়। প্রথমেই মাথায় প্রশ্ন আসে, দিশার তা হলে কী হবে? দ্রুত পরের ফোনটা গিয়েছিল দিল্লির হাসপাতালে, মা শেফালি সামন্তের কাছে। দৃঢ় স্বরে লিসা তাঁকে বলেন, “দিশাকে আমিই লিভার দেব। দিল্লি যাচ্ছি।”

Advertisement

প্রবল বাধা দেন বাবা-মা, অসীম ও শেফালি সামন্ত। তাঁদের এক পরিচিতের সাহায্যে নাছোড়বান্দা মেয়ে পাঁশকুড়ার মঙ্গলদাড়ি গ্রাম থেকে রাজধানীতে পৌঁছে যান। মাইক্রোবায়োলজির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তখন তিনি। সেই প্রথম, বছর বারোর বোনের জন্য প্রায় সতেরোশো কিলোমিটার পথ একা পাড়ি দেন। পরের কাহিনি বদলে দেয় তাঁদের সম্পর্কের রসায়ন। সাত বছরের বড় দিদি হয়ে ওঠেন ‘মা’। দিশার কথায়, “দিদি সব্বার থেকে আলাদা। সবাইকে ভালবাসতে জানে। আমাকে খুব খুব ভালবাসে। ওকে আমি ভয় পাই না। তবে মেনে চলি। অথচ, নিয়ম করে ঝগড়াও করি। সব শেয়ার করি। এই বন্ধনটা ছিলই। এখন ওকে বেশি শ্রদ্ধা করি। বুঝতে পারি, দিদির আচরণেও বদল এসেছে। আমাকে আরও আগলে রাখে।”

ছোটবেলায় দিশার চার-পাঁচ ডিগ্রি জ্বর উঠে যেত। চিকিৎসা করে জানা যায়, ক্যারোলিস ডিজ়িজ়ে আক্রান্ত সে। তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ভবিষ্যতে যে যকৃৎ প্রতিস্থাপন করতেই হবে, আভাস পেয়েছিলেন সামন্ত দম্পতি। তাই ডাক্তারের কথা মতো একটু বেশিই সতর্ক থাকতেন ওঁরা। এখন যকৃৎ প্রতিস্থাপনের পরে সে সব আরও বেশি মানা হয়।

Advertisement

পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার মঙ্গলদাড়ি গ্রামে সাকুল্যে একটাই দুর্গাপুজো হতে দেখেছেন লিসা আর দিশা। পুজো মানে ওঁদের কাছে বাড়িতে ছুটি কাটানোর উৎসব। বাবা-মায়ের সঙ্গে এক বা দু’দিন বেরিয়ে ঠাকুর দেখে, এ দিক-ও দিক ঘোরা। আর অষ্টমীর অঞ্জলি। ব্যস, পুজোর আনন্দ এই পর্যন্তই। নতুন জামা প্রাপ্তি হয় ঠিকই, তবে তা নিয়েও কোনও কালে মাতামাতি নেই। বরং বছরভর খুনসুটিতেই ওঁদের মাতামাতি। স্নাতকোত্তর পড়ার সূত্রে হস্টেলে থাকেন লিসা। ফলে পুজোর ছুটিতে বাড়ি ফেরার আলাদা টান এখন ছোট বোন।

‘‘পুজোয় অনেকটা সময় ওর সঙ্গে কাটাতে পারব। বুঝতে পারি, আমার মধ্যে বড় পরিবর্তন এসেছে। ওকে আমার নিজেরই অংশ বলে মনে হয়। মনে হয়, আমিই তো ও। তবে প্রতিস্থাপনের পরে গত বছরেও অনেক বেশি সমস্যা হচ্ছিল দিশার। এ বছর মে পর্যন্ত কষ্ট পেয়েছে। এখন একটু স্বস্তিতে। বোনকে এত কষ্ট পেতে দেখেছি যে, নিশ্চিন্ত হতে আরও সময় লাগবে।’’— ধীরে ধীরে বলে চলেন লিসা।

‘‘জানেন, আমার বড়টা ছোট থেকেই মায়ের মতো স্নেহবৎসল। লিসার যখন বছর তিনেক বয়স, কাকার মেয়েকে নিজের পায়ের উপরে শুইয়ে বড়দের নকল করে তেল মাখাত।’’ বলছিলেন শেফালি। দিশার যখন ছ’মাস বয়স, কলেজের অ্যাকাউন্টসের কাজে ফিরতে হয় শেফালিকে। তখন বোনের পাশে বসে থেকে কাঁথা বা ন্যাপি বদলানো, খাওয়ানো সাড়ে সাত বছরের লিসা যেচে করত।

দিল্লির হাসপাতালে দিশার প্রতিস্থাপনের জন্য যখন লিসাকে নিয়ে চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছিল, তখনও বাধা এসেছিল। লিসার কোভিড হয়। লিসার কথায়, ‘‘কোভিড পজ়িটিভ হতেই ভেবেছিলাম, আমার সঙ্গে হয়তো কিছু খারাপ হবে। কিন্তু বোন? আমার জন্য কি বোনেরও ভাল হওয়া হবে না?’’ ভিন্ রাজ্যে ২১ দিনের আইসোলেশন কাটিয়ে ফিরে অবশেষে সেই দিনটা এল। ওটি টেবিলে কিছু ক্ষণের জন্য পাশাপাশি শুয়ে ছিলেন দুই বোন। এক জনকে ভরসা জোগাতে অস্ত্রোপচারের আগে আর এক জনের শেষ কথাটা ছিল, ‘‘যা হবে সব ভাল হবে।’’

দিদির ৬০ শতাংশ যকৃৎ প্রতিস্থাপিত হয় বোনের শরীরে। অস্ত্রোপচারের পরে সংজ্ঞা ফিরতেই জড়ানো গলায় লিসা ডাক্তারকে প্রশ্ন করেন, ‘‘বোন কেমন আছে?’’ মুগ্ধ ডাক্তারবাবু সে কথা বলেও আসেন সামন্ত দম্পতিকে।

সামান্য কাঁপা গলায় শেফালি বললেন, ‘‘এমন দু’টি মেয়ে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের। বড়টা আমাদের কাছে উমা, দুর্গা, লক্ষ্মী— সব। ওর জন্যই দুটোকে কোলে পেলাম।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement