অতীত: স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে অভিজ্ঞান মুখোপাধ্যায়। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
মহালয়ার দিন থেকেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন বছর কুড়ির তরুণী। পুজো আর ভাল লাগে না তাঁর মায়েরও। মনখারাপের পাহাড় জমছে আন্দুলের মজুমদার পাড়ার মুখোপাধ্যায় বাড়িতে। তবু মেয়ের কষ্টে প্রলেপ দেওয়ার অবিরাম চেষ্টা করে চলেছেন মা পাপিয়া মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে চলছে সন্তানহারা এক বৃদ্ধকে আগলে রাখার যৌথ প্রয়াস।
২০২০ সালের ২৪ জুলাই। চিরতরে বদলে গিয়েছিল এই বাড়ির জীবনের ছন্দ। কোভিডের বিরুদ্ধে প্রথম সারিতে থেকে লড়াই চালানো সৈনিক অভিজ্ঞান মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়েছিল কোভিডেই। করোনায় মৃত কলকাতা পুলিশের প্রথম আধিকারিক অভিজ্ঞানই পাপিয়ার স্বামী। সংসারের আঙিনা আর স্বামীর ছায়ায় থাকা সেই স্ত্রী এখন নিত্যদিন ছোটেন লালবাজারে। কাজের শর্তে। অফিসে যাতায়াতের ফাঁকে রোজ বাসের জানলা দিয়ে উঁকি মারা শরতের আকাশ আর টানে না তাঁকে। বরং পর পর ভাসিয়ে দেয় টুকরো রঙিন স্মৃতির কোলাজ। স্বামীর অভাব বয়ে চলার পাশাপাশি বাবা আর ছেলে হিসাবে তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে নিরন্তর লড়াই চলছে পাপিয়ার। ‘‘পঁচিশটা বছর একসঙ্গে থেকেছি। অভিজ্ঞানকে ছাড়া পুজো কাটানোর কথা কখনও ভাবিনি। প্রতি বছর পুজোয় ডিউটি সেরে ভোরে ফিরেও আমাদের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত। দিনভর হুইহুল্লোড়, খাওয়াদাওয়া... কত কী! এমনই জীবনীশক্তি ছিল মানুষটার।’’ ধরা গলায় বলে খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ সব। ফের পাপিয়া বলতে শুরু করেন, “মেয়ে আর শ্বশুরমশাইয়ের জন্য আমাকে শক্ত থাকতেই হবে। মেয়েও আমাকে ভীষণ আগলে রাখে। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, অভিজ্ঞান আমাদের মধ্যেই আছে। এবং থাকবেও। তাই তো ওঁর ছবিতে কখনও মালা পরাইনি। কখনও পরাবও না।’’
অভিজ্ঞান ছিলেন রঙিন মনের এক মানুষ। পাছে তাঁকে অসম্মান করা হয়, তাই আজও লাল শাড়ি, টিপ পরেন পাপিয়া। জোর করে জীবনের এই দিকগুলো আগের ছন্দে চালাতে চেষ্টা করেন। যদিও তাল যে কেটে গিয়েছে, তা আরও স্পষ্ট হয় মোহরকে দেখলেই। পুজো যত এগিয়ে আসছে, একমাত্র মেয়ের কথা ভেবে মায়ের মন আরও দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। দম্পতির একমাত্র মেয়ে, অগ্নিহোত্রী ওরফে মোহর চলতি বছরেই কার্শিয়াঙের স্কুল থেকে দিল্লি বোর্ডের উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এসেছেন। সেন্ট জ়েভিয়ার্স বা প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজি নিয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে। মায়ের তুলনায় একটু বেশি বাবাভক্ত মেয়ের এখন বেশির ভাগ সময় কাটছে বাড়িতেই। পাপিয়া বলেন, “বয়সে বাড়লেও আসলে ছোটই আছে। বাবার মতোই খুব চাপা স্বভাবের। গুম হয়ে থাকে। একা একা বাবার জন্য কাঁদে। বাবার জন্য মনখারাপ করলে আমাকে মেসেজ করে। বোঝাই তখন।’’
বাড়ির কাছেই দুর্গাপুজোর মণ্ডপ। গত বছর ওঁরা কেউ ও-মুখো হননি। এ বারেও কী করবেন, কেউ জানেন না। তবে পঁচিশ বছর ধরে অভিজ্ঞানের সঙ্গে শহরের মণ্ডপ ঘোরার স্মৃতি এ বারেও সঙ্গী হয়ে থাকবে পাপিয়ার। ‘‘অভিজ্ঞানই আমাকে জীবনদর্শন শিখিয়েছে। রাত জেগে ডিউটি সেরেও পরিবারকে নিয়ে একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ায় ওঁর বিন্দুমাত্র উৎসাহের অভাব ছিল না কখনও।’’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠেন পাপিয়া।