বাবলু করিম ও মালা রায়।— নিজস্ব চিত্র।
হাতে ভরসা রেখেছিলেন কালও। অথচ তিনিই আজ জোড়া ফুলে!
ছিলেন হাতে। অথচ ভোট-ময়দানে তিনিই এখন পদ্ম-ছায়ায়।!
ছিলেন কট্টর জোড়া ফুল-বিরোধী। অথচ ভোট-মায়ায় তাঁরই মুখে এখন ঘাসফুলের স্তুতি!
পুরভোটে নিজেদের নির্বাচনী দৌড়ের গতি বাড়াতে নীতি-রাজনীতির আক্রমণ, প্রতি আক্রমণকে ভোকাট্টা করে ‘দলবদলু’ একঝাঁক নেতা-নেত্রীই এ বার কলকাতায় প্রার্থী। তাঁদের অনেকেই হয়তো এক দশকেরও বেশি লড়েছেন কোনও প্রতীকে। জিতেওছেন। কিন্তু এখন হাওয়ায় তাঁরাই ভোটারদের কাছে ভোট-ভিক্ষা করছেন অন্য প্রতীকে! ‘দলবদলু’ প্রার্থ়ীদের ভিড় বেশি তৃণমূল এবং বিজেপি-তেই। প্রতীক বড় না ব্যক্তি, পুর-বাজারে এই তর্ক জমিয়ে দিয়েছেন তাঁরা!
পুরনো প্রতীকে জয়ের ব্যাপারে সংশয় থেকেই অনেকের এমন দলবদল বলে গুঞ্জন। ‘দলবদলু’ এই প্রার্থীরা অবশ্য তা স্বীকার করতে নারাজ। রাতারাতি দল বদলে এলাকার ভোটার-মনে কি অস্বস্তি বাড়িয়েছেন তাঁরা? সহমত নন ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী বাবলু করিম। দিনকয়েক আগেও যিনি ছিলেন বন্দর এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা। ব্যক্তিগত ক্যারিশমাতেই জিতবেন বলে আত্মবিশ্বাসী বাবলু বরং বলছেন, ‘‘প্রণব মুখোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকলেই তো দল বদলেছেন! মানুষ এতে অভ্যস্ত।’’ তাঁর আরও ব্যাখ্যা, এক সময় কংগ্রেসের রাম পিয়ারি রাম এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের কলিমুদ্দিন শামসের পরিবারের দাপটের বিরুদ্ধে লড়ে তৃণমূলের সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এখন তাঁরাই তৃণমূলে আদৃত এবং প্রার্থী! তাই তিনি বিজেপি-তে।
প্রবল মমতা-বিরোধী মালা রায় তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগের দিন কংগ্রেস ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন জোড়া ফুলে। তাঁর কাছে তৃণমূল ‘পুরনো দল’ ঠিকই। কিন্তু দিনের পর দিন তাঁর মুখে মমতা–বিরোধিতার পরে এখন মমতা-স্তুতি শুনে ভোটাররা প্রশ্ন করছেন না? মালাদেবীর জবাব, ‘‘তখন অন্য মেরুকরণে ছিলাম। তাই ওই ধরনের কথা বলতে হতো। কিন্তু আমি এলাকার মানুষের পাশে প্রতি মুহূর্তে, আপদে-বিপদে থাকি। ভোটাররা তা জানেন।’’ টানা ২০ বছরের কাউন্সিলরের এই দল বদল যে স্রেফ জেতার তাগিদে নয়, তা প্রমাণ করতে মালাদেবীর যুক্তি, ‘‘২০১০ সালে প্রবল তৃণমূল হাওয়া ছিল। তখনই তো দল বদলাতে পারতাম! করিনি তো!’’ ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী শুক্লা মজুমদারও হাত ছেড়ে এ বার পদ্ম-শিবিরে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিঁধেই শুক্লাদেবী বলছেন, ‘‘মালা রায় তো পাঁচ বার দল বদলেছেন! তা হলে?’’ তাঁর মতে, ‘‘মানুষের ভাল করার ক্ষমতা কংগ্রেসের আর নেই। জাতীয়তাবাদী বিজেপি-র আছে।’’ মালাদেবীর মতোই কংগ্রেসের অন্য দুই কাউন্সিলর অরুণ (বিশু) দাস এবং সুমন সিংহ হাত বদলে জোড়া ফুলে গিয়ে এ বার প্রার্থী হয়েছেন পুরনো ওয়ার্ড থেকেই। ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের অরুণবাবু ৪৬ বছরের কংগ্রেস-সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য দায়ী করছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকেই। সেই সঙ্গেই তাঁর অভিযোগ, বিরোধী দলে থাকলে এলাকা উন্নয়নে অনুদান কম মেলে। অরুণবাবুর কথায়, ‘‘বিরোধী দলে থাকলে অনেক সময় অনেক কাজ টাকার অভাবে করা যায় না। শাসক দলে থাকলে তা সম্ভব।’’ প্রতীকের দাপটে নয়, নিজের কাজের জোরেই জিততে আত্মবিশ্বাসী অরুণবাবু প্রচারেও বলছেন, ‘‘কাজই আমার পরিচয়। আমার থেকে যোগ্য কেউ থাকলে তাঁকে ভোট দিন!’’ ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী সুমনও বলছিলেন, ‘‘এলাকার বস্তিতে পূর্ত দফতরের অনেক কাজ বাকি। কংগ্রেসে থেকে সে কাজ করতে পারিনি। শাসক দলে সুবিধা পাব।’’
ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলে এসে বন্দরে এ বার প্রার্থী নিজামুদ্দিন শামস। প্রাক্তন মন্ত্রী কলিমুদ্দিন-পুত্রও সুমনদের সুরেই বলছেন, ‘‘ক্ষমতার জন্য নয়, মানুষের কাজ করতে পারব, তাই তৃণমূলে যোগ দিয়েছি।’’ ৯৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর মালা মহলানবিশকে এ বার তৃণমূল প্রার্থী করেনি। ওই ওয়ার্ডেই বিজেপি-র প্রতীকে দাঁড়িয়ে মালার বক্তব্য, ‘‘গত পাঁচ বছরে যা কাজ করেছি, তাতে মানুষ ফের আমাকে আশীর্বাদ করবেন আশা করি।’’
দলবদলের এই ধারা সাম্প্রতিক কালে এত গতি পেয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে, ভিন্ দল থেকে তৃণমূলে এসে বিধায়ক-সাংসদ হয়ে গিয়েছেন কেউ কেউ, তাতেই আরও উৎসাহ পেয়েছেন কাউন্সিলর-প্রার্থ়ীরা। গত বার পুরভোটেই কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে রাম পিয়ারি ও তাঁর স্ত্রী হেমা রাম তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিলেন। এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী ওই দম্পতি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের যুক্তি, ‘‘এঁরা বেশির ভাগই পরীক্ষিত নেতা। তৃণমূলকে ভালবেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি-আদর্শে ভরসা রেখেই মানুষের কাজ করতে চান এঁরা। তাঁদের প্রার্থী করতে আপত্তি কোথায়?’’
কার ভরসা-ভালবাসা কত দিন কোথায় থাকে, পুর-বাজারে হিসাবটা অবশ্য গুলিয়েই যাচ্ছে!