কলকাতা শহরের সৌন্দর্যায়নে কোটি টাকা খরচ করছে প্রশাসন। কিন্তু এই প্রচেষ্টার মধ্যে মেয়েদের শৌচাগার কতটা জায়গা পেয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। অফিসে, স্কুল-কলেজে-বাজারে বেরোনো মেয়েদের রাস্তার মাঝে শৌচালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলে এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠই চোখে অন্ধকার দেখেন এবং ভয়ে গুটিয়ে যান বলে দাবি অধিকাংশ মেয়ের। কারণ তাঁদের জন্য রাস্তায় নির্দিষ্ট ব্যবধানে শৌচালয়ের অভাব।
এ জন্য শৈশব থেকেই জল কম খাওয়ার অভ্যেসটা মজ্জাগত করে ফেলেন অনেক মেয়ে। কারণ জল বেশি খেলেই বার বার শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে। ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের অনেকের শরীরে বাসা বাধে কিডনি এবং মূত্রনালি ও মূত্রথলি সংক্রান্ত রোগ। সঙ্গে রাস্তাঘাটে শৌচালয়ের অভাবে অনেককেই তুমুল অস্বস্তি ও দিশেহারা পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
কলকাতা পুরসভার হিসেবে, এ শহরে পাশাপাশি পুরুষ ও মহিলা শৌচাগার রয়েছে মাত্র ২৩০টি জায়গায়। কলকাতার জনসংখ্যার নিরিখে যা নেহাতই কম। শুধু ছেলেদের জন্য অবশ্য এর বাইরেও শৌচাগার আছে, যা মেয়েদের নেই। মেয়েদের শৌচাগারগুলি অসম ভাবে বন্টিত। বেশিরভাগ ঘনবসতি, বস্তি অঞ্চলে রয়েছে একটি বা দু’টি মহিলা শৌচালয়। পুরসভা স্বীকার করছে, যে কোনও নাগরিকই পরিচ্ছন্ন শৌচাগার ব্যবহারের বিনিময়ে সামান্য খরচে পিছপা হন না। এমনকী, কাছাকাছি পরিচ্ছন্ন শৌচালয় পেলে ১-২ টাকা ফি দিয়ে তা ব্যবহারে আগ্রহ দেখান ফুটপাথবাসীরাও। শুধু আগ্রহী হয় না প্রশাসন। ফলে বাধ্য হয়ে মলমূত্র দীর্ঘক্ষণ চেপে রেখেই রাস্তাঘাটে থাকতে হয় মেয়েদের।
স্ত্রীরোগ চিকিত্সক রণজিত্ চক্রবর্তী, শিশু রোগ চিকিত্সক অপূর্ব ঘোষ এবং ইউরোলজিস্ট অমিত ঘোষের কথায়, “অনেকক্ষণ মূত্র চেপে থাকলে ‘ইরিটেবল ব্লাডার’ হয়ে মূত্র ধরে রাখার ক্ষমতা কমতে পারে বা বারে বারে মূত্রত্যাগের বেগ আসতে পারে। এ ছাড়া ব্লাডার ও কিডনি চিরতরে নষ্টও হতে পারে।” তাঁরা আরও বলেন, “সব জায়গায় শৌচাগার মিলবে না এই ভয়ে অনেক মহিলারা, এমনকী ছোট মেয়েরাও জল কম খান। তার থেকেও কিডনি-সহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। আবার নোংরা শৌচাগার ব্যবহার করার জন্য বহু মহিলা মূত্রনালীর সংক্রমণে ভোগেন।”
যদিও পশ্চিমবঙ্গের স্কুলশিক্ষা দফতরের কর্তাদের দাবি, রাজ্যের ৯০% স্কুলে ছাত্রীদের জন্য শৌচালয় রয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এক রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছে, দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে এমন সরকারি স্কুলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি যেখানে মেয়েদের আলাদা শৌচালয় নেই। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮২ হাজার সরকারি স্কুলের মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার স্কুলে মেয়েদের শৌচাগার তৈরি হয়নি। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের মোট তিনটি জেলায় (যার মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরও রয়েছে) গড়ে ১০% ছাত্রী প্রতি বছর স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে এবং তার অন্যতম কারণ স্কুলে শৌচালয়ের অভাব।
২০১২ সালে ভারতের পাঁচটি বড় শহরে (যার মধ্যে কলকাতা একটি ছিল) বস্তি এলাকায় একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল একটি বেসরকারি সংস্থা। যত লোকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল তাঁদের ৯৫ শতাংশ মত দিয়েছিলেন, মেয়েদের জন্য স্কুলে অবশ্যই আলাদা শৌচাগার দরকার। ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেছিলেন, ছেলে-মেয়ের ‘কমন টয়লেট’ ব্যবহার করলে মেয়েদের নানা রকম ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
বহ্নিশিখা, রক্তিমা, ঋদ্ধির মতো নারী অধিকার আন্দোলনে যুক্ত অনেকেই জানিয়েছেন, ফ্রয়েডের দৌলতে একটি পরিচিত শব্দ হল ‘পেনিস-এনভি।’ পুরুষদেহের একটা বাড়তি প্রত্যঙ্গের দৌলতে সমাজে পুরুষ কিছু বাড়তি সুবিধা ভোগ করে। তার অন্যতম হল, শৌচাগার না থাকলেও প্রকাশ্যে যেখানে-সেখানে মূত্রত্যাগের ছাড়পত্র। পুরুষেরা মূত্রের বেগ সইতে পারে না বলেই তো তাদের যত্রতত্র দাঁড়িয়ে পড়ে হালকা হওয়ার সামাজিক ছাড়পত্র আছে। আবার শৌচাগার নোংরা হলেও দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগের সুবিধার জন্য পুরুষেরা নোংরার ছোঁয়া এড়াতে পারেন এবং তাঁদের মূত্রনালীর সংক্রমণ কম (৩০ জন মেয়ের ওই সংক্রমণ হলে পুরুষদের মধ্যে সেই সংখ্যা ১) হয়।
২০১৪ সালে ভারতের একটি নামী অনলাইন ট্র্যাভেল কমিউনিটি প্রায় ১০ হাজার সাধারণ নাগরিক ও পর্যটকের উপর সমীক্ষা চালায়। বিষয় ছিল, ভারতের প্রধান শহরগুলিতে জন-শৌচালয়ে সম্পর্কে নাগরিক ও পর্যটকদের অভিজ্ঞতা। তাতে দেখা গিয়েছে, অপরিচ্ছন্ন শৌচালয়ের হারে কলকাতা প্রথম। রিপোর্ট বলছে, কলকাতার ৭৪ শতাংশ জন-শৌচালয় নোংরা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে মুম্বই ও চেন্নাই। নারীবাদীদের অভিযোগ, “সর্বংসহা মেয়েদের শৌচালয়ের অভাবে মল-মূত্র চেপে রাখতে হোক বা অপরিচ্ছন্ন শৌচাগারের জন্য তাঁদের মূত্রনালীর সংক্রমণই হোক, তাতে বয়েই গেল প্রশাসনের।”
পেশায় চিকিত্সক আত্রেয়ী সিংহের বক্তব্য, “শুধু রাস্তা নয়, লোকাল ট্রেন, এমনকী মেট্রোতেও শৌচাগার নেই। শৌচাগার নেই অনেক অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেও। অনেক স্কুল-কলেজে শৌচালয় থাকলেও তার এমন অবস্থা যে ব্যবহার করা যায় না। বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালে শৌচালয়ের এমন অবস্থা যে মেয়েরা সেগুলি ব্যবহার করতে পারেন না।”
আইনজীবী দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “প্রশাসন কি কখনও ভেবেছে হঠাত্ রাস্তাঘাটে শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন হলে, ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলে, নিতান্ত জরুরি অবস্থায় পোশাক বদলানোর দরকার হলে যখন আশপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে শৌচাগার মেলে না, তখন কী অবস্থা হয় মেয়েদের?” স্ত্রী রোগ চিকিত্সকেরা জানিয়েছেন, ঋতুস্রাব চলাকালীন দীর্ঘক্ষণ শৌচাগার ব্যবহার করতে না পাওয়া যোনিদ্বারে নানা সংক্রমণ তৈরি করতে পারে। মাসের পর মাস এমন চলতে থাকলে তার জেরে স্থায়ী কোনও ক্ষতির আশঙ্কাও থেকে যায়।