Kolkatar Korcha

কলকাতার কড়চা: মুখোমুখি হন দুই ‘বন্ধু’

বৌবাজারের ৪ নং সনাতন শীল লেনে জগন্নাথদেবজিউয়ের ঠাকুরবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন স্বরূপ চাঁদ ধর। দুশো বছরে পড়ল তা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২১ ০৮:০৪
Share:

কলিকাতার ইতিবৃত্ত’ বইয়ে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত আলাদা করে বলেছেন কলকাতার রথযাত্রার কথা। শেঠদের বিশাল রথের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, লালদিঘি থেকে বৈঠকখানা পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তাতেই হয়তো এই রথ টানা হত। সেই রাস্তা, মানে আজকের বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের দু’পাশে বৌবাজার অঞ্চলে রথের ঐতিহ্য প্রাচীন, আজও একাধিক বনেদি বাড়িতে রথযাত্রা উদ্‌যাপিত হয়। গোবিন্দ সেন লেনের চুনিমণি দাসী প্রতিষ্ঠিত ১২৫ বছরেরও বেশি পুরনো, পাঁচ চূড়াবিশিষ্ট ত্রিতল রথ সাজানো হয় পুতুল ও দেবদেবীর ছবিতে। কাছেই গোকুল বড়াল স্ট্রিটে জগন্নাথবাড়ির বিগ্রহের ‘মাসির বাড়ি’ থাকার প্রথা নেই, শতাব্দীপ্রাচীন রথে চড়ে নানা জ্ঞাতি-বাড়ি পুজো নিয়ে জগন্নাথ ফেরেন মন্দিরে। হিদারাম ব্যানার্জি লেনে গোবিন্দলাল দত্তর বাড়িতে রথ বেরোয় না, তবে জগন্নাথ এসে বসেন ঠাকুরদালানের আসনে। এই রাস্তাতেই নীলমণি দে’র ঠাকুরবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই পরিবারের সদস্যেরা রথ টানেন। এখানে রথ দেখতে গিয়ে বাড়তি পাওনা অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি দর্শন। বৌবাজারেই যদুনাথ দত্তের ঠাকুরবাড়িতে রথে আজও নহবত বসে, পারিবারিক প্রথা মেনে। রথের পরের দিন থেকে পুনর্যাত্রার আগের দিন পর্যন্ত হয় বিশেষ পুজো, ভোগ, নিত্য বেশ বদল। ঝুলনবাড়ি-খ্যাত রামকানাই অধিকারীর ঠাকুরবাড়ি চত্বরে জগন্নাথকে ছোট রথে বসিয়ে টানা হয়।

Advertisement

জগন্নাথকে ঘিরে আবর্তিত পরিবারের শ্রীবৃদ্ধির গল্পও। ব্যবসায় ক্ষতির মুখে নিত্যসেবা দুষ্কর হলে গৃহকর্তা চালের জালার মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন জগন্নাথ বিগ্রহ। তার পরেই দিন ফেরে, জগন্নাথও ফেরেন সিংহাসনে। গৃহকর্তা শ্রীক্ষেত্রে মানত করেছিলেন, ব্যবসায় সম্বৎসরের লাভের টাকায় গড়বেন জগন্নাথ মন্দির। সে বছর লাভ হল লাখ টাকার উপর! তার পরেই, ১৮২১ সালে বৌবাজারের ৪ নং সনাতন শীল লেনে জগন্নাথদেবজিউয়ের ঠাকুরবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন স্বরূপ চাঁদ ধর। দুশো বছরে পড়ল তা।

স্বরূপ ধরের সময়েই তৈরি সুদৃশ্য কাঠের রথে (ছবিতে মাঝখানে) চড়ে রথের দিন জগন্নাথ ঠাকুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে বৌবাজারের কিছু অংশ ঘুরে সাত দিন থাকেন ৮ নং সনাতন শীল লেনে ধর পরিবারের অন্যতম বসতবাটির মন্দিরে। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী রথ এসে দাঁড়ায় হিদারাম ব্যানার্জি লেনে গোবিন্দলাল দত্তের ঠাকুরদালানের সামনে। মুখোমুখি হন ধর ও দত্ত বাড়ির দুই জগন্নাথ (ছবিতে যথাক্রমে বাম ও ডান দিকে)। যেন দুই বন্ধুর দেখা। হয়তো একদা আত্মীয়তা বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল দুই পরিবারে। সেই ইতিহাস এখন বিস্মৃত, রয়ে গিয়েছে প্রথাটুকু। ধর বাড়ির বর্তমান সদস্য রবীন চাঁদ ধর জানালেন, রথযাত্রা থেকে সাত দিন জগন্নাথের নিত্য বেশবদল হয়— রাজবেশ, সোনার বেশ, চতুর্ভুজ বেশ (ছবিতে বাঁ দিকে), বামন বেশ, রামচন্দ্র বেশ, পদ্মপলাশ বেশ ও কৃষ্ণ বেশ। রথের দিন জগন্নাথ পান ছাপ্পান্ন ভোগ। অতিমারিতে কাটছাঁট অনেক, তবু ১২ জুলাই রথের রশিতে ঐতিহ্যের টান অনুভূত হবে শহরে।

Advertisement

সঙ্গীত সংস্থারও শুভ-স্মরণ।

প্রাণপুরুষ

রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধ্রুপদী ঘড়ি তিনি, সময়ানুবর্তিতার, শুদ্ধতার। সেই ঘড়ি মেনেই ‘দক্ষিণী’র কোনও ক্লাস, মহড়া বা অনুষ্ঠান আজ পর্যন্ত সময়ের এক মিনিট পরে শুরু হয়নি। এ শহরে গানের স্কুল গড়ে তোলায় একক সাফল্য পেয়েছেন শুভ গুহঠাকুরতা (১৯১৮-১৯৮৯) (ছবিতে)। কোমলে কঠোরে গড়া বিদ্যুল্লতা গায়কি-ধারা ‘দক্ষিণী’র, গত পাঁচ দশকের প্রধান রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়কদের অনেকেরই ‘ইস্কুল’। পাশাপাশি বাংলার শীর্ষস্থানীয় বহু গায়কের রেকর্ড-পরিচালকও ছিলেন শুভ গুহঠাকুরতা, লিখেছেন রবীন্দ্র-সঙ্গীতের ধারা, সত্যজিৎ রায় প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। শিল্পী হতে চাননি, ছিলেন সংগঠনে নিশ্ছিদ্র শিক্ষক। আজ তাঁর জন্মদিন, সন্ধে ৬টায় দক্ষিণীর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সুদেব গুহঠাকুরতার পরিচালনায় অনুষ্ঠান। রাত ৮টায় কানাডার ‘অপার বাংলা’ সঙ্গীত সংস্থারও শুভ-স্মরণ।

ভাষা শেখা

বাংলা ভাষাতেও যে মিশে আছে প্রায় সাড়ে আট হাজার আরবি, উর্দু ও ফারসি শব্দ, এমনকি বহু অর্থের যে প্রতিশব্দও নেই, তা ক’জন বাঙালি জানেন? ধর্মীয় মেরুকরণ তাই সহজেই মিলনের পবিত্রতাকে কলুষিত করতে পারে। কখনও ভাষাগুলিকে নির্দিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে কদর্য রাজনীতি হয়, কখনও এই সব শব্দ বাতিলেরও দাবি ওঠে! কিন্তু ভাষায়-ভাষায় মেলামেশায় মর্যাদাহানি নেই, আছে সমৃদ্ধি। আর, ইতিহাস ও সাহিত্যের সূত্রে কলকাতার সঙ্গে এই সব ভাষার ঘনিষ্ঠ যোগ বিস্মৃত হলে একান্ত আপনকেই অস্বীকার করা হয়। গত এপ্রিল থেকে অনলাইন আরবি, উর্দু ও ফারসি শেখার ব্যবস্থা করেছে ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ফর অ্যাসিসট্যান্স টু পিপল’ (অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ) ও মৌলানা আজাদ কলেজ। ভাষার আয়নায় সংস্কৃতি-পাঠের নান্দীমুখ।

সহযাত্রা

শিক্ষার আলোতেই মুছে যাওয়ার কথা ছিল, তবু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই অনেক সময় বাসা বেঁধে থাকে জাতপাত, শ্রেণি, জেন্ডার, মেধাভিত্তিক অন্ধকার। বিদ্যামঠতলে বর্ষে বর্ষে দলে দলে আসা পড়ুয়ারা যাতে এই ভেদবুদ্ধির শিকার বা শিকারি কোনওটাই না হয়, সেই উদ্দেশ্যে নিজেদের কলেজে ‘ইকুয়াল অপরচুনিটি সেল’ গড়েছে রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয় (স্বশাসিত) নরেন্দ্রপুর। লক্ষ্য: ছাত্রদের যে কোনও রকম বিভেদের বিরুদ্ধে, এবং সাংবিধানিক অধিকার বিষয়ে সচেতন করে তোলা। আছে কর্মশালা, প্রাসঙ্গিক পারফরম্যান্স উপস্থাপনেরও পরিকল্পনা, আগামী ১৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় কলেজের ইউটিউব চ্যানেলে এক বক্তৃতা আয়োজনের মাধ্যমে পথ চলা শুরু করছে এই সেল। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলাদ্রি রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বলবেন ‘জেন্ডার-সংবেদী’ হওয়ার গুরুত্ব বিষয়ে।

চেনা-অচেনা

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি! দুই মেরু অঞ্চল বা সমুদ্রের গভীরে জগতের অনেকটাই অজানা। পৃথিবীতে যত বরফ আছে তার ৯১% অ্যান্টার্কটিকায়, চার-পাঁচ কিমি পুরু। মাত্র একশো বছর হল বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়েছে এই মহাদেশে, ভারত ১৯৮১ থেকে গবেষণারত। পেঙ্গুয়িন ও মেরুভল্লুক অ্যান্টার্কটিকা ও আর্কটিকের নিজস্ব প্রাণিসম্পদ; ১১ কিমি গভীর খাতে— যার মধ্যে আস্ত হিমালয় ঢুকে যায়— রয়েছে বিচিত্র প্রাণিজগৎ। মানুষের প্লাস্টিক-ব্যবহার বাড়িয়ে চলেছে সমুদ্রদূষণ। ‘পাটুলি স্ট্রিট লাইব্রেরি’ আয়োজিত এক আন্তর্জাল-অনুষ্ঠানে গত ১ জুলাই এই সব নিয়েই বললেন দুই বিজ্ঞানী— থাম্বান মেলোথ ও শমীক দাশগুপ্ত।

মাস্টারমশাই

এখন সব অলীক বইয়ে লিখেছিলেন ‘সম্ভ্রমে আর ভালোবাসায় মেশানো’ তাঁর মাস্টারমশাইয়ের কথা। তিনি নিজেও হয়ে উঠেছিলেন তেমনই মাস্টারমশাই, যাদবপুরে। গত ৩০ জুন হয়ে গেল বাংলা বিভাগের আন্তর্জালিক আয়োজন— স্মরণ: শঙ্খ ঘোষ। সেখানে সৌরীন ভট্টাচার্য ফিরলেন ইন্দিরা-হত্যার পর যাদবপুর থেকে তাঁর সঙ্গে সন্ত্রস্ত শিখ সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছনো মিছিলের স্মৃতিতে; জনচিন্তায় তাঁর নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা মনে করালেন সুকান্ত চৌধুরী। প্রাতিষ্ঠানিক অলিন্দে নয়, অন্তরালে থেকেই ছেলেমেয়েদের প্রত্যয়ী করে তুলতেন তিনি, মত শেফালী মৈত্রের। তাঁর মানবিক বৈভবকে তুলে ধরলেন অমিয় দেব, মালিনী ভট্টাচার্য, মিহির ভট্টাচার্য, স্বপন চক্রবর্তী-সহ বাংলা বিভাগে শঙ্খবাবুর সমসাময়িক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীরা। সভামুখ্য পবিত্র সরকার, বললেন উপাচার্য সুরঞ্জন দাসও।

মুখচ্ছবি

ছয় শিল্পীর আঁকা ছবি, প্রত্যেকেরই বিষয়— নারী। নারীমুখ বললে স্পষ্ট হয় আরও। তবে প্রতিটি শিল্পকৃতির রস ও রহস্য আলাদা, েসখানেই শিল্প-অভিজ্ঞতারও বৈচিত্র। কে জি সুব্রহ্মণ্যম, যোগেন চৌধুরী, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, লালুপ্রসাদ সাউ, রবীন মণ্ডল ও অরুণিমা চৌধুরী— বাংলার ছ’জন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীর কাজ নিয়ে ‘ইমামি আর্ট’ আয়োজন করেছে প্রদর্শনী ফেমিনিন ফ্যাসেটস, শুরু হয়েছে গত ২৫ জুন থেকে, চলবে সারা জুলাই মাস ধরে। তুলি ও কালির যুগলবন্দি কারও চিত্রকৃতিতে, লোকশিল্পের সঙ্গে ধ্রুপদী আঙ্গিক এসে মিশেছে কারও ছবিতে। কোনও ছবি যেন ঠিক মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের নারীর অন্দরমহলের চিত্র, আবার কোথাও জীবন ও সভ্যতার জটিল প্রাগিতিহাসকেই যেন ধারণ করেছে নারী-অবয়ব। অতিমারি-ঢেউ থাবা বসিয়েছে গ্যালারিতে গিয়ে সামনে থেকে ছবি দেখার অভিজ্ঞতায়, এ প্রদর্শনী তাই আন্তর্জালিক, দেখা যাবে ইমামি আর্ট-এর ওয়েবসাইটে। ছবিতে লালুপ্রসাদ সাউয়ের চিত্রকৃতি উওম্যান উইথ বাটারফ্লাইজ় (২০১৭)।

লোক-বঙ্গ

লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য নিয়ে ৭৭৬ পৃষ্ঠার পত্রিকা! তবু একলব্য-র (সম্পাদনা: দীপঙ্কর মল্লিক ও দেবারতি মল্লিক) সাম্প্রতিক সংখ্যার আট পাতাজোড়া সূচিপত্রটিই প্রমাণ, লোকসংস্কৃতির কত আঙ্গিক তুলে ধরার প্রয়াসী সম্পাদক ও লেখকেরা। বিষয়বিন্যাস যত্নে সাজানো, বাংলার ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, বারোমাস্যা, লোককথা, রূপকথা, লোকসঙ্গীত ও লোকভাষা নিয়ে রয়েছে একগুচ্ছ নিবন্ধ। লোকনৃত্য, লোকনাট্য, যাত্রার নানা দিক; লোকবাদ্য, তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প, পাটিশিল্প নিয়ে লেখা। এ ভাবেই ‘অঙ্কনকেন্দ্রিক’ আলপনা, পটশিল্প, জরিশিল্প; ব্রত, লোকধর্ম, লৌকিক দেবতা, মেলা গাজন, লোক-উৎসব, বিচিত্র লোকাচার ও সংস্কারও উঠে এসেছে প্রবন্ধে। দুই মলাটের মধ্যে বিচিত্র লোকায়ত বাংলার খোঁজ। ছবিতে ডোকরার কাজ, পত্রিকা থেকে।

চিন্তক

ইতিহাসবিদ শুধু মহাফেজখানার নথি ঘাঁটেন না। নিজের সময়কেও চিরে দেখতে হয় তাঁকে। দরকারে সহকর্মীকেও! ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র সে কাজটিই করতে চলেছেন আগামী ১৩ জুলাই, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা ৬টায় বড়িশা বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেন আয়োজিত আন্তর্জাল-আলোচনায় বলবেন তাঁর সদ্যপ্রয়াত সহকর্মী প্রদীপ বসুকে নিয়ে। ইতিহাসবিদের চোখে সমাজতত্ত্ববিদ? গৌতমবাবু বলছেন, গত দেড়-দুই দশক বাংলা ভাষায় অক্লান্ত লিখে গিয়েছেন প্রদীপবাবু। ভূদেব মুখোপাধ্যায়, পুরনো সাময়িকী পত্রিকাকে নতুন করে চিনিয়েছেন, অন্য দিকে ফ্রয়েড থেকে ফুকো। আধুনিকতার বর্গ এবং কুলজিকে প্রশ্নে বিদ্ধ করেছেন। মঙ্গলবারের আলোচনা তাই ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞানের গণ্ডি ছাপিয়ে বাংলায় জ্ঞানচর্চা নিয়েও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement