সে দিন যাঁরা ভিটেমাটি ছেড়ে এ পারে চলে এসেছিলেন, শুধু কি তাঁরাই আজীবন কষ্টচারা বুকের গভীরে পুঁতে রাখলেন? ক্ষত চারিয়ে গেছে উত্তর প্রজন্মেও। ভাঙা দেশ, ভগ্নহৃদয়ের উত্তরাধিকার তাঁদের মধ্যেও, যাঁদের পূর্বপুরুষের স্বপ্ন দেশভাগ প্রচণ্ড প্রত্যক্ষ আঘাতে ভাঙেনি। সাত দশক পরেও বাঙালির বাঙালিত্বে সেই কাঁটাতারের কষ্ট। সেই যন্ত্রণাই জন্ম দিয়েছে সংস্কৃতির হিরেপান্না। শচীনকর্তার গান, ঋত্বিকের ছবি, দেবীপ্রসাদের ভাস্কর্য, ঢাকা কালীবাড়ির রাস্তা, জীবনানন্দের কবিতা, ফুটবল, লোকগল্প, প্রবচন-উচ্চারণে মিলেমিশে যে বাঙালি সত্তার নির্মাণ, তার খাঁজে-ভাঁজে ১৯৪৭।
পাঁচ চিত্রশিল্পীর মননে ও সৃজনে দেশভাগের অবয়ব ফুটে উঠেছে দ্য লেগাসি অব লস: পারস্পেকটিভস অন দ্য পার্টিশন অব বেঙ্গল প্রদর্শনীতে। ‘কলকাতা পার্টিশন মিউজ়িয়াম’ ও ‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’(কেসিসি)-র উদ্যোগে, ইমামি ফাউন্ডেশন ও টাটা স্টিল-এর সহযোগে আয়োজিত প্রকল্পটির ভাবনা ও রূপায়ণে রাজশ্রী মুখোপাধ্যায়। ও পার বাংলায় ফেলে আসা ‘ঘর’ দেখতে গিয়ে লেখা ডায়েরিকে সামনে রেখে, মিশ্র মাধ্যমে সুখদুঃখের স্মৃতি গড়েছেন পলা সেনগুপ্ত— নকশিকাঁথার ফোঁড়ে, কাঠের আলমারিতে, অ্যাপ্লিকে, উডব্লক প্রিন্টিংয়ে ভুরভুরে বাংলার পরিবারজীবনের স্বাদ-গন্ধ। বিনায়ক ভট্টাচার্য থাকতেন সীমান্তের কাছে অশোকনগরে। সাদা-কালো গ্রাফিক প্রিন্ট, অলঙ্করণ, জলরং-ছবি, স্থিরচিত্র, ভিডিয়োয় তাঁর সৃষ্টি প্রশ্ন তোলে কাঁটাতারের যৌক্তিকতায়। দুই দেশকে কেবলই ‘তফাৎ যাও’ বলে শাসিয়ে রাখে কাঁটার বেড়া বরাবর সীমান্তরক্ষীর বুটের শব্দ, আর সব ঝুটো প্রমাণ করে দুই দেশের ভূগোল বেয়ে ইছামতী বয়ে যায়। দিলীপ মিত্রের চিত্রকলা, স্কেচবই, ডায়েরি ধরেছে কলোনি-জীবনের দুরন্ত ঘূর্ণি। চট্টগ্রাম গ্রন্থাগার, বরিশাল কলোনি— পশ্চিমের নতুন জীবনে পরম মমতায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা যেন হারানো পুববাংলার।
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, অমৃতা সেনের পরিবার এই প্রত্যক্ষ কষ্টের শরিক নন, তবু তাঁদের সৃষ্টিতেও লেগেছে দেশভাগের আঁচ। ছাপরার রেলকলোনিতে বড় হয়েছেন দেবাশিস; বার বার ঠাঁই বদলের সঙ্গে তাই মেলাতে পারেন শরণার্থীর জীবনকে। অতীতকে ভুলতে না পারার কঠোর বাস্তবকে পেতে দিয়েছেন নরম কাপড়ের বুনন। বুক আর্ট-এ দেশভাগকে প্রকাশ করেছেন অমৃতা সেন। ঋত্বিক ঘটকের ছবির দৃশ্য, বিশেষত কোমল গান্ধার-এর দৃশ্যকল্প (ছবিতে) উঠে এসেছে তাঁর ছবির বইয়ে। অ্যাকর্ডিয়নের বেলোর বিস্তারের মতো ছড়িয়ে থাকে অভিনব এই বই, আঁকা-লেখা থেকে শুরু করে এই বইয়ের ‘হয়ে ওঠা’র প্রতিটি উপাদান শিল্পীর হাতে গড়া। বাঙালির খিদে, রক্ত, ঘামে ছড়িয়ে থাকা দেশ হারানোর স্মৃতি উজাড় করেই তাঁর এই শিল্পকৃতি, নাম দেশভাগ/মনভাগ। কেসিসি-তে এই প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ১৭ অগস্ট, চলবে ২৯ অবধি, ১১টা-৬টা। শুরুর দিন আলোচনায় অংশ নিলেন সুগত বসু, গৌতম ঘোষ, ছিলেন শুভাপ্রসন্ন-সহ বিশিষ্টজন।
সম্প্রীতির কেরি
১৭ অগস্ট ছিল উইলিয়াম কেরির (১৭৬১-১৮৩৪) (ছবিতে) জন্মদিন। কেরি বাঙালিকে দিয়েছেন বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ বাইবেল; কথোপকথন, ইতিহাসমালা, বাংলা ব্যাকরণ অভিধান-সহ শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ সংস্কার, পত্রিকা ও ছাপাখানার ইতিহাসেও স্মরণীয় তাঁর কীর্তি। এ বছর তাঁর জন্মের ২৬০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করছে দক্ষিণ কলকাতার ‘সম্প্রীতি আকাদেমি’, আগামী ২৫ অগস্ট, বুধবার, বিকেল ৫টায়— বৌবাজারের বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভায়। আলোচনা হবে ‘বাংলায় বাইবেল ও বঙ্গপ্রেমিক কেরি’ বিষয়ে, প্রকাশ পাবে বাইবেল নাট্যসঞ্চয় নামে বই। ‘নান্দনিক’ প্রকাশিত, সুরঞ্জন মিদ্দে সম্পাদিত এই বইয়ে আছে গত একশো বছরে লেখা বাইবেল বিষয়ক নাটক। অনূদিত নয়— বাংলায় রচিত, মৌলিক। আছে রূপক নাট্য, কাব্যনাট্য, নৃত্যনাট্য, মহিলা নাট্য, শ্রুতিনাট্য, গুড ফ্রাইডের অশ্রু-আলেখ্য, বিশেষ সংযোজন রবীন্দ্রনাথের শিশুতীর্থ-ও।
সাহিত্যপ্রাণ
প্রচারবিমুখতা ছিল তাঁর স্ব-ভাব। গড়পড়তা মানুষের প্রাত্যহিক লড়াই আর জীবনের কথা জুড়ে থাকত আলপনা ঘোষের (১৯৪৩-২০২১) লেখায়। পালি ভাষার সুপণ্ডিত বেণীমাধব বড়ুয়ার দৌহিত্রী, জন্ম কাঁথিতে, জীবনের বেশির ভাগটাই কেটেছে আসানসোল শিল্পাঞ্চলে, বাংলা-বিহারের সীমান্তশহর রূপনারায়ণপুরে। সাহিত্যচর্চাই ছিল প্রাণ। ছোটগল্প ও উপন্যাস প্রিয় পরিসর, আবার তাঁর কবিতাকে সুরে বেঁধেছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়— ‘ওঠো হে’। ইটালীয় থেকে বাংলায় গদ্যানুবাদ করেছেন দান্তে-র মহাকাব্য লা দিভিনা কম্মেদিয়া, প্রথম পর্ব নরক প্রকাশিত যাদবপুর ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে। শেষ জীবন কেটেছে এ শহরেই, চলে গেলেন গত ৫ অগস্ট।
নাদ উপাসনা
নাদ এক আদিম কম্পন। নাদবিন্দু উপনিষদ মতে মহাবিশ্ব অবিরাম কম্পমান, এই কম্পনকেই কল্পনা করা হয়েছে নাদ বা এক মহাধ্বনি হিসাবে। ‘নাদ উপাসনা’র উদ্দেশ্য— সঙ্গীত কী ভাবে অভিনয়শিল্পীর শরীর প্রভাবিত করে, তার চেতনা উন্নত করে জ্ঞান আহরণে তাকে উদ্বুদ্ধ করে, সেই সন্ধান। এ নিয়ে দীর্ঘ কাল কাজ করছেন ‘কসবা অর্ঘ্য’ নাট্যদলের নির্দেশক মণীশ মিত্র, উত্তর খুঁজছেন দার্শনিক গ্রন্থে, সুফি গায়কদের রচনায়, গবেষণা-তথ্যে। সেই সন্ধানই এ বার রূপ পাচ্ছে কর্মশালায়, সঙ্গীত-অভিনয়-নৃত্য-মূকাভিনয় শিল্পীদের নিয়ে। পূর্বাঞ্চলীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (ইজ়েডসিসি)-র সহযোগে আয়োজিত তিন দিনের কর্মশালা শুরু হয়েছে গত কাল, ইজ়েডসিসি-তেই, চলবে আগামী কাল, ২২ অগস্ট পর্যন্ত।
লুম-কথা
অতিমারিতে বিপর্যস্ত লোকশিল্প। মেলা নেই, গ্রামীণ শিল্পীরা শিল্পসামগ্রী পৌঁছতে পারছেন না শহরে, ক্রেতা বা রসজ্ঞের কাছে। এঁদের, বিশেষত বাংলার তাঁতশিল্পীদের কথা মাথায় রেখেছে শিল্প সংস্থা ‘হেলো হেরিটেজ’। নজরুলতীর্থে হেলো হেরিটেজ আর্ট সেন্টার-এ তাদের নতুন শাখা ‘কৃষ্টি’-র পথ চলা শুরু হয়েছে গত ৮ অগস্ট, বঙ্গীয় ও জনজাতি আঙ্গিকের হ্যান্ডলুম প্রদর্শনী ‘লুম-কথা’ শুরুর মাধ্যমে। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূম, বিষ্ণুপুর অঞ্চলের তাঁতবস্ত্রশিল্পীদের উৎসাহ দিতেই এই প্রদর্শনী; তাঁতের সঙ্গে সিল্ক, তসর, বালুচরি, মটকা, ঘিচা, মলমল, খেস-এর সম্ভার, আছে পাটের ব্যাগ থেকে মুখোশ, অলঙ্কার, বিবিধ হস্তশিল্প। প্রদর্শনী ৮ অক্টোবর পর্যন্ত— সকাল সাড়ে ১১টা থেকে সন্ধে সাড়ে ৭টা।
মর্মসন্ধানী
ভারতকে চেনেন নিজের হাতের তালুর মতোই। গবেষণার জন্য বর্ধমানের ধান-চালের বাজারের খুঁটিনাটি থেকে এ রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের পরিবর্তিত শ্রেণিবিন্যাসে নতুন আলোকপাত। ক্ষমতার ভিত্তি যে তখন জমির মালিকানা নয়, সরে গেছে চালকল বা রাজনৈতিক প্রতিপত্তির সুযোগে বিভিন্ন ব্যবসাক্ষেত্রে, তথ্য দিয়ে বলেছেন এই শতকের গোড়ার দিকে। ধ্রুপদী বামপন্থী ব্যাখ্যায় একে কী ভাবে দেখা যাবে, ভেবে তাঁর বাম বন্ধুরা ধন্দে পড়ে গেলেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উন্নয়নের অর্থনীতির ইমেরিটাস প্রফেসর বারবারা হ্যারিস হোয়াইট কিন্তু অক্লান্ত। কখনও তামিলনাড়ু, কখনও অরুণাচল প্রদেশ, উন্নয়নের মর্মবস্তুর সন্ধানী তিনি। ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা-র প্রতিষ্ঠা দিবসের এ বারের বক্তা তিনি, বলবেন ‘দ্য মেটাবলিক রিফট অ্যান্ড ইটস সোশ্যাল ইমপ্লিকেশনস ফর আরবান ইন্ডিয়া’ নিয়ে। আন্তর্জালে, ২৭ অগস্ট, শুক্রবার, দুপুর সাড়ে তিনটেয়।
ঐতিহ্যের অর্থ
নিঝুম দুপুরে হাতুড়ির শব্দ। ওই বুঝি ভাঙা পড়ল আর একটা পুরনো বাড়ি। ভেঙে ফেলা বাড়ির সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তির যোগ থাকলেই তা ঐতিহ্যশালী ধরা হবে, নতুবা নয়, এই ধারণা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে ‘ক্যালকাটা আর্কিটেকচারাল লেগাসি’, আন্তর্জাল-আলোচনায়, গত ১৩ অগস্ট। উত্তর ও মধ্য কলকাতার তুলনায় দক্ষিণ কলকাতার ল্যান্সডাউন (ছবিতে), বালিগঞ্জ পার্ক ইত্যাদি এলাকার স্থাপত্য-ঐতিহ্য সংরক্ষণ নিয়ে সাধারণ্যে উৎসাহ কম, মত লেখক অমিত চৌধুরীর। অথচ উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ায় তৈরি, এ শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের এই বাড়িগুলিও ঐতিহ্যের অংশ। কলকাতার গড়ে ওঠার সঙ্গে জড়িয়ে পাড়াও, দরকার তাই গাছ-মাঠ-পুকুর সব নিয়ে ‘ঐতিহ্যশালী অঞ্চল’ রক্ষা। নোবেলজয়ী এস্থার ডুফলো বললেন ঐতিহ্য সংরক্ষণের অর্থনৈতিক সুফল ও সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাজে তার ব্যবহার নিয়ে; স্থানীয় মানুষের যোগে শ্রীলঙ্কার গল দুর্গের স্থাপত্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে বললেন স্থপতি চান্না দাসওয়াত্তে— এ জিনিস কাজে দেবে কলকাতারও। মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যসচিব ভি রঙ্গনাথন ঐতিহ্য সংরক্ষণ আইন প্রসঙ্গে তুলে ধরলেন কলকাতা কর্পোরেশনের এই সংক্রান্ত আইনের কথা।
জহরত
এর আগে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল এতই, নবরূপে ‘কালেক্টর্স এডিশন’ রূপে ফেরাতে হয়েছিল তাকে। এ বার জহর রায়কে নিয়ে শতবর্ষে জহর রায় সংখ্যা করেছে চৌরঙ্গী পত্রিকা (সাধারণ সম্পাদক: শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়)। চলচ্চিত্র-জগতের নক্ষত্রদের নিয়ে সামগ্রিক আর্কাইভের অভাব বাংলায়, ২০১৯-এ একশো-পেরনো ‘বাংলার চ্যাপলিন’ জহর রায়ের কীর্তিকে দু’মলাটের মধ্যে ধরার এ প্রয়াস সেখানে শংসার্হ, অতি জরুরিও বটে। তিনশোরও বেশি পৃষ্ঠায় সাজানো এ পত্রিকা বিন্যস্ত কয়েকটি অংশে— আছে শিল্পীর নিজের কথা ও হাস্যকৌতুক, সাক্ষাৎকার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণলেখ, সত্যজিৎ-মাধবী-সাবিত্রী-বিকাশ রায়-অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়-সৌম্যেন্দু রায়ের মতো বিশিষ্টজনের লেখা, পুত্র-কন্যা ও আপনজনের অনুভব, শিল্পীর জীবনপঞ্জি, নাট্য ও বেতার-নাট্যপঞ্জি, চলচ্চিত্রপঞ্জি। আছে একগুচ্ছ স্মৃতিময় ছবিও। সঙ্গের প্রতিকৃতিটি পত্রিকা থেকে, নিলয় কুমার বসাকের আঁকা।
যত হাসি, তত...
স্বস্তি ফিরিছে বঙ্গে। কোভিড-রাশ হাল্কা হচ্ছে, ছাড়ের বিষ্টি নামছে। জাদুঘর, মনুমেন্ট, গ্যালারি, পার্ক খুলছে আবার। মুক্তি সিনেমাহলেরও। টিকার দুই ডোজ়ের কাগজ দেখিয়ে বা করোনার টেস্ট করিয়ে বঙ্গবাসী ফুরফুর পাহাড়-সমুদ্রে। মাস্ক ছাড়া ফচকে হাসি, পিচিক পানের পিক আর গব্বরসম সাহস দেখে আশপাশে কাঁটা কাঁটা গোল্লা গোল্লা আণুবীক্ষণিক জীবরা নড়েচড়ে বসে যদি? শঙ্কার কাঁটা: মহালয়াতেই ফের অ্যাম্বুল্যান্সের ঘণ্টি শোনা যাবে না তো?