Kolkatar Korcha

কলকাতার কড়চা: যেন পিতৃবিয়োগের শোক

গান্ধী-হত্যার পরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকার সমস্ত সর্বজনীন অনুষ্ঠান বাতিল করে। বন্ধ করে দেওয়া হয় বাজার, অফিস-কাছারি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৭:৫৬
Share:

পর দিন তার বড় ছেলে ‘লক্ষ্মী’র শ্রাদ্ধ। তাই সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে বর্মন স্ট্রিটের মোড়ের ফুলপট্টিতে চন্দ্রর দোকান থেকে কিছু ফুল-মালা কিনছিলেন অর্থনীতি নৃতত্ত্ব ইতিহাসের বিশিষ্ট পণ্ডিত, লেখক-সম্পাদক অতুল সুর। ফুল আর মালাগুলো শালপাতায় বেঁধে দেওয়ার ফাঁকে ভাগ্যহত পিতাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন বহু দিনের পূর্বপরিচিত ফুল বিক্রেতা। এমন সময় ঘটল এক অভাবনীয় ব্যাপার। রাস্তার সমস্ত লোক ভয়ার্ত হয়ে যে যে দিকে পারছে ছুটতে লাগল। ঝটপট বন্ধ হতে লাগল সব দোকানের ঝাঁপ। অতুলবাবু শহরে আবার দাঙ্গা লাগার আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একটা রিকশা। রিকশাচালকও পালাতেই যাচ্ছিলেন। অতুলবাবু সেই রিকশাতেই উঠে বললেন, “চলো বাগবাজার!” রিকশাচালক সওয়ারি নিয়ে প্রাণপণ ছুট। বেশ খানিক দূর যাওয়ার পর তিনি চালককে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? চালক বললেন, “বাবুজি, আপ সুনা নেহি, গান্ধীজি কা নিধন হো গয়া।”

Advertisement

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিকেলে, সুদূর দিল্লির বিড়লা হাউসে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনাটির আকস্মিকতায় আরও বড় গন্ডগোলের আশঙ্কায় সিঁটিয়ে ছিল সদ্য দাঙ্গার ক্ষত থেকে উঠে আসা কলকাতা। মাত্র কয়েক মাস আগে কলকাতায় উন্মত্ত হানাহানির মুখে অহিংসার বার্তাবাহী মহাত্মার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার হেমন্ত সেনগুপ্ত খবর পেয়েই হাজরার এক সংবর্ধনা মঞ্চ ছেড়ে দৌড়ে গিয়েছিলেন কাছের ভবানীপুর থানায়— শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

কোনও অমঙ্গলের পুনরাবৃত্তি হয়নি সে দিন, বা তার পরেও। অতুলবাবুর ছেলের শ্রাদ্ধ পর দিন সম্পন্ন হয়েছিল নির্বিঘ্নে। গান্ধী-হত্যার পরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকার সমস্ত সর্বজনীন অনুষ্ঠান বাতিল করে। বন্ধ করে দেওয়া হয় বাজার, অফিস-কাছারি। ঘোষিত হয় তেরো দিনের জাতীয় শোক। ৩১ জানুয়ারি সারা ভারতের সঙ্গে কলকাতাতেও পালিত হল স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। মহাত্মার সম্মানে শহর পরিক্রমা করল শোকসন্তপ্ত শুভ্রবস্ত্রাবৃত শহরবাসীর দীর্ঘ মৌনী মিছিল। যমুনাতীরে বাপুর অন্ত্যেষ্টির নির্ধারিত সময়ে মানুষের ঢল নামে কলকাতার কেওড়াতলা ঘাট-সহ (ছবিতে) শহরের নদীতীরবর্তী বিভিন্ন ঘাটে। সনাতন প্রথা মেনে গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে জাতির জনকের উদ্দেশে শেষ শ্রদ্ধা জানায় কলকাতা, যে শহরের উপকণ্ঠেই ছিল তাঁর স্বঘোষিত ‘সেকেন্ড হোম’, সোদপুর আশ্রম। ৩১ জানুয়ারি, ১৯৪৮ আনন্দবাজার পত্রিকা-র স্তম্ভিত শিরোনাম ছিল ‘মহাত্মা গান্ধী নিহত’, আর পিতৃবিয়োগের বিধুর সুরে ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮-এর সম্পাদকীয়তে লেখা: “আজীবন অহিংসার সাধক চরম হিংসার সম্মুখে আত্মবলি দিয়াছেন। মহাগুরু-নিপাতের শোক ও অমঙ্গলাশঙ্কা ভারতবর্ষকে পরিব্যাপ্ত করিয়াছে।” আর একটি ৩০ জানুয়ারির মুখোমুখি এই মহানগর।

Advertisement

১৭৫ বছরে

সমাজ সংস্কার ও শিক্ষকতার কাজের পাশে সাহিত্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা শিবনাথ শাস্ত্রীর (১৮৪৭-১৯১৯) (ছবিতে)। ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, কবি, শিশুসাহিত্যিক হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর পরিচয় স্বল্পজ্ঞাত হলেও, তাঁর সৃষ্টি-সম্ভারের কলেবর নেহাত ছোট নয়। পত্রিকা-সম্পাদনের জগতে তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কথাও সবিশেষ উল্লেখ্য। তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাস যুগান্তর-এর প্রেরণায় গড়ে উঠেছিল যুগান্তর গোষ্ঠী, ভারতে বিপ্লবী-আন্দোলনের ইতিহাসে যার অবদান অনস্বীকার্য। শিবনাথ শাস্ত্রীর জন্মের ১৭৫ বছরে তাঁর সাহিত্যকীর্তির স্মরণ করছে রামমোহন রায় ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজ়, ‘সাহিত্যিক শিবনাথ: বঙ্গসাহিত্যে যুগান্তর’ শীর্ষক এক আলোচনাসভায়। ৩১ জানুয়ারি, শিবনাথ শাস্ত্রীর জন্মদিনের সন্ধ্যায় সেখানে বলবেন অসিতাভ দাস ও পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। শোনা যাবে ইনস্টিটিউট-এর ইউটিউব চ্যানেলে।

বরেণ্য

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রদলের অন্যতম, পরে হয়েছিলেন প্রখ্যাত ভূ-বিজ্ঞানী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎস প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ পরিচালনার দায়ভারও দীর্ঘ কাল দক্ষতার সঙ্গে বহন করেছেন পরিবেশবিজ্ঞান বিশারদ অধ্যাপক আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়। জীবনের শেষ দিনটিতেও তিনি ছিলেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনন্দদেববাবু যুক্ত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যাসাগর স্মারক সমিতির পরিচালনাতেও। অতিমারিকালে গত বছর ৮ অক্টোবর প্রয়াত হন বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ। আজ বিকাল ৪টায় বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ তাঁকে স্মরণ করবে, পরিষদের ইন্দুমতী সভাগৃহে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণসভা।

কবিতায় তিনি

তাঁর দেশপ্রেমের অদম্য প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ নজরুল দ্বিজেন্দ্রলাল নবীনচন্দ্রের কবিতাও। বাল্যবন্ধু দিলীপকুমার রায়ের লেখায় আছে স্বামী বিবেকানন্দের কালী দ্য মাদার কবিতা আবৃত্তিরত কিশোর সুভাষচন্দ্র বসুর কথা। কাণ্ডারী হুঁশিয়ার বা বন্দী বীর কবিতা উদ্ধৃত করতেন দৃপ্ত কণ্ঠে। ১৯২৯-এর এক ভাষণে বলেছিলেন স্বদেশি আন্দোলনে কবি ও লেখকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। কবিতা প্রিয় ছিল নেতাজির, সেই ভাবনা থেকে এ বার তাঁর জন্মের ১২৫ বছরে তাঁকে নিয়ে লেখা ১২৫টি কবিতার বই দেশনায়ক: কবিতার্ঘ্য (প্রকা: জ্ঞানদীপ) দেবজ্যোতিনারায়ণ রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল সম্প্রতি। বনফুল অমিয় চক্রবর্তী অচিন্ত্যকুমার প্রেমেন্দ্র মিত্র বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নীরেন্দ্রনাথ অলোকরঞ্জন সুনীল নবনীতা কৃষ্ণা বসু থেকে শুরু করে এই সময় ও প্রজন্মের কবিদেরও সুভাষিত শ্রদ্ধাঞ্জলি।

স্বাদ-স্মৃতি

কলকাতার রসনা-মানচিত্রে বৌবাজারের মানেকজি রুস্তমজি ধর্মশালা পার্সি খাবারের উল্লেখযোগ্য গন্তব্য। পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করাই ধর্মশালার মূল উদ্দেশ্য হলেও, পার্সি খাবার চেখে দেখতে সকলেই যেতে পারেন এখানে। গত প্রায় এক দশক ধরে সেখানে পার্সি খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে ছিলেন দারা ও মেহের হানসোটিয়া। তাঁদের তৈরি আকুরি, ধানশাক, সাল্লি চিকেন, পত্রানি মচ্ছি, লাগান-নু কাস্টার্ডের স্বাদ নিতে আসতেন অনেকেই। অতিথিবৎসল এই পার্সি দম্পতি সম্প্রতি কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে ফিরলেন আমদাবাদ। ধর্মশালায় পার্সি খাবারের পরম্পরা চালু থাকবে, জানা গিয়েছে। আর শহরের খাদ্যবিলাসীদের মনে জেগে থাকবে তাঁদের উষ্ণ আতিথ্য-স্মৃতি।

মজারু

জীবন থেকে কি হাসি মুছে যাচ্ছে? হাস্যরস কি বিপন্ন এক প্রজাতি, সাহিত্যে-শিল্পে গড়িয়ে পড়ার আগে যাকে রাজনৈতিক সামাজিক লৈঙ্গিক ঔচিত্যবোধ মনে রাখতে হয় প্রতি পদে? এই ভাবনা থেকেই অন্তরীপ পত্রিকা প্রকাশ করেছে ‘বিশেষ হাস্যরস সংখ্যা’ (সংখ্যা সম্পাদক: সৌরভ মুখোপাধ্যায়)। এক গুচ্ছ ছোটগল্প পদ্য প্রবন্ধ নাটক— সবই হাসির, হাস্যরসাশ্রয়ী। আমন্ত্রিত লেখা মাত্র কয়েকটি, অধিকাংশ লেখাই জায়গা করে নিয়েছে ‘উৎকর্ষের জোরে’, জানাচ্ছেন সম্পাদক। নরনারীর প্রেমজনিত বিভ্রাট, দাম্পত্য বিড়ম্বনা, লেখালিখি-জগতের কৌতুক আদি চর্চিত বিষয়ের পাশে ‘রাজনৈতিক স্যাটায়ার, কর্পোরেট বিদূষণ, বিখ্যাত কবিতার প্যারডি থেকে মজারু ননসেন্স রাইম’— ‘বিবিধ বিচিত্রগামী হাস্যরসের ধারা।’ এই সময়ে খুব জরুরি ছিল।

খেলায় ফেরা

অতিমারির ঘাত সয়ে ফেরার লড়াই এখন। চিন্তিত অভিভাবকেরা, দু’বছর ব্যাপী কোভিড-লকডাউন-বিধিনিষেধের জেরে সন্তানের শারীরিক-মানসিক বিপর্যয় দেখেছেন, অথচ সুরাহা অধরা। মা-বাবার সতত অনুসন্ধান এখন সন্তানের ‘ইমিউনিটি’ বা অনাক্রম্যতা ঘিরে। শুধু রোগ প্রতিরোধ নয়, মানসিক রোগের হাত থেকে নিস্তার ও সামাজিক সংবেদনের পুনঃপ্রতিষ্ঠাও জরুরি। এই প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা খেলাধুলার, তবে ‘স্ক্রিন স্পোর্টস’ নয়, চাই প্রাঙ্গণ-ক্রীড়া— এক সঙ্গে খেলা (ছবিতে), ছুটে বেড়ানো, ধুলো মাখা, বন্ধুর সঙ্গে খুনসুটিতে হাত-পা চালানো। প্রাঙ্গণ-ক্রীড়াই এই প্রজন্মকে বেড়ে ওঠার সুষ্ঠু পরিবেশ দিতে পারে, দিতে পারে ‘ইমিউনিটি’ও। অতিমারি-উত্তর পৃথিবীতে মাঠে-ময়দানে খেলাধুলার নবজাগরণ নিয়ে সম্প্রতি আলোচনার আয়োজন করেছিল অশোকনগর আনন্দধারা, ‘প্রাঙ্গণ-ক্রীড়ার নবজাগরণ ও ইমিউনিটি-প্রত্যাশী অভিভাবকদের কর্তব্য’ বিষয়ে সেখানে বললেন বহরমপুর ইউনিয়ন ক্রিশ্চান ট্রেনিং কলেজের শিক্ষিকা, ক্রীড়াবিজ্ঞান গবেষক পৌলমী ঘোষ। ‘অশোকনগর আনন্দধারা’ ইউটিউব চ্যানেলে বক্তৃতাটি শোনা যাচ্ছে।

অন্তরালে

সিলেটের সঙ্গীতশিক্ষক প্রাণেশ দাস পাঁচ বছরের শিশুর মধ্যে দেখেছিলেন সঙ্গীতময় ভবিষ্যৎ। উত্তরকালে সেই শিশুই রমা দাস পুরকায়স্থ (ছবিতে), একাদিক্রমে ছাব্বিশ বছর অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-তে রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী পরিবেশনের পরে বিবাহোত্তর সংসারজীবনে খুঁজে নিয়েছিলেন অন্যতর সুর। ষোলো বছর বয়সে আকাশবাণীতে প্রথম গান গাওয়া রমা ঘোষ নামে, ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত এইচএমভি ডিস্কের দু’খানি গান— ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ আর ‘উতল-ধারা বাদল ঝরে’। দক্ষতা ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তের গানেও। অনাদি ঘোষ দস্তিদার, আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গায়ক ও প্রশিক্ষক, ‘গীতবিতান’ সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানও আস্থা রেখেছিলেন তাঁর উপর, স্নেহধন্য ছিলেন সুচিত্রা মিত্র নীলিমা সেন সুমিত্রা সেনেরও। প্রচারবিমুখ রমা বিয়ের পর আসানসোলে থিতু হন, বাড়ির গানের ইস্কুল ‘গীততীর্থ’-তে তৈরি করেছেন বহু ছাত্রছাত্রীকে। নিজের সুকীর্তিত অতীতকে অন্তরালে রেখে কলকাতাতেই প্রয়াত হলেন গত ১৪ জানুয়ারি, তিরাশি বছর বয়সে।

অন অফ

অতিমারি এসে একটা শব্দের মানে বুঝিয়েছে, ‘অনলাইন’। ইস্কুলের ক্লাস থেকে গুরুগম্ভীর বক্তৃতা-ভাষণ, বই প্রকাশ— সবই এখন অনলাইন। কনে এক শহরে, বর অন্যত্র, কিংবা বর-কনে এক জায়গায়, নিমন্ত্রিতরা অন্যত্র, লকডাউন-বিধিনিষেধ পর্বে এই অবস্থায় বিয়েও হয়েছে অনলাইন! অবস্থা এমনই, কোনও উদ্যোগের কথা শুনলে লোকে আগে জিজ্ঞেস করে, কী ভাবে হবে, অনলাইন না অফলাইন? যা ছিল সহজ স্বাভাবিক ও অভিপ্রেত, তা-ই এখন হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘অফ’, মানে বেলাইন। কী কাণ্ড!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement