Kolkatar Korcha

কলকাতা কড়চা: মুক্ত মনের সন্ধানী শিল্পী

অবনীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, ভারতীয় শিল্পকলা তাঁর স্বরূপের সন্ধান করুক। চেয়েছিলেন, সেই চর্চা হোক মুক্ত মন নিয়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২১ ০৯:৩৮
Share:

আরব্য কাহিনির কাজু-কিশমিশ বিক্রেতার প্রতীকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ট্রাঙ্ক মাথায় রুটি-কেক বিক্রেতা।

শিল্প চর্চা থেকে শুরু করে সাহিত্য রচনার বিবিধ পর্যায়, সর্বত্রই তাঁর মুক্ত মানসিকতার ছোঁয়া সোনা ফলিয়েছে। সে কারণেই, ১৯৩০-এ যখন আরব্য রজনী চিত্রমালা আঁকলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তখন দেখা গেল এক অপূর্ব ব্যাপার— আরব্য রজনীর ছবিতে হাজির সে কালের কলকাতা! ‘কলোনিয়াল’ কলকাতাই আরব্য কাহিনির ঘটনাস্থল যেন। ছবির অন্দরে আরব বানিয়াদের প্রতীকে মিশল ইউনিয়ন জ্যাক, আরব্য কাহিনির কাজু-কিশমিশ বিক্রেতার প্রতীকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ট্রাঙ্ক মাথায় রুটি-কেক বিক্রেতা (ছবিতে)। সায়েব-মেমদের খানাপিনা, দ্বারকানাথের ‘কার এন্ড টেগোর’ কোম্পানির সাইনবোর্ড, চিৎপুরের ঘরবাড়ি মায় দর্জির ‘সিঙ্গার’ সেলাই মেশিনও! সব ছবির সঙ্গেই কিন্তু আরব্য রজনীর কাহিনিসূত্র ছিল অটুট। শিল্পগুরুর অভিনব ভাবনায় আরব্য রজনীর ছবিতে তৈরি হল এক আশ্চর্য ‘হেটেরোটোপিয়া’-র আঙ্গিক।

Advertisement

ভারতশিল্পে আধুনিকতার সন্ধানে তিনিই পুরোধা, নানা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়েই তাকে দেখিয়েছেন উত্তর-আধুনিকতার দিশাও। ইংরেজ মানসিকতার শিক্ষানীতি যখন মনে করিয়ে দিতে চাইত ভারতের নিজস্ব কোনও শিল্প-ঐতিহ্য নেই, সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ প্রয়াসী হলেন ভারতশিল্পকে প্রাচ্যমুখী করে তোলার। চেয়েছিলেন, এ ভাবেই ভারতীয় শিল্পকলা তাঁর স্বরূপের সন্ধান করুক। চেয়েছিলেন, সেই চর্চা হোক মুক্ত মন নিয়ে। তাই ভারতীয় কলা শিল্পকে আবার শুধু প্রাচ্যভাবনার আঙ্গিকেও বেঁধে রাখলেন না, তৈরি করলেন নব দর্শন।

এই চিত্রমালা শেষ করার পরে তিনি মেতে উঠেছিলেন কাঠকুটো দিয়ে ‘কুটুম কাটাম’ বানাতে। কুটুম কাটামের মধ্যে তৈরি করেছিলেন ভাস্কর্যেরও এক নতুন ভাষা, এ দেশের মাটিতে প্রথম ‘ফাউন্ড অবজেক্ট’ দিয়ে তৈরি ‘অ্যাসেমব্লিজ়’ ভাস্কর্যের দুর্দান্ত উদাহরণ। এক দিকে চলল কুটুম কাটাম বানানো, অন্য দিকে শুরু করলেন রামায়ণনির্ভর যাত্রা পালা লিখতে। দেখা গেল, চেনা ছকের সাহিত্য রচনার সঙ্গেও এই রচনাগুলিকে ঠিক মেলানো যাচ্ছে না। যে কারণে খুদ্দুর যাত্রা-র মতো রামায়ণের পালায় আমরা দেখলাম দেবতারা ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন, পালার কুশীলবেরা গ্রামোফোন রেকর্ড শোনে, রাক্ষসীরা ঘড়িতে অ্যালার্ম দেয়, শূর্পণখা হাই হিল চপ্পল পরে। আর ইলাস্ট্রেশন-এ এসে দেখা যায়, তিনি এই পালার ছবি তৈরি করছেন প্রিন্টেড মেটিরিয়াল কেটে কেটে। সমকালীন বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে বিশ্বযুদ্ধের ছবি, সবই হয়ে উঠেছে রামায়ণের ছবির পরিপূরক। সব মিলিয়ে এই ছবি-সাঁটা খাতাকে বলা যেতে পারে এ দেশে তৈরি প্রথম ‘আর্টিস্ট বুক’ ও ‘পপ আর্ট’-এর নিদর্শন। বিশ্বশিল্প তখনও এমনতরো রাস্তা দেখেনি। এ ভাবেই ভারতীয় শিল্পকলাকে মুক্ত মনে আধুনিকতা তথা উত্তর-আধুনিকতার পথে এগিয়ে যাওয়ার পথটি দেখিয়েছেন তিনি। আজ, ৭ অগস্ট তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্তির দিনে সে কথা বিশেষ করে মনে রাখার।

Advertisement

বাঘে-মানুষে

কালীঘাটের পট।

পৃথিবীতে নয় প্রজাতির বাঘের মধ্যে তিনটি বিলুপ্ত, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার-এর অবস্থাই যা একটু ভাল। বিশেষজ্ঞ মত: এখন ভারতে বাঘের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি। পাহাড় থেকে সাগর, বিভিন্ন ভৌগোলিক প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে বাঘ। আলাদা করে বলতে হয় সুন্দরবনের কথা, যার মধ্যে একদা পড়ত কলকাতাও। এই ‘নৈকট্য’ হেতুই হয়তো বাঘে-মানুষে এত সংযোগ ও সংঘর্ষ, তা উঠে এসেছে আমাদের সংস্কৃতি-পরিসরে, কালীঘাটের পটে (ছবিতে)। গত ২৯ জুলাই বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবস উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা আয়োজিত আন্তর্জাল-আলোচনায় পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী ও শিলাদিত্য চৌধুরী বললেন বাঘের শিকার ধরা, শাবকদের প্রতিপালন ও সামাজিক আচরণ নিয়ে। দেখা যাবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর ফেসবুক পেজে।

নীরবে

উস্তাদ আলি আকবর খানের কাছে সরোদের তালিম। অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে মার্গদর্শন, আলি আকবর কলেজ-এর সম্পাদিকা, ‘বাবা আলাউদ্দিন স্মারক সমিতি’র কর্ণধার ছিলেন উমা গুহ (১৯৩২-২০২১)। মঞ্চ ও খ্যাতির হাতছানি টানেনি, বাবা আলাউদ্দিন ও মাইহার ঘরানার ঐতিহ্য রক্ষণে ব্রতী আজীবন। দেখেছেন সঙ্গীতজগতের বহু ওঠাপড়া, আদর্শে আপস করেননি তবু। ’৯১-এ বাবা আলাউদ্দিন স্মারক সমিতি স্থাপন-পরবর্তী কর্মকাণ্ডের কান্ডারি তিনি— রবীন্দ্রসদনে বাবা-র আবক্ষ মূর্তি স্থাপন, সঙ্গীত সম্মেলন, প্রদর্শনী, বক্তৃতামালা আয়োজন, ‘আলাউদ্দিন সঙ্গীত সাধনালয়’ স্থাপনের চেষ্টায় ছিলেন অক্লান্ত। সতত অন্তরালে থাকা এই সঙ্গীতসেবিকার নীরব প্রস্থান ঘটল গত ৫ জুলাই।

ত্রিতাল

জনপ্রিয় ফিল্মি গানে কাহারবা নয়, দাদরা বাজাতে বলা হলেও, সঙ্গীতে অপরিহার্য ভূমিকা ত্রিতালের। শিক্ষানবিশ থেকে ওস্তাদ গাইয়ে, সবার সাঙ্গীতিক যাত্রা জুড়ে এই তাল। কিন্তু সেই তালকে ঘিরেই গোটা একটা পত্রিকা? সে কাজই করেছে ত্রৈমাসিক রা পত্রিকা-র (সম্পাদক: ঋতীশ রঞ্জন চক্রবর্তী) সাম্প্রতিক সংখ্যা। পত্রিকার পথ চলা শুরু আশাপূর্ণা দেবীর স্নেহাশীর্বাদ নিয়ে, প্রকাশিত হয়ে আসছে ৪৯ বছর ধরে, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান ‘সুরনন্দন ভারতী’র তত্ত্বাবধানে। ষোলো মাত্রার তাল ঘিরে আশ্চর্য উদ্যোগ— লিখেছেন পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী, পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, পণ্ডিত শ্যামল দেব, কল্যাণী কাজী, মৌসুমী রায়, সুস্মিতা গোস্বামী প্রমুখ। মার্গসঙ্গীত, নজরুলগীতি, শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত-পরিসরে ত্রিতাল-কথা।

ছবি বাঁচাতে

তেলরঙে আঁকা ছবি দেখতে ভাল, কিন্তু সে ছবির যত্ন তথা সংরক্ষণের প্রক্রিয়াটি না জানলে মুশকিল— বড় বড় শিল্পীদের কাজ ধরে রাখা যাবে না ভবিষ্যতের জন্য। শিল্পী ও শিল্পরসিক, সংগ্রাহক ও সমঝদার, শিল্প প্রতিষ্ঠান বা গ্যালারি-সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষ, সকলেরই জানা দরকার এই জরুরি বিজ্ঞান। সেই কাজেই এগিয়ে এসেছে ‘অনামিকা কলা সঙ্গম ট্রাস্ট’-এর অধীন সংস্থা ‘কলকাতা ইনস্টিটিউট অব আর্ট কনজ়ার্ভেশন’ (কেআইএসি), তৈলচিত্র সংরক্ষণের প্রশিক্ষণ আয়োজনের মাধ্যমে। চার মাসের, নিখরচার এই প্রশিক্ষণে জানা ও শেখা যাবে তেলরঙে আঁকা ছবির ক্ষয় ও তার প্রতিরোধ সম্পর্কে। শুরু ৭ সেপ্টেম্বর, বিশদ তথ্য কেআইএসি-র ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম পেজে।

তবু আনন্দ

গাছকে চতুর্দোলায় বসিয়ে, মাথায় ছাতা ধরে আনা হয় সভাস্থলে। ফুলের আলপনায় সেজে ওঠে বেদি। গাছ রোপণের পর দেওয়া হয় মাটি ও জল, বাজে মঙ্গলশঙ্খ, প্রদীপ দিয়ে বরণের পর পাখা দিয়ে হাওয়া করা হয় তাকে। নেপথ্যে তখন হয় গান। পুষ্পবৃষ্টি করা হয় শিশু গাছটির মাথায়, প্রার্থনা করা হয় তার সুস্থতা, সমৃদ্ধি। প্রতি বাইশে শ্রাবণে এই রীতি প্রচলিত বিশ্বভারতীতে। রবীন্দ্র-প্রয়াণের আশি বছর পূর্তি স্মরণে বৃক্ষরোপণ-সহ বিশেষ অনুষ্ঠান ‘শ্রাবণ আকাশে’ হয়ে গেল শান্তিনিকেতনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসভবন প্রাঙ্গণে, ‘মোহর-বীথিকা অঙ্গন’-এর উদ্যোগে, শ্যামসুন্দর কোম্পানি জুয়েলার্স-এর নিবেদনে, এসপিসিক্রাফ্ট ও এলমহার্স্ট ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি স্টাডিজ়-এর সহযোগিতায়। আগামী কাল সকাল ৯টায় তা দেখা যাবে ‘মোহর-বীথিকা অঙ্গন’-এর ফেসবুক পেজে।

বাইশে শ্রাবণ

(বাঁ দিকে) রবীন্দ্রনাথের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি।

সে বারে— ১৩৯৬ বঙ্গাব্দে— রবীন্দ্রভবনের দায়িত্ব নিয়ে যখন শান্তিনিকেতনে এলেন শঙ্খ ঘোষ, তখন বাইশে শ্রাবণের দেরি নেই। প্রদর্শনীর কী হবে? একটু ভেবে বললেন, শিরোনাম হতে পারে আছে দুঃখ আছে মৃত্যু, উপশিরোনাম কবিজীবনে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা, ১৮৭৫-১৯৪০। “সমস্ত টেক্সট তিনিই সাজিয়ে দিলেন দিন দুয়েক পরে, একগোছা কাগজে, এমনকি লেখার অংশে কোথায় হরফ একটু বড় হবে, তাও চিহ্নিত।”— স্মৃতিচারণ সুশোভন অধিকারীর। শেষ মুহূর্তে পাছে তাড়াহুড়ো হয়, তাই প্রদর্শনী ও সেই উপলক্ষে প্রকাশিতব্য পুস্তিকার সব লেখা রাতভর লিখেছেন নিজের হাতে (ছবিতে, বাঁ দিকে রবীন্দ্রনাথের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি, প্রদর্শনীতে ব্যবহৃত)। শুরুটা এমন: “‘মনে জেনো জীবনটা মরণেরই যজ্ঞ’: আপাতলঘু একটি কবিতায় এই রকম একবার লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মরণযজ্ঞের সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কীভাবে একজন কবি বারে বারে জীবনেরই বিশ্বাস ফিরে পান, রবীন্দ্রজীবনের ইতিহাস যেন তারই ধারাবাহিক পরিচয়।” বত্রিশ বছর আগের, শঙ্খ ঘোষের হাতে লেখা সেই পুস্তিকা-বয়ান বাড়ির কাগজপত্র গোছাতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছেন সুশোভনবাবু। আর এক বাইশে শ্রাবণের আবহেই।

সূচ্যগ্রে

একটা সময় ছিল যখন ছুঁচ দিয়ে ফোঁড় তুলে নকশা কাটার চর্চা করতেন বাঙালি মেয়েরা। করতেই হত, পাত্রপক্ষকে অবধারিত ভাবে দেখাতে হত যে সেই হাতের কাজ! সুতো দিয়ে ছবি বোনার সেই চর্চা এখন আর দেখা যায় না তেমন। শান্তিপুরের সীমা সেন কিন্তু সযত্নে ধরে রেখেছেন পরম্পরাটি। বাবা ফণিময় কাষ্ঠ ছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত তাঁতশিল্পী। সীমার বিয়েও হয়েছে শিল্পী পরিবারে। শ্বশুরমশাই চিত্রশিল্পী প্রয়াত সুকুমার সেন এবং দাদাশ্বশুর প্রয়াত ললিতমোহন সেন— যিনি লখনউ আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, বিলেতের ইন্ডিয়া হাউস-এর সৌন্দর্যায়নের সঙ্গে জড়িত চার শিল্পীরও অন্যতম। ছোটবেলা থেকেই সেলাইয়ের কাজ শিখেছেন সীমা। এখন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে পৌঁছেও থামেনি হাতের ছুঁচ। সম্প্রতি হাত দিয়েছেন এই শিল্প-পরিসরেই বাংলার বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলার কাজে। নীচে, সীমার সূচিশিল্পে উত্তমকুমারের ছবি, পরিমল রায়ের সংগ্রহ থেকে।

কথাসরিৎ

‘ডেল্টা তো এসে গেল!’ চায়ের দোকানের ফুট-চায়ে পুরু সরের মতোই জমছে সান্ধ্য আড্ডা, কুড়মুড়ে বিস্কুটের সঙ্গী চুরমুর করোনা-কথন। তৃতীয় ঢেউয়ের আড়ে-বহরে মাপ থেকে অ্যান্টিবডির জীবনীশক্তি, লোকাল ট্রেনের চাকার মরচে থেকে আমেরিকায় খুলে যাওয়া ইস্কুল— কথার পপকর্ন ফুটছে। অ-বাবুর মেয়ের বিয়েতে অত লোক খেল কী করে, পুলিশ হানা দেয়নি? ‘কী যে বলো, খোদ পাত্রই তো...’ ও, হেঁ হেঁ...

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement