এ দেশে গ্রীষ্মের দাপট বলতে সাহেবরা বুঝতেন বাতাসে সর্বগ্রাসী আগুনের হলকা। ধর্মগ্রন্থে পড়া নরকযন্ত্রণার কথা মনে করিয়ে দেওয়া গরমের সঙ্গে যোগ হত কলকাতার কুখ্যাত আর্দ্রতা। দুই মিলিয়ে ঠান্ডার দেশের মানুষদের বড়ই কাহিল অবস্থা। তখন গরম কেমন পড়ত? ১৮৮৯ সালে ইম্পেরিয়াল রিপোর্টার হেনরি ব্লানফোর্ড জনসাধারণ ও প্রশাসনের ব্যবহারের জন্য উপমহাদেশের জলবায়ুর সংক্রান্ত প্রথম তথ্য সঙ্কলন করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, এপ্রিল-মে মাসে শহরের তাপমাত্রা হামেশাই ১০৫-৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত উঠে যায়। ছায়া-ঢাকা জায়গাতেও থার্মোমিটারের পারদ দেখায় ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
এমন গরমে কাহিল জনজীবনের ছবি ধরা পড়ে দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায়। ১৮৮৮ সালের ইংরেজি দৈনিক জানাচ্ছে, শহরের হাসপাতালগুলিতে সান-স্ট্রোকের রোগী ভর্তি হচ্ছে প্রতিদিন, যার মধ্যে অনেককেই সুস্থ করা যাচ্ছে না। একটু বেলা বাড়লেই রাস্তাঘাট শুনশান। দোকানে কেনাকাটা প্রায় বন্ধ, ঘোড়ার গাড়ির চালকেরা রাস্তায় বেরোতে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করছেন। এমনকি গরমের জন্য অনেক স্কুলও ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি গরমে জন্য এক সপ্তাহ ‘অ্যাপিল মামলা’র শুনানি বন্ধ রেখেছিলেন। আলিপুর দেওয়ানি ও দায়রা আদালতের কাজকর্মও বন্ধ রাখা হয়েছিল।
এমন গরমে সে বছর আবার টালা জল প্রকল্পের দু’টির মধ্যে একটি পাম্প বসে গিয়ে শহরে তীব্র জলসঙ্কট দেখা দেয়। এখানেই শেষ নয়। সাহেবদের গরমে বেঁচে থাকার জিয়নকাঠি বরফের জোগানেও ঘাটতি পড়ে, সেই অভাব কাজে লাগিয়ে খুচরো বিক্রেতাদের বেশি মুনাফা করার প্রবণতা নিয়ে আলোড়িত হয়েছিল নাগরিক সমাজ।
সে কালের দস্তুর ছিল গ্রীষ্মে রাস্তায় জল দেওয়া। কিন্তু সে কাজ বন্ধ থাকলে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার বাসিন্দাদের জীবনযন্ত্রণা দ্বিগুণ হত। পাশের এক রাস্তায় জলের পাইপের খোঁড়াখুঁড়ির ফলে সারা দিন ধুলোয় স্নান করে ওঠা ক্ষুব্ধ নাগরিক প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কাগজে চিঠি দিয়েছেন, এমনও হয়েছে।
১৭৬৬ সালের এপ্রিলে মহিলা পর্যটক জেমাইমা কিন্ডার্সলে লিখছেন, গরমের মরসুমে জ্বরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয় বহু সাহেবের। কপালজোরে বেঁচে গেলেও জ্বরের পর হজমের দীর্ঘস্থায়ী গোলমাল ও অন্যান্য উপসর্গে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এই জ্বরের প্রাদুর্ভাব কম, কারণ মেমসাহেবরা কম পরিশ্রম করতেন এবং সূর্যের তাপ এডিয়ে চলতেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে চিকিৎসাব্যবস্থা অনেকটা উন্নত হওয়ায় আগের শতকের গ্রীষ্মকালীন জ্বরের আতঙ্ক অনেকটা কমে যায়।
ইউরোপীয় ডাক্তাররা সাহেবদের পরামর্শ দিতেন সূর্যের তাপ ও কঠিন শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলতে। সেই পরামর্শ মেনেই গ্রীষ্মের নিদারুণ দিন ও রাতগুলি সাহেবরা কাটাতেন টানা পাখা, ঠান্ডা পানীয় আর খিদমতগারদের নিরবচ্ছিন্ন সেবার ভরসায়। ছবিতে সাহেবের বিশ্রামদৃশ্য, ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত বই থেকে।
জীবন-নাট্য
১৯৫০-এর মার্চে তৈরি হল ভারতের প্রথম প্ল্যানিং কমিশন। দাঙ্গা, দেশভাগ পেরিয়ে আসা, সদ্য-স্বাধীন দেশে তখন প্রয়োজন ছিল এমন এক আলোর যা সরকারকে দিশা দেখাবে, দেবে স্থিতি। জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে এই কমিশনে বিশিষ্টজনের মধ্যে ডাক পান ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর অন্যতম রূপকার প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ (ছবিতে দু’জনে)। সেই ‘সংঘটন’ই এ বার বাংলা নাট্যমঞ্চে। একটি রাতের ঘটনা— যখন দেশের মধ্যে বেড়ে ওঠা জাতিদ্বন্দ্বের সামনে প্রশান্তচন্দ্র অস্থির অসহায়, বুঝে উঠতে পারছেন না কী করবেন। তাঁর আহ্বানে আসেন দুই শুভানুধ্যায়ী, যদুনাথ সরকার ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। আসেন নেহরুর আপ্তসচিব পীতাম্বর পন্থ। কী হল তার পর, স্ত্রী নির্মলকুমারীই বা কোন উপলব্ধিতে পৌঁছতে সাহায্য করলেন ওঁকে, এই সব নিয়েই বাঘাযতীন আলাপ-এর নতুন নাটক যে নদী মরুপথে। রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যায়ের নাট্যরচনা ও নির্দেশনা, আজ তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহে সন্ধে সাড়ে ৬টায়।
বিজ্ঞান ও সাম্রাজ্য
বিজ্ঞান ও সাম্রাজ্যের সম্পর্ক নিয়ে ইতিহাসবিদদের ভাবনা অনেক দিনের। কারও কাছে বিজ্ঞান সাম্রাজ্যের ইতিবাচক সংগঠনের প্রেরণা, অন্যদের কাছে সাম্রাজ্য স্থাপন ও সম্প্রসারণের হাতিয়ার। দু’পক্ষেরই আছে যুক্তি-প্রতিযুক্তির ধারা, তারই সূত্র ধরে ‘বিজ্ঞান ও সাম্রাজ্য’ নিয়ে এক আলোচনার উদ্যোগ করেছে পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সহায়তায়। আগামী ১৯ এপ্রিল বিকেল ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকানন্দ হল-এ বক্তা অরবিন্দ সামন্ত। এশিয়া, আফ্রিকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের দৃষ্টান্তে দেখাবেন, কী ভাবে সাম্রাজ্যে ও উপনিবেশে জাতি ও ব্যক্তিপরিচয় নির্মাণে-বিনির্মাণে ও তা বৈধকরণে উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ ব্যবহার করেছিল বিজ্ঞানকে; কী ভাবে উনিশ শতকের বহু বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে হয়ে উঠল বৈধতার সিলমোহর।
শিল্পের পথ
লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির জন্মদিনে, ১৫ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব শিল্পকলা দিবস। এই উপলক্ষে, বৃহত্তর সমাজে শিল্পচেতনার বিকাশ আর শিল্পচর্চার সুস্থ পরিবেশ গড়ার লক্ষ্যে আগামী কাল, নতুন বাংলা বছরের সকালে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে আর্টিস্টস’ ফোরাম অব বেঙ্গল। যোগেন চৌধুরী সমীর আইচ আদিত্য বসাক চন্দ্র ভট্টাচার্য ছত্রপতি দত্ত প্রদীপ রক্ষিত ও আরও অনেকে হাঁটবেন শিল্পের জন্য পদযাত্রায়। থাকবেন রাজ্যের নানা জেলা থেকে আসা লোকশিল্পী, কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা; শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র ও শিল্প সংগঠনের সদস্য, শিল্পানুরাগী সকলে। সকাল ৭টায় রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কের সামনে থেকে শুরু, ললিতকলা অকাদেমি হয়ে দেশপ্রিয় পার্ক পর্যন্ত।
বইয়ের জন্য
প্রতি দিন বাংলা বই, পত্রপত্রিকার পাঠকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে কথা উঠছে জনপরিসরে। তখন কি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায়! এই বাস্তবের মোকাবিলায়, জ্ঞানের আধার বইকে মানুষের দৈনন্দিনতার সঙ্গে যুক্ত করতে এক অভিনব পদক্ষেপ করেছে ‘আমরা বইপ্রেমী’ সংগঠন। এর আগেও মানুষকে বইমুখো করতে ‘বইপুজো’, ‘বইবরণ’ শীর্ষক বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান পালন করেছেন ওঁরা। এ বার পয়লা বৈশাখ সকাল ৬টায় বেহালার নবপল্লি স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব প্রাঙ্গণে তাঁদের আয়োজন ‘বই নববর্ষ’ অনুষ্ঠান, মূল আকর্ষণ বইয়ের জন্য প্রভাতফেরি।
মধ্যবিত্ত নিয়ে
আর একটা বাংলা সাহিত্য উৎসব পেতে চলেছে শহর। কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি) আয়োজিত ‘কেসিসি বৈঠকখানা’ আগামী ১৯ থেকে ২১ এপ্রিল, কেসিসি-তেই। উৎসবের এ বছরের থিম ‘মধ্যবিত্ত’। বাংলা সাহিত্য অনেকটাই মধ্যবিত্তদের দ্বারা, মধ্যবিত্তদের জন্য ও মধ্যবিত্ত বিষয়ে। কবিতায় গল্পে নাটকে গানে তাকে বেদিতে তুলে পুজো করা হয়েছে, তুলে আছাড় মারাও হয়েছে। মধ্যবিত্তের মহত্ত্ব-নীচতা, ভণ্ডামি-ভালবাসা, বিষাদ-দরদ, ফাজলামি-ফেসবুক সবই ধরা পড়বে— আলোচনা গান অভিনয় বক্তৃতা গল্পপাঠ বিতর্কে। উদ্বোধন করবেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যোগেন চৌধুরী ও বিভাস চক্রবর্তী; বিভিন্ন অনুষ্ঠানে থাকবেন সাহিত্য ও সংস্কৃতিজগতের বিশিষ্টজন।
দেওয়াল জুড়ে
পূর্ব মেদিনীপুরের হবিচক গ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারজয়ী শিল্পী নুরুদ্দীন চিত্রকর এসেছিলেন সল্ট লেকে, ভবন’স গঙ্গাবক্স কানোরিয়া বিদ্যামন্দির স্কুলে। শহুরে ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কাছে পেল হাতে কলমে পটচিত্র শেখার পাঠ! তিন দিনের কর্মশালা: স্কুলের অধ্যক্ষ-সহাধ্যক্ষের উৎসাহে, স্কুলের শিল্পকলা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত সুইটি দত্ত বণিক ও অম্লান মৌলিকের তত্ত্বাবধানে। পটচিত্র গল্প বলার ভঙ্গিতে রচিত হয়, প্রথমে সমতলীয় ভাবে রং দিয়ে বিষয় ভরে, পরে রেখায় স্পষ্ট করা হয় বিষয়কে। অজন্তা বা পাল যুগের চিত্রকলাও এই ধারাতেই রচিত। স্কুলের বাইরের দেওয়াল জুড়ে আঁকা হয়েছে ভিত্তিচিত্র (ছবি), নজর কাড়ছে সবার। শহরের দেওয়াল যখন ভরে উঠছে চলেছে পাশ্চাত্য ধারা অনুসারী গ্রাফিত্তিতে, নির্বাচন-আবহের জগঝম্পময় আঁকিবুঁকিতে, তখন ইস্কুলে বাংলার লোকশিল্পের এই চর্চা আশা জাগায়।
বিকশিত
আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসাবে গোপাল ঘোষ, মানিকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রথীন মৈত্র অজিত গুপ্তকে পেয়েছিলেন লালুপ্রসাদ সাউ। ভারতীয় চিত্রকলায় ডিপ্লোমা তাঁর, পরে শুরু টেম্পেরা চিত্রচর্চা; কালীঘাট পটচিত্র, অজন্তা ভিত্তিচিত্র, যামিনী রায় শৈলী ছিল অবলম্বন। সনৎ কর ও সুহাস রায়ের তত্ত্বাবধানে তাঁর ছাপচিত্রে প্রবেশ। হেয়ার স্কুলে শিক্ষক ছিলেন, পরে বিশ্বভারতীতে— কলাভবনে। সোমনাথ হোরের সঙ্গ সমৃদ্ধ করেছিল তাঁর ছাপচিত্র-চর্চা। বিমূর্ত চিত্রের পাশাপাশি অবয়বি চর্চা, মোগল শৈলী থেকে শান্তিনিকেতনের স্মৃতি, পটচিত্রের আঙ্গিকে বিকশিত হয়ে উঠতে থাকে ক্রমে। তাঁর অনন্য এই শিল্পকৃতিই এ বার প্রদর্শনীতে— ‘ব্লসমস অ্যান্ড ইমপ্রিন্টস’ শিরোনামে চলছে গ্যালারি ৮৮-তে। ড্রয়িং পেন্টিং এচিং লিথোগ্রাফ সেরিগ্রাফ চিত্রসম্ভার (ছবি) দেখা যাবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। রবিবার বাদে অন্য দিন দুপুর ২টো থেকে রাত ৮টা।
সমাপন
স্বাধীনতা লাভের পরের বছর কলকাতায় যে সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল শুভ গুহঠাকুরতার হাত ধরে, দেখতে দেখতে তার বয়স পেরোল পঁচাত্তর। ‘দক্ষিণী’ আজ শুধুই রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিষ্ঠান নয় এক, এ শহর ও রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের যেখানেই আছেন রবীন্দ্র-সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালি, সকলের কাছে আদৃত, সুদেব গুহঠাকুরতার দেখানো পথে সে সুচর্চা ও নিয়মনিষ্ঠার শেষ কথা। দক্ষিণীর প্লাটিনাম জয়ন্তী বর্ষের অনুষ্ঠান চলেছে একটি বছর ধরে নানা জায়গায়, গত ৭ এপ্রিল পি সি চন্দ্র গার্ডেনের মেপল লন-এ হয়ে গেল সমাপ্তি অনুষ্ঠান ‘দক্ষিণী বারোমাস্যা’, দেবাশিস রায়চৌধুরীর পরিচালনায়। শুরুর সুরটি বেঁধে দিলেন রণো গুহঠাকুরতা ও পার্থ ঘোষ, পরে পরিবেশনা প্রাক্তনী ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের: একক ও বৃন্দগান, নৃত্য; নাটক শ্রুতিনাটক গীতিনাট্য নৃত্যনাট্যের অংশ: রক্তকরবী রথযাত্রা দ্য চাইল্ড অতিথি বাল্মীকি-প্রতিভা বিসর্জন চিত্রাঙ্গদা ফাল্গুনী দেনা পাওনা থেকে।