শব্দ এবং বায়ুদূষণে স্বাগত নববর্ষ

জোরে গান চালিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নাচানাচি চলছিল তুমুল। হঠাৎই কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিলেন না যুবকটি। সারা রাত সে ভাবে কাটার পরে কানে ঝিঁঝি আওয়াজ নিয়ে মঙ্গলবার সকালেই ডাক্তারের দ্বারস্থ হন তিনি। ডাক্তার জানান, হঠাৎ জোরে আওয়াজে তাঁর সাময়িক শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে! 

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:২০
Share:

বর্ষবরণের রাতে ফাটল দেদার আতসবাজি। সোমবার রাতে, দক্ষিণ কলকাতায়। নিজস্ব চিত্র

জোরে গান চালিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নাচানাচি চলছিল তুমুল। হঠাৎই কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিলেন না যুবকটি। সারা রাত সে ভাবে কাটার পরে কানে ঝিঁঝি আওয়াজ নিয়ে মঙ্গলবার সকালেই ডাক্তারের দ্বারস্থ হন তিনি। ডাক্তার জানান, হঠাৎ জোরে আওয়াজে তাঁর সাময়িক শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে!

Advertisement

এত দিন শব্দের ‘অশ্লীল’ তাণ্ডবের জন্য কালীপুজো, দীপাবলিই বরাদ্দ ছিল। গত তিন-চার বছরে সে ধারায় পরিবর্তন হয়েছে। দূষণের গণ্ডি ভাঙার তালিকায় ‘নিউ ইয়ার ইভ’-ও যুক্ত হয়েছে। ফলে আগে যেখানে কালীপুজো, দীপাবলিতে কানের সমস্যা নিয়ে ইএনটি চিকিৎসকের চেম্বারে ভিড় করতেন রোগীরা, সেখানে এখন নববর্ষ উদ্‌যাপনেও পাড়ায়-পাড়ায় ডিজে, মুহুর্মুহু বাজি ফাটানো-সহ শব্দবাজির হাজারো আগ্রাসনে ‘বিপন্ন’ রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন ইএনটি চিকিৎসকেরা।

কানের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া কৌমিল পটেল নিজেই শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক। কৌমিল বলছেন, ‘‘জোরে আওয়াজে হঠাৎ করেই কানে সমস্যা হয়েছে। চিকিৎসককে দেখিয়েছি।’’

Advertisement

কৌমিল যাঁকে দেখিয়েছেন, সেই ইএনটি চিকিৎসক শান্তনু পাঁজা বলছেন, ‘‘এখন সব উৎসবেই ‘নয়েজ-ইনডিউসড হিয়ারিং লস’-এর সমস্যা নিয়ে ভিড় করছেন রোগীরা। রাতে নির্দিষ্ট সময়ের পরে মাইক বাজানো যাবে না নিয়ম রয়েছে। কিন্তু যখন বাজানো হচ্ছে, তখন তার শব্দপ্রাবল্য কতটা থাকছে, তা দেখা হচ্ছে কি!’’ ইনএনটি চিকিৎসক অনির্বাণ বিশ্বাস বলেন,

‘‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের নিয়ম শুধু খাতায়-কলমে থাকলে হবে না, তা বাস্তবায়িত করতে হবে।’’ ইএনটি চিকিৎসক দুলালচন্দ্র বসু বলেন, ‘‘শব্দরোগীর সংখ্যা তো বাড়ছেই। অবশ্য রাতে তো মাইক বাজানোও নিষিদ্ধ, সেখানে তো সাইরেন বাজানোরও নির্দেশ রয়েছে!’’

শুধুই কী শব্দ, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, গত দশ বছরে বায়ুদূষণের নিরিখে সোমবারের রাত পেল দ্বিতীয় স্থান। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে দূষণের মাত্রা একমাত্র বেশি ছিল। অর্থাৎ, ২০১৮ সালের কালীপুজো, দীপাবলি, ছটপুজো-সহ প্রতিটি উৎসবের মরসুমে শব্দ-বায়ুদূষণের লেখচিত্র যে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল, সে বৃত্ত সম্পূর্ণ হল সোমবার রাতে, নতুন বছরকে স্বাগত

জানাতে গিয়ে!

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের খবর, ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টায় বিটি রোডের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভাসমান ধূলিকণার (পিএম১০) পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪৩৮.৩৬ মাইক্রোগ্রাম, ২০১৩ সালে ওই একই জায়গায় রাত ১২টায় সেই পরিমাণ ছিল ৭৩৫.৮৮ এবং ২০১৭ সালে ওই পরিমাণ ছিল ৬২৫.২৩। সেখানে সোমবার রাত ১২টায় ওই পরিমাণ ছিল ৬৩০.১৩, রাত দুটোয় সেই পরিমাণ একটু কমে দাঁড়ায় ৫৫৫.৯৭ মাইক্রোগ্রাম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে রাত ১২টায় ওই পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪১৮.৮। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক কর্তার কথায়, ‘‘সচেতনতা প্রচার করলেও অনেকেই শোনেন না!’’

কিন্তু সেখানে কী করণীয়, তা জানেন না কেউই।

তবে সারা বছর ধরে বাজি সরবরাহ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাজি ব্যবসায়ীদের একাংশও। তাঁদের বক্তব্য, বেআইনি ভাবে বাজি বিক্রির কারণে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বৈধ বাজি বিক্রেতাদের। টালা পার্ক বাজি বাজারের সভাপতি সঞ্জয় দত্ত বলেন, ‘‘একমাত্র বৈধ লাইসেন্স ছাড়া কেউই সারা বছর ধরে বাজি বিক্রি করতে পারেন না। যাঁদের শুধুমাত্র পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসনের লাইসেন্স থাকে, তাঁরা বছরের সাত দিন, অর্থাৎ শুধু কালীপুজোয় বাজি বিক্রি করতে পারেন। বাস্তবে সেটা আর মানা

হচ্ছে কোথায়!’’

ফলে নিয়ম ভাঙা হচ্ছে। তার সঙ্গে দূষণের অতীতের রেকর্ডও প্রতিনিয়ত ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে বায়ু-শব্দদূষণের নিত্যনতুন মাত্রা!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement