এমন মাংস চাখার অভিজ্ঞতা সোনার কলমে লিখে গিয়েছেন মুজতবা আলি।
কায়রোয় পেটে ছ্যাঁদাওলা চাক্তি-চাক্তি মাংস ‘খাশা’ লেগেছিল তাঁর। তবে মশলায় ‘কঞ্জুসি’ করেছিল বলে শিক কবাবের সুখটা ঠিক পাননি। এ কালের কলকাতায় মাংসে তেল-ঝাল-মশলার কমতিটাই যেন ‘ইউ এস পি’।
তেলে ভাজা কড়কড়ে পরোটায় মুড়ে ঝাল-ঝাল মাংসের কবাব কী ভাবে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে খেতে হয়, তা একদা দেশকে শিখিয়েছে এই কলকাতাই। এ শহরেই এ বার লেবানন বা আরবমুলুকজাত তেলহীন নব্য রোল বা র্যাপ কলরোল তুলেছে।
পোশাকি নাম শওয়ারমা। ফুটের ধারের চিলতে কাউন্টারে কয়লার উনুন কি তৈলাক্ত তাওয়ার বদলে শওয়ারমা মেশিন। ঘুরন্ত ধাতব রডে গাঁথা চিকেনের পিঠে নীল আগুনের হল্কা লাগছে। সেই আগুনের সেঁকেই থাক-থাক মাংসে পাক ধরছে। পরোটার বদলে থাকছে আভেন-গরম নরম ময়দার রুটি বা পিটাব্রেড। তাতে মুড়ে তিলবাটা-রসুনের থকথকে সাদা সস মাখা মাংসে আরামে কামড় দিচ্ছে নব্য কলকাতা।
ভূমধ্যসাগর পারের ইস্তাম্বুল-আথেন্সে এমন দৃশ্য বরাবর দেখা যায়। শওয়ারমা ছাড়াও কেউ বলেন ডোনার কবাব বা গাইরোজ। রুটি ও মাংসের এমন পথচলতি যুগলবন্দি দুনিয়ার সব শহরেই জনপ্রিয়। আমেরিকার বার্গার-হটডগ বা কলকাতার রোল সে-দিক দিয়ে তার তুতো ভাই। শওয়ারমাও ক্রমশ দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়েছে।
সল্টলেক থেকে বেহালা বা গড়িয়া থেকে হাতিবাগান, এখন তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। বিধান সরণি ও অরবিন্দ সরণির মোড়ের জুতোর দোকান পাল্টে দুরু-দুরু বুকে ‘লেবানিজ জাংশন’ খুলেছেন প্রসূন সাহা। কয়েক হাত দূরে কবিরাজি কাটলেটের নামী ঠিকানা বা রোলের দোকান থাকা সত্ত্বেও ভালই লড়াই দিচ্ছেন।
হাতিবাগান টাউন স্কুলের গলিতেও বিরিয়ানি হেভিওয়েট আরসালানের মুখোমুখি ‘রয়্যাল লেবানিজ’। ওই তল্লাটে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রোল, মোমো, ইডলি-বড়া, চপ-কাটলেট সব বিকোচ্ছে। সাবেক কলকাতায় শওয়ারমার উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে ভূমধ্যসাগরপারের এই সৃষ্টি কলকাতায় পাকাপাকি থাকার জন্যই এসেছে।
বছর আটেক আগেও অবশ্য ছবিটা এমন ছিল না। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দু’টি কাউন্টারে থমকে যায় শওয়ারমার দৌড়। তবে কলকাতার বিভিন্ন শপিং মলের ফুডকোর্টে ক্রমশ জায়গা করে নেয় সে। যদিও স্ট্রিট ফুড হিসেবে শওয়ারমা কতটা মান্যতা পাবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল।
বছর চারেক আগে মিথটা ভাঙল শরত্ বসু রোডের ‘গো লেবানিজ’। চিকেন শওয়ারমার সঙ্গে স্যালাড, মটন র্যাপ, আরবি মশলামাখা ল্যাম্ব চপ, রকমারি মাছের কবাব, হুমুস, বাবাগানুশের মতো লেবানিজ ডিপ (যা এতদিন পাঁচ তারায় মিলত) পথের ধারেই বিক্রি করছেন তাঁরা। অজয়নগর, সেক্টর ফাইভ, বেহালা ট্রাম ডিপোতেও এ সব মিলবে। কেউ কেউ আরবি বিরিয়ানি বলে অলিভ অয়েলে রান্না এক ধরনের পোলাও-ও বিক্রি করছেন।
এই সে দিনও সাহেবদের দেশের তেল-মশলাহীন খানা জিভে রুচত না বাঙালির। ইউরোপের সাদামাটা ‘যাবনিক রান্না’ (শ্বেতাঙ্গদের খাদ্য) খেয়ে ততটা খুশি হননি মুজতবা আলিও। এই কলকাতায় টলিউডি তারকা থেকে আমগেরস্ত আকছার গাড়ি দাঁড় করিয়ে বা হেঁটে এসে তেলহীন র্যাপ তুলে নিচ্ছেন। ‘গো লেবানিজ’-এর কর্তা দেবাশিস দে-র দাবি, “রোলের থেকে দাম বেশি হলেও স্বাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যটা মেলাতে পেরেছি বলেই এই চাহিদা।”
ডায়েটিশিয়ান রেশমি রায়চৌধুরী অবশ্য ‘দারুণ স্বাস্থ্যকর’ বলে শংসাপত্র দিচ্ছেন না শওয়ারমাকে। তেলতেলে পরোটার তুলনায় তেলহীন পিটাব্রেড অবশ্যই সহজপাচ্য। কিন্তু পরিমাণে রোল নেহাত জলখাবার হলে শওয়ারমা প্রায় একবেলার খানা। সে-দিক দিয়ে ক্যালরির ভাগ নেহাত কম নয়।
তবু সুস্বাদের একটি বিকল্পের হদিস পেয়েই খুশি কলকাতা।