মেয়ের জন্য জন্মদিনের উপহার কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। শ্যামবাজারের অমিয় সরকারের (নাম পরিবর্তিত) সে দিন বাড়ি যাওয়ার তাড়া ছিল একটু বেশিই। কিন্তু রাস্তায় ভিড় দেখতে পেয়ে উঁকি দিয়ে দেখেন, এক যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় পরে রয়েছেন। উদ্যোগী হয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে আহতকে হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। জরুরি বিভাগের ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা শুরু করে অমিয়বাবুকে থেকে যেতে বললেন। কেন? কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট কেস’। কিছু নিয়মকানুন আছে। তাই থেকে যেতে হবে। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে রাত ৯টা, হাসপাতালের ‘ফর্মালিটি’ তবুও শেষ হয় না। রাত প্রায় সাড়ে ১১টা নাগাদ পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে দিনের মতো মুক্তি মেলে অমিয়বাবুর। তার পরেও দীর্ঘ দিন চলে আইনি টানাপড়েন।
অমিয়বাবুর ঘটনা কয়েক দিন আগের। মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে, বৃহস্পতিবার হাওড়ার গোলাবাড়ি এলাকার ঘাসবাগানে দুর্ঘটনায় জখম এক সাইকেল চালককে রাস্তায় পরে থাকতে দেখেও কেউ পা বাড়াননি। স্রেফ সময় মতো চিকিৎসা না পেয়ে ওই ব্যক্তি প্রাণ হারান।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, প্রতি চার জনের মধ্যে তিন জন এই আইনি জটিলতা ও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ নামক ‘হেনস্থা’র ভয়ে দুর্ঘটনায় আহতদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন না। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এ দেশে দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে অর্ধেকই ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এর মধ্যে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান। অর্থাৎ, ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু না হওয়ায় বড় বিপত্তি আর এড়ানো যায় না।
অথচ, এই বিপত্তি এড়াতেই এ বছর মার্চে সুপ্রিম কোর্ট ‘গুড সামারিটান ল’-এর নির্দেশ দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, যাঁরা দুর্ঘটনায় আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসবেন তাঁরা যেন কোনও রকম আইনি জটিলতা ও পুলিশি হেনস্থার শিকার না হন। তিনি দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষী দিতেও বাধ্য থাকবেন না। পুলিশের কাছে তিনি নিজের পরিচয় ও ঠিকানা দেবেন কি না— সেটাও তাঁর ইচ্ছাধীন। তাঁর অনিচ্ছা থাকলে ‘তদন্তের স্বার্থে’ পুলিশ তাঁকে বারবার জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে না।
তবে অনেকের মতে, পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমাতে অন্য রাজ্য যতটা এগিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ তা পারেনি। ‘সেভ লাইফ’ ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর অপারেশনস সাজি চেরিয়ান জানান, কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে ‘পিপিপি মডেল’-এ ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ‘ডায়াল ১০৮’ ব্যবস্থা চালু হয়েছে ভারতের ২০টি রাজ্যে। পথ দুর্ঘটনায় কেউ আহত হলে পথচারী ১০৮ নম্বরে ফোন করে জায়গার নাম ও দুর্ঘটনার ধরন ও আহতের সংখ্যা জানালে চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে জিপিএস-নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুল্যান্স ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে, আহতকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাবে — এটাই পরিষেবাটির মূল কথা। বিহার, অসম, হিমাচলপ্রদেশ, মেঘালয়ের এই পরিষেবা চালু হয়েছে। এ রাজ্যে কোনও কাজই শুরু হয়নি।
এ রাজ্যে সেই ট্র্যাডিশন চলছেই। পুলিশ ও চিকিৎসকদের একাংশের মতে, বেশির ভাগ মানুষ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত নন। কিন্তু আইনের ধারক-বাহকেরা কি অবহিত? শুক্রবার এই নিয়েই কলকাতায় এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল কলকাতার ফর্টিস হাসপাতাল। সেখানে ছিলেন পুলিশ, আইন কমিশন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধানেরা।
পুলিশের স্বীকারোক্তি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কথা পুলিশ বাহিনীর সর্বস্তরের কর্মীরাও জানেন না। তাই সাধারণের সঙ্গে তাঁদেরও সচেতন করা প্রয়োজন। অনুষ্ঠানে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (এস্টাব্লিসমেন্ট) সুজয় চন্দ বলেন, ‘‘এ নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন স্তরের অফিসারদেরও প্রশিক্ষণ দরকার।’’
তবে আদালতের ওই নির্দেশই যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন আইনজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের মতে, এই জটিল পরিস্থিতিকে সহজ করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে আইন থাকা প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ট্রমা কেয়ার সেন্টার থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনুষ্ঠানে রাজ্য আইন কমিশনের সভাপতি ও হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় কেন্দ্রের মোটর ভেহিক্লস আইনের সংশোধনের কথা বলেন।
তাঁর মতে, ‘‘এক জন ট্যাক্সিচালক যখন পথে পড়ে থাকা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসবেন, তখন তাঁর ভাড়া কোথায় পাওয়া যাবে — সে বিষয়েও স্পষ্ট তথ্য থাকা উচিত আইনে।’’ এ বিষয়ে রাজ্যের ক্রেতাসুরক্ষা মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে বলেন, ‘‘এই সচেতনতা কর্মসূিচর প্রচারে সাহায্য করবে সরকার।’’