ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতা কি ক্রমশ শব্দদূষণের রাজধানী হয়ে উঠছে? প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, শব্দমাত্রার নির্দিষ্ট মাপের ধারেকাছেও নেই কলকাতার রাস্তাঘাট। ভয়াবহ অবস্থা সাইলেন্স জ়োনগুলিরও।
আইন অনুযায়ী, সাইলেন্স জ়োনে শব্দমাত্রা থাকার কথা দিনে ৫০ আর রাতে ৪০ ডেসিবেল। অথচ, কলকাতার অন্যতম দুই সাইলেন্স জোন এসএসকেএম এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দৈনিক গড় শব্দমাত্রা বিপজ্জনক মাত্রারও অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, দিন দিন বাড়ছে কলকাতার শব্দদূষণ।
শব্দমাত্রা পরিমাপের জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের যৌথ উদ্যোগে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ১০টি শব্দ পরিমাপক যন্ত্র লাগানো হয়েছে। আর জি কর এবং এসএসকেএমেও রয়েছে এমন দু’টি যন্ত্র। পরিসংখ্যান বলছে, এই দু’টি হাসপাতাল চত্বরে দিনে শব্দের গড় পরিমাপ ৭০ ডেসিবেলের কাছাকাছি। সময়ে সময়ে যা আরও বেড়ে যায়। অর্থাৎ, সাইলেন্স জ়োনের শব্দাঙ্কের চেয়ে সংখ্যাটি ২০ ডেসিবেলেরও বেশি। অন্য দিকে, রাতে শব্দাঙ্ক গড়ে প্রায় ৬০ ডেসিবেল। কখনও যা ৬৪ ডেসিবেল ছুঁয়ে ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, শহরের হাসপাতালগুলি রাস্তার ধারে হওয়ার ফলেই দূষণের মাত্রা এতটা বেশি। আর জি করের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যালের বক্তব্য, হাসপাতালের ভিতরে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের বেশ কিছু ব্যবস্থা তাঁরা করেছেন। বদলানো হয়েছে আওয়াজ করা পুরনো ট্রলি। হাসপাতালের ভিতরের রাস্তা মসৃণ করা হয়েছে, যাতে ট্রলি ঠেললে শব্দ কম হয়। এ ছাড়া, নির্মাণকাজ এবং হাসপাতালের বিভিন্ন শব্দ উৎপাদনকারী কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ নজর রাখা হয়, যাতে অতিরিক্ত শব্দ রোগীদের কানে না পৌঁছয়। হাসপাতালের সামনে ট্রামলাইন মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে।
এসএসকেএমের সুপার মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘হাসপাতালের মূল ফটকগুলি থেকে ওয়ার্ডের দূরত্ব অনেকটাই। ফলে ওয়ার্ডগুলিতে শব্দদূষণের পরিমাণ খানিকটা কম। কিন্তু তা সন্তোষজনক নয়। শব্দদূষণের কারণে রোগীদের মানসিক এবং শারীরিক সমস্যাও হয়।’’
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন অধিকর্তা বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘মানুষের মধ্যে সচেতনতা এমনি এমনি তৈরি হয় না। তার জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। উন্নত দেশে তো বটেই, এ দেশের বিভিন্ন রাজ্যেও শব্দদূষণ নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার নানা ব্যবস্থা আছে। দূষণের ক্ষেত্রে কলকাতায় সে ধরনের উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়ে না। ফলে শব্দদূষণকে মানুষ অপরাধ বলেই গণ্য করেন না।’’ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রের অবশ্য দাবি, পর্ষদ বিভিন্ন সময়ে শব্দদূষণ রোধে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাস এবং ট্যাক্সিচালকদের মধ্যে লিফলেট বিলি করা হয়। কয়েকটি অঞ্চলে ডিজিটাল বোর্ড বসানো হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি মেনে নিয়েছেন, এখনও মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা যায়নি।
যদিও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক প্রাক্তন কর্মীর বক্তব্য, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কেবল মাত্র কালীপুজোর সময়েই শব্দদূষণ নিয়ে ভাবিত হয়। অন্য সময়ে বিষয়টি নিয়ে কেউ মাথাও ঘামান না। কল্যাণবাবুর অবশ্য দাবি, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একার পক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। পুলিশ এবং প্রশাসনের সহায়তা জরুরি।
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের বক্তব্য, কলকাতার রাস্তায় ট্র্যাফিকের ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। ফলে হর্ন দেওয়ার প্রবণতাও বেশি। শুধু সচেতনতার প্রচার চালিয়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন পরিকাঠামো। সিগন্যাল ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করলে ট্র্যাফিকের গতি বাড়বে। তার জন্য ‘সিস্টেম্যাটিক সিগন্যালিং’ তৈরি করতে হবে। বহু বছর আগে আদালত এ বিষয়ে মন্তব্যও করেছিল। কিন্তু রাজ্য সরকার ব্যবস্থা নেয়নি। বদলায়নি পুরনো সিগন্যাল ব্যবস্থা। রাস্তার গতি না বাড়লে কোনও জ়োনেই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।