ধনঞ্জয় চক্রবর্তী এবং তাঁর সাধের গাড়ি। নিজস্ব চিত্র।
নিউ মার্কেট চত্বরে ‘পিকু’ ছবির শুটিং করছিলেন সিনিয়র বচ্চন। হঠাৎই তাঁর চোখ যায় উদ্ভট একটা ট্যাক্সির দিকে। আর চোখ যে যাওয়ারই কথা। গোটা কলকাতার মানুষ হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকেন ট্যাক্সিটির দিকে। সে ট্যাক্সির মাথায় আস্ত একটা বাগান, ভিতরেও টবের ভিতর রাখা সার দিয়ে নানান প্রজাতির গাছ। আর গোটা ট্যাক্সিটাই সাজানো চোখধাঁধানো সব কার্টুন দিয়ে। এমন ট্যাক্সি দেখে আত্মবিহ্বল হয়ে টুইটারেও দু-চার কলি লিখে ফেলেছিলেন বিগ বি।
অমিতাভ বচ্চনের নজরে আসা মাত্রই দিনবদলের গান শুরু হয়ে যায় চালক ধনঞ্জয় চক্রবর্তীর জীবনে। বাপি বলেই তাঁকে চেনে মানুষজন। আর সাধের ট্যাক্সির নাম রেখেছেন 'সবুজরথ'। তার পর থেকেই দেশ-বিদেশের সাংবাদিক জড়ো হতে শুরু করেন টালিগঞ্জের করুনাময়ী ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। সবকিছু মিলিয়ে এক লহমাতেই কেমন যেন পপুলার হয়ে গেলেন ধনঞ্জয়। কিন্তু এক নিমেষের এই পপুলারিটি গাছের প্রতি তাঁর ভালবাসায় এক ফোঁটা দাগ কাটতে পারেনি। বরঞ্চ ভালবাসা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। আর এখন এই ট্যাক্সি নিয়েই মোদীজির কাছে পৌঁছে যেতে চান চালক ধনঞ্জয় চক্রবর্তী। দেখা করবেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও। তাঁদের ফুলের চারাও দেবেন। উদ্দেশ্য একটাই— বৃক্ষরোপণের বিষয়টা যদি সরকার সিরিয়াসলি নেয়।
তবে ইদানিং ট্যাক্সি শব্দটা শুনলেই হালকা একটু মুখ বেঁকাচ্ছেন চালক ধনঞ্জয় চক্রবর্তী। কারণ, আপাতত তাঁর ট্যাক্সিটি গ্যারেজে। গাড়িটি সারাইয়ের কাজ চলছে জোরকদমে। দিল্লি যাবেন বলে কথা, সারাই তো প্রয়োজনই। উপহার হিসেবে আরেকটা গাড়ি পেয়েছেন এক শুভাকঙ্খীর কাছে। সেই গাড়িটিকেই আপাতত চালাচ্ছেন ধনঞ্জয়। রংচঙে গাড়িটি করে মানুষকে কলকাতা ঘুরিয়ে দেখান গাছপাগল এই চালক। মানুষ নিজের ইচ্ছায় যা টাকা দেন, তাই হাত পেতে নিয়ে নেন তিনি। কেননা এই টাকাগুলোই তিলে তিলে জমিয়ে দিল্লি যাত্রার খরচ তুলতে চান ধনঞ্জয়।
সফর শুরুর রাস্তাটা ধনঞ্জয় পেয়েছিলেন কাঁটায় বিছানো। বললেন "কারখানা লক-আউট হওয়ার পরেই ট্যাক্সি চালাব বলে ঠিক করি। এদিকে গাছকে আমি বরাবরই ভালবাসি। কিন্তু জীবনে এত গাছ লাগিয়েছি যে, একসময় চিন্তায় পড়ে যাই আর কোথায় গাছ লাগাব? একদিন গাড়িতেই দেখি এক যাত্রী একটি মদের বোতল রেখে গিয়েছেন।সেই ছোট্ট মদের বোতলেই গাছ লাগানো শুরু করি গাড়িতে।" পরে এক বন্ধু ঠাট্টা করে বলে ‘আর কোথায় গাছ লাগাবি? এ বার নিজের মাথায় গাছ লাগিয়ে ফেল।’ আর তখনই গাড়ির মাথায় গাছ লাগানোর কথা ভাবেন ধনঞ্জয়। কেউ কখনও পাগল বলেছে, কেউ বলেছে ‘কি হবে এ সব করে?’ মনোবল এক মুহূর্তের জন্যও কম হতে দেননি এই চালক।
আরও পড়ুন: স্টিয়ারিংয়ে হাত প্রতিমার, গেটে শিবেশ্বর, ঘুরছে জীবনের চাকা
গাড়ির গাছগুলির জন্য সঠিক পরিচর্যা করতে দিনে তাঁর প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি লেগে যায়। হাজার কাজের ফাঁকেও গাছের জন্য নিয়ম করে এক ঘন্টা বরাদ্দ ধনঞ্জয়ের রোজ রুটিনে। মাঝে মাঝে নানান স্কুল থেকে কচিকাচাদের পরিবেশ সচেতনতার পাঠ দেওয়ার জন্য ডাক পড়ে তাঁর।
তবে শুধু গাছ নয়। মুদ্রার ওপিঠে রয়েছে কার্টুন। টানা রিকশা, ফুচকার ফাউ, রবি থেকে সত্যজিত সবই কার্টুনের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে ধনঞ্জয় বাবুর ট্যাক্সিতে। বলছেন "কার্টুন আমার খুবই প্রিয়। মনের অনেক কঠিন কথা খুব সহজেই বুঝিয়ে দিতে পারে কার্টুন। কলকাতার নামজাদা কার্টুনিস্টরা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে এসেছেন। কেউ এক পয়সাও চাননি। তাঁদের বলেছিলাম হারানো শহরটা তুলে ধরতে চাই। সকলে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমার কাছে ছুটে এসেছেন, কার্টুন এঁকেছেন।"
গাড়ির ভিতরে সিট থেকে সিলিং সর্বত্রই সবুজের আভা। যাত্রীদের একজন বললেন "ভিতরটা বেশ ঠান্ডা। আর উনি তো এখন সেলিব্রিটি। টিভি খুললেই গ্রিন ট্যাক্সি। ওনাকে দেখেই তো বাড়ির ছাদে গাছ লাগানো শুরু করেছি।"
ঠিক যেন রবি ঠাকুরের বলাই! গাছপালা নিয়েই এক আকাশ স্বপ্ন রয়েছে তাঁর। ছকও কষে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। নিজের দলবল আর গাড়ি দুটি নিয়েই দিল্লি যাবেন। পথে কখনও কোনও স্কুলে বা কলেজে আবার কখনও কোনও ক্লাবে চলবে পরিবেশ সচেতনতার ক্লাস। সঙ্গে গাছের চারা, বীজ বিতরণ। আর সবশেষে দিল্লি পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেবেন গাছের চারা।
উপহার হিসেবে এই গাড়িটাই পেয়েছেন এক শুভাকঙ্খীর কাছে। নিজস্ব চিত্র।
তবে মনের গহীন কোণে কোথাও যেন ক্ষোভ জমে রয়েছে ধনঞ্জয়ের। বললেন "শহরটার জন্য আরও অনেক কিছু করতে চাই, সুযোগ পাচ্ছি না। সরকারের কাছ থেকে কোনও সাহায্য নেই। আজ অবধি যা করেছি পুরোটাই নিজের রুজি-রোজগারের টাকায়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে একটা চিঠি দিতে চাই। একবার এক মন্ত্রীর মারফত চেষ্টাও করি, কিন্তু সে চিঠি দিদির কাছে পৌঁছয়নি।"
দিল্লি বহুদূর হলেও পৌঁছে যে একদিন যাবেনই সে বিষয়ে নিশ্চিত ধনঞ্জয় চক্রবর্ত্তী। প্রত্যেক মানুষ কে পরিবেশ নিয়ে আরও সচেতন হতে বলছেন তিনি। আর বলছেন "গাড়ির ছাদে নয়, বাড়ির ছাদে লাগালেই যথেষ্ট। পয়সা লাগে না, একটা আম খেলেই তো গাছ লাগাতে পারবেন।"