অনেক খেলনা, লজেন্স দেখানো সত্ত্বেও কিছুতেই কাছে আসতে চাইছিল না বাচ্চা মেয়েটি। অপরিচিত কেউ তাকে ছুঁতে গেলেই ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে কেঁদে ফেলছিল সে। জোর করেননি শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের সদস্যরা। অপেক্ষা করেছিলেন। অনেক চেষ্টার পরে মধ্য কলকাতার এক বস্তিতে ধারাবাহিক ভাবে শারীরিক নিগ্রহের শিকার বাচ্চা মেয়েটিকে উদ্ধার করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু মেয়েটি এখনও অপরিচিতের স্পর্শের ভয় থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি।
কমিশনের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, এটিই একমাত্র উদাহরণ নয়! ধারাবাহিক ভাবে কমিশনে এমন অভিযোগ জমা পড়ছে, যেখানে স্পর্শ-আতঙ্কে ভুগছে শিশুরা। সে জন্য কমিশনের তরফে ইতিমধ্যেই ‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’ সম্পর্কে সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে স্কুলে স্কুলে গিয়ে প্রচার করার পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এমনকী, ‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’-এর বিষয়টি স্কুল ডায়েরিতে উল্লেখ করার জন্য সিলেবাস কমিটির কাছে কমিশন প্রস্তাবও পাঠাচ্ছে। কমিশনের চেয়ারপার্সন বলেন, ‘‘কে কী ভাবে স্পর্শ করছে, বাচ্চারা সেটা ভালই বোঝে। সেটা বলতে বেশির ভাগ সময়েই তারা ভয় পায়। কিন্তু এটা যে সঙ্কোচের বিষয় নয়, লজ্জার বিষয় নয়, সেটাই আমরা বাচ্চাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। অভিভাবকদেরও এটা বোঝা দরকার। বিষয়টা নিয়ে সরব হলেই এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব।’’
‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’-এর সমস্যা বরাবরই রয়েছে। কিন্তু সেই সমস্যা কি ক্রমশ চিরাচরিত স্নেহস্পর্শের ধারণাকেই ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে? এ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে নানা মহলে। তা হলে কি পাল্টে যাচ্ছে বাচ্চাকে আদরের সংজ্ঞাও? সেখানে শুধু জড়ো হচ্ছে সঙ্কোচ, দ্বিধা আর পারস্পরিক দূরত্ব! অন্যের বাচ্চাকে আদর করার আগে এখন দু’বার ভাবছেন অনেকেই। আগে যেমন অনায়াস যাতায়াত ছিল সম্পর্কের মধ্যে, পাশের বাড়ির কাকুর সঙ্গে পরিবারের শিশুর, যাতায়াতের সেই দরজা কোথাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেও ছায়া ফেলছে সে সঙ্কোচ। অবশ্য তার সঙ্গত কারণও রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক অভিজিৎ কুণ্ডু বলেন, ‘‘শরীর হল মানুষের শেষ দুর্গ। সেই দুর্গেই ক্রমাগত আঘাত আসছে, চারদিক থেকে। ফলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে এখন সাধারণ স্নেহস্পর্শকেও মানুষ সন্দেহের চোখে দেখছে।’’
তবে ইদানীংকালেই যে শুধু বাচ্চাদের শারীরিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে, তা মানতে রাজি নন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। তাঁর বক্তব্য, বরাবরই এমন ঘটনা ছিল। কিন্তু আগে এই ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আসেনি। সমরেশবাবুর কথায়, ‘‘এটাও ঠিক যে, বেশির ভাগ সময়েই অল্প একটু আতঙ্ককে অনেকটা আতঙ্ক করে দেখানো হচ্ছে। তবে তার জন্য স্নেহস্পর্শের ধারণা পাল্টে যাচ্ছে, তা মানছি না।’’
‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’কে আবার আলাদা ভাবে ব্যাখ্যা করছেন মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম। তাঁর বক্তব্য, ‘‘একটা চার বছরের বাচ্চা ‘গুড’ কোনটা, ‘ব্যাড’ কোনটা, সেটা নাও বুঝতে পারে। তাদের যেটা শেখানো উচিত তা হল, কোনটা নিরাপদ, কোনটা নিরাপদ নয়। আমরা যেমন ভাবে সতর্ক হয়ে রাস্তা পার হতে শেখাই বাচ্চাদের বা বাইরের কাটা ফল খেতে বারণ করি, তেমন ভাবেই তাদের এ সম্পর্কে শেখানো উচিত।’’
তবে সম্পর্কের মধ্যে ক্রমাগত জমতে থাকা সংশয়ে, ভয়ে যে নিজেদের হারিয়ে ফেলা উচিত নয়, পারস্পরিক বিশ্বাসের সেতু যে অক্ষুণ্ণ রাখা উচিত, তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এ নিয়ে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবিও তৈরি করেছেন তিনি, যা দিন কয়েকের মধ্যে মুক্তি পেতে চলেছে। শিবপ্রসাদ বলছেন, ‘‘বাচ্চারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সেটা মিথ্যে নয়। কিন্তু তার জন্য হামি বা বাচ্চাদের স্নেহচুম্বনকেও কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে বাচ্চাদের আদরের ধারণা। এটা চলতে দেওয়া যাবে না। কয়েক জন বা কয়েকটি ঘটনার জন্য নিষ্পাপ স্নেহস্পর্শ আমরা ভুলে যেতে পারি না।’’