‘কলকাতার ভালবাসা কি কম পড়িয়াছে’?

সেই অভাবের পরিপূরক ঘৃণা নয়, জীবনের মধ্যেই আরও ভালবাসা খুঁজে নেওয়া। কলকাতার আত্মার মুক্তি ঘৃণায় নয়, কলকাতার উত্তরণ হোক আরও আরও ভালবাসায়।

Advertisement

অনন্যা চক্রবর্তী (চেয়ারপার্সন, শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের)

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৮ ০৩:১৫
Share:

‘দহন’ ছবির সেই দৃশ্য।

মেট্রোর কামরায় ঘনিষ্ঠ হওয়ার ‘অপরাধে’ সহযাত্রীদের হাতে এক যুগলের নিগৃহীত হওয়ার যে ঘটনা এখন আলোচনার কেন্দ্রে, তা মনে করিয়ে দিল ১৯৯২ সালের জুন মাসের সেই সন্ধ্যার কথা। ‘দহন’ ছবিতে যে ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল। সে দিনও ভালবাসার মাসুল গুনতে হয়েছিল এক তরুণ-তরুণীকে। স্বামী-স্ত্রী ফিরছিলেন এক জায়গা থেকে। পথে আক্রান্ত হন তাঁরা। যৌন হয়রানির স্বীকার হন মহিলা। সেই ঘৃণা, তাঁর থেকে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, এড়িয়ে যাওয়ার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু বিশেষ কাউকে পাশে পাইনি। পরে সেই ঘটনা নিয়ে ঝড় উঠেছিল। বাঙালি ধিক্কার জানিয়েছিল নিজেকে। আজও তা-ই হোক। ঘৃণার মিছিল নয়, ভালবাসার মিছিল। ভালবাসার জয়ের মিছিল বার হোক গলিতে গলিতে, পাড়ায় পাড়ায়। আর যাঁরা ওই যুবক-যুবতীর উপরে আছড়ে পড়েছিলেন সে দিন, তাঁদের কাছে একটা প্রশ্ন আছে। আপনারা কি কোনও দিন ভালবাসেননি? আপনাদের জীবনে কি ভালবাসা
কম পড়িয়াছে?

Advertisement

সেই অভাবের পরিপূরক ঘৃণা নয়, জীবনের মধ্যেই আরও ভালবাসা খুঁজে নেওয়া। কলকাতার আত্মার মুক্তি ঘৃণায় নয়, কলকাতার উত্তরণ হোক আরও আরও ভালবাসায়।

বাঙালির অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা এখন চাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের মেয়েরা এখন দেশে-বিদেশে মেডেল পায়। আমাদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছেন বহু ডাক্তার ও বিজ্ঞানী, যাঁরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। আমাদের অর্থনীতিবিদ নোবেল পান, আমাদের সাহসী যুবকেরা সপ্তশৃঙ্গ জয় করেন। জয় করেছি অনেক কিছু। আর জয় করেছি গতিকে। মেট্রো দিয়ে। এখন বাঙালিরা আর ট্রাম চড়েন না। মেট্রো চড়েন। এই গতির দাপটেই কি আমরা কিছু হারিয়ে ফেলছি? গুলিয়ে ফেলছি? আমরা কি হারিয়ে ফেলছি আমাদের ভালবাসার শহরকে? প্রকাশ্যে চুম্বন বা আলিঙ্গন করা যদি অপরাধ হয়, তা হলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হোক কোনার্কের মন্দির। যেখানে প্রস্তরে প্রস্তরে প্রেম খচিত। মেট্রোয় আলিঙ্গনরত নারী-পুরুষকে মারধর করে লাভ কী? আমরা কি ভালবাসতে ভুলে যাচ্ছি? নাকি তার সঙ্গে ভালবাসাকে ভালবাসতেও? কলকাতা কি তা হলে ঘৃণাই বেছে নিয়েছে? এক জাতি অপর জাতিকে ঘৃণা করবে, এক ধর্ম অন্য ধর্মকে? কে শেখাল এই ঘৃণাকে ভালবাসতে? কে শেখাল জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শক্তি, সুনীল, জয় গোস্বামীর ভালবাসার ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করতে?

Advertisement

আজ সময় এসেছে এই প্রশ্ন করার। সমাজকে, পরিবারকে ও নিজেকে। কেন বাঙালি আত্মসমর্পণ করছে ঘৃণার কাছে? এই প্রশ্নের জবাব আমাদেরই দিতে হবে, নিজের কাছে। অপেক্ষায় রয়েছে বনলতা সেন, শুধু সেই মেট্রোর ঘটনায় আক্রান্ত যুবক-যুবতীর জন্য নয়, হাজার বছর নয়, মাত্র সাড়ে তিনশোরও কিছু কম বয়সী কলকাতার আত্মার অবক্ষয়ের প্রশ্নে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement