অপচয়: জল নষ্ট। রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার রোডে, পুরসভার বুস্টার পাম্পিং স্টেশনে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
অদূর ভবিষ্যতে কলকাতায় পানীয় জলের সঙ্কট হবে, এমন আশঙ্কার কথা ইতিমধ্যেই একাধিক রিপোর্টে উঠে এসেছে। প্রতিদিন মাথাপিছু জল খরচের হিসেবে দেশের মধ্যে কলকাতার স্থান প্রথম সারিতেই। অথচ এত দিন জলসঙ্কট আটকানোর জন্য সামগ্রিক কোনও নীতি ছিল না। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশিকা মেনে ভূগর্ভস্থ জল তোলার ক্ষেত্রে একটি নীতি নির্ধারণ করতে চলেছে কলকাতা পুরসভা।
প্রাথমিক ভাবে স্থির হয়েছে, ক্রমাগত জল তোলার জন্য শহরের কোন এলাকায় জলস্তর কত নেমেছে, তার ভিত্তিতে একটি রংভিত্তিক অর্থাৎ ‘কালার কোডেড জ়োনাল ম্যাপ’ তৈরি করা হবে। লাল, কমলা ও সবুজ— এই তিনটি রঙের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলস্তরের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে। ক্রমাগত জল তোলার ফলে যে সব জায়গায় জলস্তর বিপজ্জনক ভাবে নেমে গিয়েছে, সেই এলাকা চিহ্নিত করা হবে লাল রঙে। কমলা রং বোঝাবে, সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলস্তর দ্রুত নামতে শুরু করেছে, যা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। আর সবুজ রং দেখে বোঝা যাবে, ওই এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর ঠিকই রয়েছে।
প্রস্তাবিত ওই নীতি অনুযায়ী, শুধুমাত্র সবুজ রঙে চিহ্নিত এলাকা থেকেই ভূগর্ভস্থ জল তোলার অনুমতি দেওয়া হবে। এক পদস্থ পুরকর্তার কথায়, ‘‘অনুমতি দেওয়া মানে এই নয় যে ইচ্ছেমতো জল তোলা যাবে। সব দিক বিবেচনা করে এবং পরিবেশনীতি মেনেই সীমিত ক্ষেত্রে ওই অনুমতি দেওয়া হবে।’’
ওই ম্যাপ তৈরির জন্য ‘স্টেট ওয়াটার ইনভেস্টিগেশন ডিরেক্টরেট’-এর কাছ থেকে শহরের জলস্তর সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তবে ম্যাপ তৈরির পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়া ঠেকাতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘এলাকাভিত্তিক জলস্তর চিহ্নিত করা ও ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ‘রিচার্জ’, দু’টি বিষয়ই পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। তাই দু’টি কাজই একসঙ্গে করা হবে।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের অধ্যাপক-গবেষক তড়িৎ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘কোনও জায়গায় জলস্তর নামতে থাকলে জলে ফ্লুয়োরাইড, আর্সেনিকের মতো দূষিত পদার্থ মেশার আশঙ্কা বহু গুণ বেড়ে যায়। ফলে সেখানকার জল আর পানযোগ্য থাকে না।’’ জলের ব্যবহারে রাশ না টানলে জলস্তর নেমে যাওয়ার সমস্যা কিছুতেই ঠেকানো যাবে না বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রশ্ন উঠেছে, যতই জল-নীতি তৈরি হোক না কেন, জলকর না বসালে আদৌ কি জল খরচে রাশ টানা সম্ভব? রাশ টানতে যতটা সচেতনতা দরকার, তা-ও এখনও তৈরি হয়নি। আর পুরকর্তাদের একাংশ এ-ও জানাচ্ছেন, জলকর যে নেওয়া হবে না, সেটা রাজ্যের শাসকদলের নীতি। ফলে সেখানে পুরসভার কিছুই করার নেই। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘দ্য সেন্ট্রাল পাবলিক হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং অর্গানাইজেশন’ (সিপিএইচইইও)-এর নির্দেশিকা বলছে, দিল্লি, কলকাতা, মুম্বই-সহ বড় শহরগুলিতে দিনে মাথাপিছু ১৫০ লিটার জলের প্রয়োজন। কলকাতায় মাথাপিছু জলের চাহিদা কত এবং কত জল দৈনিক খরচ হচ্ছে, সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য গত আড়াই বছর ধরে পুরসভার একাধিক ওয়ার্ডে ‘ওয়াটার লস ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প চলেছে। সেই প্রকল্পের তথ্যই বলছে, শহরের কোথাও কোথাও প্রতিদিন মাথাপিছু প্রায় ৬০০ লিটার জল খরচ হচ্ছে! যা নির্ধারিত হিসেবের প্রায় চার গুণ বেশি।
ভূ-পদার্থবিদ তাপসকুমার ঘটক জানিয়েছেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের পাশাপাশি একাধিক সরকারি রিপোর্টেও ধরা পড়েছে, কী ভাবে মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার একটি বিস্তীর্ণ অংশ এবং ইএম বাইপাস সংলগ্ন এলাকায়
ভূগর্ভস্থ জলস্তর ইতিমধ্যেই নেমে গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘রিপোর্টগুলিতে এ-ও দেখা গিয়েছে, শহরের জলস্তর এক মিটার থেকে কোথাও পাঁচ, কোথাও আবার সাত মিটার পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। ফলে জলের ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবে আমরা বড়সড় বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছি।’’