ঢাকার চিত্রালী পত্রিকার হয়ে ছবি তুলতে এক দিন হাজির সত্যজিৎ রায়ের লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে। সেটা ১৯৬২ সাল। দেখলেন, সাদা শাল গায়ে জড়ানো, নিবিষ্ট মনে লিখে চলেছেন সত্যজিৎ। ভয়ে বুক দুরুদুরু, অত বড় এক জন মানুষ কি কথা বলবেন তরুণী আলোকচিত্রীর সঙ্গে, ছবি তোলার অনুমতি তো পরের কথা! একটু পরেই দেখা গেল, সাইদা খানম নামের সে দিনের মেয়েটি বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে কথা জুড়েছেন তাঁর কাঞ্জনজঙ্ঘা ছবি নিয়ে। ফ্ল্যাশ দিয়ে সত্যজিতের ছবি তুলতে ভিতর থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলেন মঙ্কুদি, বিজয়া রায়। রায় পরিবারের সঙ্গে সেই থেকে আলাপ পরিচয়, অন্তরঙ্গতা। সত্যজিৎ রায় প্রথম দু’-তিন বছর তাঁকে ‘আপনি’ বলতেন, পরে বিজয়ার কথায় ‘তুমি’। চিঠি লিখতেন ডাকনাম ‘বাদল’ সম্বোধনে। বিজয়া-সত্যজিৎ তাঁর পরিচয় দিতেন ‘পারিবারিক বন্ধু’ হিসেবে। সামনে থেকে দেখেছেন সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায় বা এইটুকু ছোট থেকে নাতি সৌরদীপকেও।
১৯৬২ থেকে ১৯৯২, ত্রিশ বছর ধরে সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলেছেন সাইদা খানম। ছিলেন মহানগর, চারুলতা, কাপুরুষ-এর শুটিংয়ে। কিন্তু যেমন নিবিড় ভাবে নিমাই ঘোষকে চেনে কলকাতা, বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রীকে চেনে না তত। সাইদা খানমের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর, অবিভক্ত ভারতের পাবনায়। অল্প বয়সেই হাতে পেয়েছিলেন কোডাক বক্স ক্যামেরা, পরে মেজ আপা হামিদা আমেরিকা-ফেরত এনে দেন রোলিকর্ড ক্যামেরা। ক্যামেরা হাতে এক মেয়ে ছবি তুলে বেড়াচ্ছে, গঞ্জনা কম সইতে হয়নি তখন। তবু কুড়ি না পেরোতেই জার্মানির এক প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি। বেগম পত্রিকায় চিত্রসাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অজস্র ছবি তুলেছেন, পাক সেনার মেশিনগানের সামনেও শাটারে হাত কাঁপেনি। জাপান, ফ্রান্স, আমেরিকা, সুইডেনে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে, পেয়েছেন বাংলাদেশের একুশ পদক, নানা আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
তবু তাঁর ছবি নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের প্রশংসাকেই সবচেয়ে বড় সম্মান বলে মনে করতেন সাইদা খানম। রায় দম্পতির সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিল স্বতন্ত্র, অন্তরঙ্গ। তাঁর অনেক ছবিতে ধরা দিয়েছে বিজয়া-সত্যজিতের পারস্পরিক নির্ভরতা— প্রিয় মঙ্কুদির সঙ্গে তাঁর ছবি তুলবেন, বললে না করতেন না সত্যজিৎ। ওঁদের বিবাহবার্ষিকীর ছবিও তুলেছেন। অসুস্থ সত্যজিতের পাশে নার্সিং হোমে বিজয়া রায়, সঙ্গে তিনিও। সত্যজিতের প্রয়াণের পর ঢাকায় এবং পরে ২০০১ সালের ২ মে সত্যজিতের জন্মদিনে কলকাতায় নন্দনে ছবির প্রদর্শনী হয় সাইদার।
তাঁর প্রিয় মানিকদার জন্মশতবর্ষে, ১৮ অগস্ট ঢাকায় প্রয়াত হলেন সাইদা খানম। ঢাকা ও কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগসূত্র ছিলেন তিনি। স্নেহধন্য ছিলেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। প্রদর্শনী করেছেন মাদার টেরিজাকে নিয়ে, তাঁর ক্যামেরায় ধরা দিয়েছেন রানি এলিজ়াবেথ, নিল আর্মস্ট্রং, বঙ্গবন্ধু। ছবি তোলার পাশাপাশি লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, স্মৃতিকথা আমার চোখে সত্যজিৎ (প্রকাশনা: যুক্ত)। বিজয়া-সত্যজিৎ রায়ের ছবিটি সেই বই থেকেই।
ছবি সৌজন্য: নিশাত জাহান রানা
সাধনা
তাঁর গল্প আর পদ্যেরা মন ভরাত সত্তর-আশির দশকের ছোটদের। সাধনা মুখোপাধ্যায়ের (১৯৩৪-২০২০) জন্ম ইলাহাবাদে। সেখান থেকেই দেশ পত্রিকার দফতরে লেখা পাঠাতেন। সত্তরের দশকে লিখেছিলেন রমণী গোলাপ, দোপাটির ইচ্ছে, কবিতার আদালত-এর মতো কাব্য। আনন্দমেলা-র দফতরে যোগ দিলেন, ‘দিদিমণি’ ছদ্মনামে তাঁর ভূগোল বিষয়ক প্রবন্ধগুলি আটপৌরেকে দিত নতুন স্বাদ। তিরিশেরও বেশি বই রান্না নিয়ে, রান্না করে দেখুন বইটি বহু নতুন দম্পতির তাকে উঁকি মারত। প্রচারবিমুখ, অন্তর্মুখী মানুষটি মগ্ন থাকতেন লেখাপড়ায়। ২ সেপ্টেম্বর চিরছুটিতে গেলেন ছুটির গল্প-এর লেখিকা।
রংতুলির শিক্ষক
n ঠিক জায়গায় ঠিক রংটি ব্যবহার না করলে তাকে ‘ডার্টি’ বলে। এ যেন অনেকটা জুতো ঠিক জায়গায় না রেখে বিছানার উপরে রাখা! শিক্ষক অনিল ভট্টাচার্য এ ভাবেই রঙের পাঠ দিলেন ছাত্রকে। ছাত্রটি— গণেশ হালুই। মাস্টারমশাই গোপালবাবুর থেকে প্যাস্টেলে ছবি আঁকার প্রেরণা পেয়েছেন যোগেন চৌধুরী। গণেশ হালুই, যোগেন চৌধুরীর পাশাপাশি গুলাম মহম্মদ শেখ, ইন্দ্রপ্রমিত রায়, কৌশিক মুখোপাধ্যায়, পরেশ মাইতির মতো শিল্পীরা তাঁদের শিল্পগুরুদের স্মৃতিচারণ করেছেন ডিজিটাল শিল্প গ্যালারি আর্টওয়েভ-এর ওয়েবসাইটে। শিল্প-মহলে উঁকি দেওয়া শিক্ষার্থীর যাত্রায় শিক্ষকের ভূমিকা, মাস্টারমশাইদের যাপনচিত্র, আবেগঘন নানা মুহূর্ত সেখানে। শিল্পশিক্ষকদের প্রতি ছবির জগতে লব্ধপ্রতিষ্ঠ ছাত্রদের প্রণতি।
বাতিঘর
n কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়ির রবিবারের আড্ডা বিদ্বজ্জনসমাজে চর্চার বিষয়। রবিবার সকালে তাঁকে ঘিরে ব্যতিক্রমী এই সমাবেশ নথিবদ্ধ করে রাখা জরুরি ইতিহাসের তাগিদেই। সেই কাজকেই এক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে রূপ দিলেন আড্ডার নিয়মিত সদস্য সৌমেন পাল। বইয়ের নাম শঙ্খবাবুর সঙ্গে, প্রকাশক সৃষ্টিসুখ। টুকরো টুকরো মুহূর্তে ধরা পড়েছেন গন্তব্যের মানুষটি। এই আড্ডা আসলে জ্ঞানচর্চার এক অভিজ্ঞান, শ্রীজাতর ভাষায় ‘বাতিঘর’। বিরল এই সঞ্চয়কে কিছু মানুষের জীবন থেকে সমগ্রতায় ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিই করেছেন লেখক। ৫ সেপ্টেম্বর এক অনলাইন অনুষ্ঠানে বইটি প্রকাশ করলেন কবি সব্যসাচী দেব ও শ্রীজাত।
মহাবিশ্বে
n মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে উৎসাহ জাগাতে ‘বিচিত্র পাঠশালা’ সংস্থার আমন্ত্রণে ‘সৌরজগতের নতুন রূপ’ নিয়ে বললেন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও কলকাতার এম পি বিড়লা প্ল্যানেটারিয়ামের অধিকর্তা দেবীপ্রসাদ দুয়ারি। ছবি, স্লাইড দেখিয়ে মহাকাশবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলি বুঝিয়ে দেন তিনি, জানান বহির্বিশ্ব নিরীক্ষণের যন্ত্রপাতি— শক্তিশালী রিফ্লেক্টিভ টেলিস্কোপ ও রেডিয়ো টেলিস্কোপ নেটওয়ার্ক সম্পর্কেও। উঠে এসেছিল সৌরজগতের নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, উল্কা, ধূমকেতু, নেবুলার সৃষ্টিরহস্য ও প্রভাব, গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কুসংস্কার, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্যের প্রসঙ্গও। ‘বিচিত্র পাঠশালা’র ফেসবুক পেজে শোনা যাবে গুরুত্বপূর্ণ এই বক্তৃতাটি।
নতুন গল্প
‘‘নর্থ ক্যালকাট্টাই দুধেল রাবড়ি, সে তো বটেই— তৎসহকারে বাদাম, কিসমিস, আখরোট, আঙুর, শসা, কলা, সরের নাড়ু, চন্দ্রপুলি, তিলকোটা চিঁড়েমুড়ির মোয়া আদি উপাদেয় আহারের সাত্ত্বিক আবাহন বাদে মোটে ঠাঁইনাড়া হতেন না মল্লিকদা। অহোরাত্র সেঁটে থাকতেন ঝুরঝুরে তাঁর মেসবাসার ঝরঝরে তক্তাপোশে।’’ স্ব-উদ্ভাবিত আখ্যানে ফের খেয়াল করিয়ে দিলেন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা কথাসাহিত্যের আধুনিকতা তার ডিটেলস-ভিত্তিতে। পাঠককে তাঁর নতুন দু’টি গল্প পড়ানোর সুযোগ করে দিল হরপ্পা পত্রিকার (সম্পা: সৈকত মুখোপাধ্যায়) সদ্যপ্রকাশিত বৈদ্যুতিন পুস্তিকা সমাবেশে সমাবেশ। গল্পদু’টি— হরবোলা এবং অনিকেত মিত্র ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ। একদা গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্বসমাস: উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য লিখে বাঙালি মননকে তোলপাড় করেছিলেন শিবাজী। গ্রাফিক নভেল, নাটক, উপন্যাস, কবিতা, গল্পে তিনি প্রসারিত করে চলেছেন বাঙালির সৃষ্টিভান্ডার। সোমনাথ ঘোষের শিল্প-নির্দেশনায় শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদ-অলঙ্করণ নান্দনিক করেছে পুস্তিকাটিকে, ছবিতে তারই একটি।
প্রবীণে নবীনে
n আমরা ইতিহাসের প্রহরী, বললেন ইন্ডিয়ান সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট পুষ্পা মিশ্র, ৩ সেপ্টেম্বর ‘বেথুন কলেজ সম্মিলনী'-র শতবর্ষের অনলাইন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠান ভারতের প্রাচীনতম মহিলা কলেজের প্রাক্তনী সংসদ, যাত্রা শুরু ১৯২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, তখন নাম ছিল ‘ওল্ড স্টুডেন্টস গিল্ড’। সম্মিলনীর ওয়েবসাইট নবকলেবরে আসছে শীঘ্রই, সেখানে থাকবে দীর্ঘ অভিযাত্রার ইতিহাস, যা গবেষণারও সহায়ক হবে। অন্য দিকে, অবরুদ্ধ সময়ের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের পত্রিকা প্রবাহ। নিউ নর্মাল জীবনে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি ধরা পড়েছে সুপাঠ্য এই ই-ম্যাগাজ়িনে।
মিলন মহান
n যোগ ও নমাজ দুয়েরই লক্ষ্য মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ। দেহ সচল ও সুস্থ রাখে যোগ, রোগ তাড়িয়ে দেহ-মনের সুস্থিতি গড়ে তোলে। গবেষণায় প্রমাণিত, নমাজ আদতে ‘সাইকোথেরাপি’ও। উচ্চারণের ছন্দে বিশেষ শরীরভঙ্গিমায় মানবসত্তা দ্বেষমুক্ত হয়, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকে কর্মক্ষম। ‘সাজদা’ রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, স্মৃতি ও মনোযোগ মজবুত করে। যোগ ও নমাজের আসনগুলির মধ্যে বহু মিল, মত বিশেষজ্ঞদের। এই সবই জানা গেল মৌলানা আবুল কালাম আজ়াদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ় (এমএকেএআইএএস) কলকাতার ই-সেমিনার সিরিজ়ের সাম্প্রতিক আলোচনায়, বক্তা এমএকেএআইএএস-এর ফেলো ফরহিনা রহমান এবং বিশ্বভারতীর গবেষক রোজিনা খাতুন। অন্য দিকে কলকাতা সোসাইটি ফর এশিয়ান স্টাডিজ়-এর সপ্তম সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ভারতীয় সংস্কৃতি: ঐতিহ্য ও বহমানতা’। রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয় (স্বশাসিত) নরেন্দ্রপুরের অধ্যক্ষ স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানন্দের বক্তব্যে উঠে এল ভারতীয়ত্বের আবহমান উদারবাদের যৌক্তিকতা।
বীরেন্দ্র ১০০
n তিনি আদ্যন্ত ও অহর্নিশ কবি। অথচ কল্পনাতেও কি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভাবতে পারতেন, শতবর্ষ পূর্তিতে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ট্রেন্ডিং’ হচ্ছেন? পৃথিবীর কোন প্রান্তে কোনও একটি ক্ষণে কাউকে নিয়ে কথা বলছেন কিছু মানুষ আর তাই সমাজমাধ্যমে বারংবার ভেসে উঠছে আর থেকে যাচ্ছে ব্যক্তি বা শব্দবিশেষ— তা মাপা যাঁদের কাজ, তাঁরা হয়তো ২ সেপ্টেম্বর অবাক হয়ে দেখেছেন, বঙ্গভূমি থেকে উদ্ভূত ডিজিটাল কলরবে পুনঃ পুনঃ ধ্বনিত হয়েছে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম ও তাঁর কবিতা! কবিতার কাছে দায়বদ্ধ, সমাজ ও সময়-সচেতন তিনি একদা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘...কলকাতার অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার বনে না।...এর কারণ এই নয় যে আমি রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখি। এর কারণ আমি এখনো মনুষ্যত্বকে কিছু মূল্য দিই।’ খিদে-পাওয়া রক্তমাংসের মানুষ, প্রেমের কবিতা লিখতে চেয়ে ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’ নিয়ে বাঁচা মানুষের অস্তিত্বময় তাঁর কবিতা। ১৯২০-তে জন্ম, মৃত্যু ১৯৮৫-তে। তাঁর শতবর্ষে ফেসবুকে কেউ তুলে দিলেন কবির শেষ সাক্ষাৎকার, ভিডিয়ো-অডিয়োয় তাঁর কবিতা পাঠ করলেন অনেকে, আবেগী বহুজনের বীরেন্দ্র স্মরণ-অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘কলমটা আস্ত থাকা চাই’, ‘রাস্তা দখলের ১০০ বছর’ বা ‘আর এক আরম্ভের জন্ম’। শুধু বীরেন্দ্র-চর্চায় নিবেদিত ফেসবুক পেজে সদস্যসংখ্যা সতেরোশো! প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রবীণ-নবীন কবিকুল, প্রবাসী বাঙালি থেকে কবির স্বজন, সকলে স্মরণ করলেন এই শহরের বইমেলায় কবিতাবই হাতে ঘোরা কবিকে।
প্রবাদপ্রতিম
১৯৭০-এর লন্ডনে ইন্ডিয়া অফিসে ঢুকছেন বছর ত্রিশের বাঙালি যুবক, এক সাহেবের সঙ্গে দেখা। দু’-একটা কাজের কথার পর যুবকটি বললেন, আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি! সাহেব হেসে বললেন, হতেই পারে, আমি তো ভারতের শেষ ভাইসরয় ছিলাম! লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটা মজা করে বলতেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব অশোককুমার মুখোপাধ্যায় (১৯৪০-২০২০)। চার দশক বিস্তৃত তাঁর শিক্ষক-জীবন। প্রেসিডেন্সি, হুগলি মহসিন ও টাকি গভর্নমেন্ট কলেজ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৫-এ অবসর। তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আজ কৃতবিদ্য। জোড়া পিএইচ ডি, দু’বার পোস্ট ডক্টরেট অশোকবাবু দায়িত্ব সামলেছেন ইউপিএসসি, ইউজিসি, এনসিইআরটি-তেও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানচর্চার বিবিধ উদ্যোগে গিয়েছেন দেশে বিদেশে। লিখেছেন শতাধিক গবেষণাপত্র, তেরোটি বই, সম্পাদিত একাধিক জার্নাল। অবসরের রসদ ছিল লেখাপড়া। ১৮ অগস্ট প্রয়াত হলেন ছাত্রবৎসল এই শিক্ষক।
রাষ্ট্রসমাজ
n ভারতে ‘রাষ্ট্রসমাজ’ রাতারাতি নয়, গড়ে উঠেছে ধীরে। তার সঙ্গে মিশেছে সংস্কৃতি, আদর্শ, সামাজিক স্তরীভবন। ‘রাষ্ট্র’ শব্দের প্রথম সন্ধান মেলে পরবর্তী বৈদিক যুগে, বোঝাত একটা নির্দিষ্ট জনপদ। উত্তর ভারতে জন্ম নেওয়া ১৬টি মহাজনপদে রাজশাসন যেমন ছিল, তেমনই ছিল গণরাজ্যেরও অস্তিত্ব। ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্ষমতার ভরকেন্দ্র, মগধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যের হাত ধরেই রাষ্ট্রের ধারণা ক্রমশ পুষ্ট হয়েছে ভারতে। ‘রাষ্ট্রসমাজ’ তৈরির এই প্রক্রিয়া নিয়ে সম্প্রতি বললেন ইতিহাসবিদ রণবীর চক্রবর্তী, ‘কারওয়াঁ দ্য হেরিটেজ এক্সপ্লোরেশন ইনিশিয়েটিভ’-এর আয়োজনে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদদের অনলাইন বক্তৃতামালা করছে এই সংস্থা, এর আগে বলেছেন রোমিলা থাপার, হরবংশ মুখিয়া, রাজমোহন গাঁধী প্রমুখ। বাঙালি ইতিহাসবিদের বক্তৃতা সেই আয়োজনেরই পঞ্চম নিবেদন।
রামায়ণে গান
বাল্মীকি রামায়ণে কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের শুরুতে পম্পা সরোবরতীরে রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে বলছেন, বর্ষাভেজা প্রকৃতিতে যেন শোনা যাচ্ছে সামগান— ভ্রমরের গুঞ্জনে, ময়ূরের কেকারবে, আকাশে কালো মেঘের দুন্দুভিধ্বনিতে। অনবদ্য পাঠ ও গানে ‘বাল্মীকি রামায়ণে সঙ্গীত’ শীর্ষক প্রসাদ সেন স্মারক বক্তৃতা দিলেন সুভদ্রা দেশাই। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক প্রসাদ সেনের নামাঙ্কিত এই বক্তৃতার আয়োজন করে আসছে ‘মাস্টারমশাই’-এর হাতে গড়া সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘সোহিনী’র সদস্যরা। পঞ্চম বছরের বক্তৃতা হল অনলাইন, ২২ অগস্ট। প্রসাদ সেনের একদা-ছাত্রী, হিন্দুস্থানি মার্গসঙ্গীত শিল্পী সুভদ্রা দেখালেন, শার্ঙ্গদেবের সঙ্গীতরত্নাকর রচনার বহু আগেই বাল্মীকি কী ভাবে ভারতীয় সঙ্গীতকে সংজ্ঞায়িত করে গেছেন। লব-কুশ রামায়ণগান গাইছেন (ছবিতে), সকলে সাশ্রুনয়ন, চেনা এ দৃশ্যেও লুকিয়ে সঙ্গীত। লব-কুশকে চিনতে অক্ষম রামচন্দ্র তাঁদের দান করেন প্রভূত স্বর্ণমুদ্রা, যা সঙ্গীতকারের প্রতি রাজানুগ্রহের অভিজ্ঞান। সঙ্গীতবেত্তা রাবণও। ধনুকের জ্যাশব্দে সঙ্গীত সৃষ্টি করেন তিনি, যুদ্ধভূমিকে বলেন ‘মহারঙ্গম’। অযোধ্যায় নটনর্তক সংঘ এবং বধূনাটক সংঘের উপস্থিতি তুলে ধরে সে কালের সঙ্গীতচিত্র। বাল্মীকি রামায়ণে আছে পাণিবাদকদের উপস্থিতি, মৃদঙ্গ, মুরজ, ভেরী, পটহের মতো বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ, তন্ত্রী অর্থাৎ তারযন্ত্রের ব্যবহার, মার্গীয়, দেশীয় ও গান্ধর্ব সঙ্গীতের কথা— জানালেন সুভদ্রা। ‘সোহিনী’র ইউটিউব চ্যানেলে শোনা যাবে বক্তৃতাটি। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
মনের ভ্যাকসিন
ভাইরাস ভয় বিছিয়েছে মনেও। উপচে উঠছে অবসাদ, আত্মহত্যার পরিসংখ্যান। অঞ্জলি মানসিক স্বাস্থ্য সংগঠনের উদ্যোগে এক ডিজিটাল আলোচনায় আত্মহত্যা নিয়ে কিছু ধারণা শোধরালেন সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় ও মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যক্তিগত অন্ধকার মেলে ধরলেন কিছু অনামা মানুষ, তাঁদের হাত ধরলেন মনোবিদ। অন্য এক ওয়েবিনারে মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বললেন, বন্দি দশা ও জীবিকা সঙ্কট এনে মানসিক ক্ষত সৃষ্টি করছে অতিমারি। বয়স্কেরা অসহায়, ঘর ও অফিসের চাহিদায় দিশেহারা নারী। ‘একক মাত্রা’-র অনলাইন অনুষ্ঠানে ডা. সুব্রত গোস্বামী বোঝালেন, এই ভাইরাস বিভীষিকা নয়। চিকিৎসাব্যবস্থাও প্রস্তুত। স্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মী উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস, মনের সংক্রমণ রুখতে চাই সংবেদনশীলতার চর্চা। মনখারাপের সেটাই ভ্যাকসিন!
মাস্টারমশাই
শিক্ষক দিবসে দিনভর সাষ্টাঙ্গ মহানগরবাসী। জীবন গড়ে-দেওয়া স্যর-দিদিমণি-মিস-ম্যামরা পেলেন আপ্লুত শ্রদ্ধার্ঘ্য। পাশাপাশি হাওয়ায় ভাসছে বাঙালির আলাদা শিক্ষক দিবসের বেলুনটি: বিদ্যাসাগরের জন্মদিনটি বাঙালির শিক্ষক দিবস নয় কেন? বা, আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের? এ জিনিস আজকের ভারতে চাগিয়ে-ওঠা প্রবল জাতি-অস্মিতার ফল কি না, সে নিয়ে চর্চা হতে পারে। ওঁরা হয়তো শুনলে চোখ পাকিয়ে বলতেন, ‘‘অশিক্ষিত!’’
খাইবার পাস মেলে নাই মেলে নাই
হাইকোর্ট পাড়ায় নামজাদা টেম্পল চেম্বার্সের নীচের রোয়াকে এখন তালা ঝুলছে। সেই সাড়ে তিন হাত জমির অধীশ্বর কামতা সিংহের আর ফেরা হয়নি।
মুচমুচে কচৌরি, পকোড়ি, সমোসা চাট কিংবা জলেবিতে যিনি হেলায় মিশিয়ে দিতেন খানিক ‘অ্যাটিটিউড’ও। সাবেক বাংলায় ‘মেজাজ’ বললে যার পুরোটা বোঝা যাবে না। গত ছয় দশক ধরে কলকাতার এই তল্লাটের বয়ে চলার সাক্ষী কামতা লকডাউনের ঠিক আগে প্রয়াত হয়েছেন। সে-দিন বিকেল অবধিও নিজস্ব তখতে পা মুড়ে শিঙাড়া-কচুরি ভেজেছিলেন বৃদ্ধ। লিলুয়ার ডেরায় ফেরেন খোশমেজাজেই। কামতার বেটা ধর্মেন্দ্রর ফোনে চটুল ভোজপুরি গান। বাবার কথা উঠতে শুধু বললেন, ‘‘পিতাজির লাক ভাল, হোলির আগে এক বার বিহারের অওরঙ্গাবাদে গাঁও ভি ঘুরে এসেছেন। লকডাউনের মতোই কোনও নোটিস না-দিয়ে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক। সব শেষ।’’
‘‘এক ঘণ্টা ওয়েট করে এখন একটা অর্ডার মিলছে!’’ ব্যাজারমুখো রাইটার্সের পিছে লায়ন্স রেঞ্জের ফুটপাতে স্যান্ডউইচ-কারবারিও। আইটেম কমসম করে স্রেফ আলু, কর্ন আর চিজ চিলির পুর পাউরুটিতে গ্রিল করার বন্দোবস্ত রেখেছেন। পাশেই চন্দননগরের মিষ্টি-গাড়ি, কাচের শো-কেসে লোভনীয় লর্ড চমচম দরবেশের চিরকালীন উপস্থিতি অদৃশ্য। উল্টো ফুটপাতে বিখ্যাত মালাই টোস্টের ঠিকানারও ঝাঁপ বন্ধ।
তালাবন্দির আগল খুলে যতই আনলক-পর্বে পা রাখুক এই মহানগর, এখনও যেন রসনার আড় ভাঙেনি ঠিক। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের কাঞ্জিবড়া বা চানা ভাটুরা, ম্যাডান স্ট্রিটে অনিয়ন দোসা, মিশন রোয়ের ডিম-ভাত বা এসপ্ল্যানেড ইস্টের মথুরা পেঁড়া ফিরলেও আমজনতার সাহস কিন্তু ফেরেনি তত।
‘খাওগলি’ ডেকার্স লেনের ফুটপাতের সৈনিকরাও অনেকেই নেই। দাস কেবিনের সিগনেচার খাবার মেটে কষা-রুটিও কি কোভিড-শহিদের লিস্টে? উল্টোনো চেয়ার-টেবিল দেখলে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। ভরবিকেলে চাউমিন, চিলি চিকেনের জন্য মরিয়া হাঁক দিতে দিতে এক সময়ে মাস্কটা খুলে ফেলেন স্যান্ডো গেঞ্জিধারী বৃদ্ধ মন্টু হালদার। ‘‘এ ভাবে চলে! আর পারছি না, দম আটকে আসছে!’’ লকডাউনে তিন মাস বসে যাওয়ার পরে ভাইরাস-ভয় শিকেয় তুলে নিরুপায় হয়ে পথে নেমেছেন। দু’পা অন্তর ধাক্কা খাওয়া গলির সেই জটলা এখন উধাও। প্রণব ঘোষের ভাতের হোটেলে চেনা ফোড়নের গন্ধ তবু আদর করে ভরদুপুরে। খেজুরির কর্মচারী চেঁচান, শুধু চারাপোনা— কাতলা বা কোনও ফ্যান্সি মাছ নেই। ডায়মন্ড, কাঁথি, লক্ষ্মীকান্তপুর, রামনগরের কর্মচারীরা অর্ধেক হারিয়ে গিয়েছেন লকডাউনে। অফিস-বাবুরাও গায়েব।
প্রবাদপ্রতিম চিত্তদার ভাইপো সন্দীপ রায় তবু ডাকেন, ‘‘অন্তত এক কাপ চা তো খাবেন! ডাস্ট আর লিভস মিশে কী ফাটাফাটি ফ্লেভার!’’ দোকানের কর্মচারীরা নিয়ম করে তুলসীপাতা, মরিচ, মুলেটির টোটকা খাচ্ছেন ফি-রাতে, ওষুধে গার্গল। আর চুড়ো-করা মুরগির ঠ্যাং, চাউমিনের পাহাড় জমে অপেক্ষায়— রূপকথার পালঙ্কে রাজকন্যের মতো। এসো আয়ু ফুর্তি নেশা! মহামারি দূরে ঠেলে জেগে ওঠো জীবনের কথকতা।