যখনই প্রয়োজন হয়েছে, শিল্প জুগিয়েছে প্রতিবাদের ভাষা। আবার আশার আলোও। আশা ও আশঙ্কায় মেশা ভারতের স্বাধীনতার উত্তাল কালপর্বের পূর্বাপর ইতিহাস ফুটে উঠেছে চিত্তপ্রসাদের (১৯১৫-১৯৭৮) ছবিতে। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-র (সিপিআই) সদস্য, কর্মী ও শিল্পী চিত্তপ্রসাদ তেতাল্লিশের মন্বন্তর থেকে শুরু করে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময়কালকেও ধরেছেন স্পষ্ট ও সাহসী স্কেচ ও ব্যঙ্গচিত্রে, এঁকেছেন সাধারণ মানুষের খিদে, পরিযাণ, মৃত্যু, রোজকার প্রতিরোধ ও যন্ত্রণাকে। এক সময় দল ছেড়েছেন, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সংহতি অনুসন্ধানের পথ ছাড়েননি কখনও। পারিবারিক ‘ভট্টাচার্য’ পদবি বর্জন করেছিলেন। ক্রমশ ঝুঁকেছেন অন্তরঙ্গ ও ব্যক্তিগত রাজনীতি-পরিসরে, কাজ করেছেন পুতুল নাটক ও গল্প নিয়েও। তেলরং নয়, কাগজ-কালির মাধ্যমকেই আপন করে নিয়েছিলেন, মতাদর্শগত ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বেঙ্গল স্কুল-এর ধ্রুপদী আঙ্গিক। দক্ষ ছিলেন লাইনোকাট, উডকাট মাধ্যমেও।
মানুষের জন্য, মানুষের পাশে শিল্প— এই বিশ্বাস-আশ্রয়ী চিত্তপ্রসাদের ছবিকে এই সময়ের কাছে পৌঁছতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা ও দিল্লি আর্ট গ্যালারি (ডিএজি) মিউজ়িয়ামস আয়োজন করেছে আন্তর্জালিক চিত্র প্রদর্শনী ‘পিপল’স আর্টিস্ট চিত্তপ্রসাদ: ইন সলিডারিটি, ইন সলিচিউড’। শুরু হয়েছে অক্টোবরেই, ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত দেখা যাবে ডিএজি মিউজ়িয়ামস-এর ওয়েবসাইটে। শিল্পীর স্মরণে হয়েছে কয়েকটি অনুষ্ঠানও, ‘মানুষের শিল্পী’ বিষয়ে অানিয়া লুম্বার প্রস্তাবনা, তপতী গুহঠাকুরতার সঞ্চালনায় সংযুক্তা সুন্দরেসান-এর পার্টিসান ইসথেটিক্স বই নিয়ে আলোচনা, ছোটদের জন্য কর্মশালা। প্রাগের ন্যাশনাল মিউজ়িয়ামে আছে চিত্তপ্রসাদের ছবি, শিল্পী ও চেক প্রজাতন্ত্রের সংযোগ নিয়ে আজ সন্ধে ৭টায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ফেসবুক পেজে লাইভ অনুষ্ঠানে বলবেন ইতিহাসবিদ সিমোন ভিলে।
সেতুবন্ধ
গণসাহিত্য, সংবাদ সাময়িকী, কালি ও কলম পত্রিকার খ্যাতিমান সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত (১৯৪৫-২০২০)। একাত্তরের কলকাতায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে, কাজ করেছেন সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে। ’৭২-এ কলকাতায় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী মেলায় সাড়া ফেলে তাঁর লেখা নৃত্যনাট্য লাল গোলাপের জন্য, প্রশংসা করেছিলেন বিষ্ণু দে, দেবব্রত বিশ্বাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মায়া সেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা বিপুল, অরুণ সেনের সঙ্গে সম্পাদনায় কয়েকটি বই বেরিয়েছে কলকাতা থেকে। দুই বাংলার লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে ছিল হৃদ্যতা, বাংলাদেশের বইপত্র নিয়ে নিয়মিত লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। লিখেছেন চারটি কাব্যগ্রন্থ, এ ছাড়াও কিশোরপাঠ্য ও প্রবন্ধের বই, আত্মজীবনী। পঁচাত্তর বছর বয়সে প্রয়াত হলেন গত ১ নভেম্বর।
আবুল হাসনাত। ছবি সৌজন্য: আশফাক খান।
কবিতার চেয়ার
আরব সাগরের উপর মেঘ জমেছে। সমুদ্রের রং পাল্টাচ্ছে। মুম্বইয়ে বর্ষার এই রূপ দেখে মনে হয়েছিল, সমুদ্রের দিকে মুখ করা একটা চেয়ার যদি থাকত! ২০১২-র জুনে এল এক মেহগনি কাঠের রকিং চেয়ার, সঙ্গে আঁটা এক ফালি ডেস্ক। চেয়ারে বসে সমুদ্রতীরের অ্যাপার্টমেন্টের খোলা জানলা দিয়ে তাকালে কল্পনা উড়াল দেবেই। লেখা হল বই, আঁকা হল ছবি। ২০১৭-এ সেই চেয়ার এল কলকাতায়, এক সন্ধ্যায় কবিরা একে একে ওই চেয়ারে বসে কবিতা পড়লেন। ‘চেয়ার পোয়েট্রি ইভনিং’-এর সেই শুরু। তার পর থেকেই প্রতি বছর উৎসবে সারা পৃথিবী থেকে কবিরা আসেন। এ বছর উৎসব আন্তর্জালে, ১ থেকে ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় কবিতা পড়লেন আমেরিকা, ব্রিটেন, ইজ়রায়েল, ম্যাসিডোনিয়া, এস্টোনিয়া, ইটালি, ভারতের কবিরা।
মৃত্যুহীন প্রাণ
৫ নভেম্বর ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) জন্মের সার্ধশতবর্ষ। ‘ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব পিপল’স মুভমেন্টস’ (এনএপিএম) পশ্চিমবঙ্গ এ দিন এক আন্তর্জালিক আলোচনায় স্মরণ করল তাঁকে। তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার উদ্ধৃত করলেন মৌলানা ভাসানীকে, যিনি বলেছিলেন, ‘‘দেশবন্ধু ’৪৭-এ থাকলে বাংলা ভাগ হত না।’’ বিপ্লবীদের আইনি সহায়ক হিসেবে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা, ‘স্বরাজ্য’ দল গঠন, কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র হিসেবে কাজ— উঠে এল গবেষক অভিষেক রায়ের কথায়। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যে ১৯২৩-এ দেশবন্ধুর ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর গুরুত্ব অনুভূত প্রায় শতবর্ষ পরেও, বোঝালেন সমাজকর্মী তায়েদুল ইসলাম। প্রাক্তন সাংসদ দেবপ্রসাদ রায় বললেন কংগ্রেস দলে দেশবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে। সাম্প্রদায়িকতায় দীর্ণ আজকের দেশ ও সমাজে এক ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’-এর প্রাসঙ্গিকতা উঠে এল আলোচনায়।
অগ্রণী তিন
প্রায় ৬৫০ পৃষ্ঠার শারদীয়া ১৪২৭ কথা সোপান পত্রিকার (সম্পা: সুস্মিতা জোয়াদ্দার মুখোপাধ্যায়) আকর্ষণ বঙ্গবন্ধু, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে তিনটি ক্রোড়পত্র— অতিথি সম্পাদক গৌতম রায়, হিন্দোল ভট্টাচার্য ও সুশীল সাহা। ‘বঙ্গবন্ধু’ ক্রোড়পত্রে আছে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুফিয়া কামাল থেকে আনিসুজ্জামান, সৌরীন ভট্টাচার্য, পবিত্র সরকারের লেখা। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিজীবন ও ভাবনাবিশ্বের সন্ধানী প্রবন্ধগুলি রসজ্ঞদের নাড়া দেবে। ‘সত্যজিৎ রায়’ ক্রোড়পত্রে তিন কন্যা থেকে চারুলতা-কে অন্য আলোয় ফিরে দেখা, সত্যজিতের ছড়া ও সঙ্গীত নির্মাণ নিয়ে প্রবন্ধ। আছে সম্প্রতি প্রয়াত আলোকচিত্রী সাইদা খানমের স্মৃতিকথা ‘স্মৃতি সত্তায় সত্যজিৎ’।
বিয়ের দিনে ঋত্বিক-সুরমা। ছবি সৌজন্য: ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট।
সত্যের মুখোমুখি
বেঁচে থাকলে পঁচানব্বই বছর বয়স হত তাঁর। ৪ নভেম্বর জন্মদিন ছিল ঋত্বিককুমার ঘটকের, পুরাণকল্প মহাকাব্য বা লোকশিল্পের প্রয়োগে ভারতীয় সিনেমার শিল্পরীতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন তিনি। ঋত্বিক-চর্চায় উদ্যোগী ‘দৃশ্য’ সংস্থার আয়োজনে তাঁর জন্মদিনে ‘ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ বক্তৃতায় ঋত্বিকের শিল্প-অভিপ্রায়ের নানা দিক নিয়ে বললেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়: “চলচ্চিত্রের যে বাস্তব প্রত্যক্ষের উপস্থিতি দেয়, তারও অতীত কোনও সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন ঋত্বিক, ইতিহাসকার বা দার্শনিকের মতো।” তাঁর মতে “ছিন্নমূল মানুষের সমস্যা নিয়ে ছবি করেছেন, এ কথা আংশিক সত্য ঋত্বিক সম্পর্কে, আদতে তিনি আত্মচ্যুতির সময় মানুষের অবস্থান নির্ণয় করতেন।” জীবনের নিজস্ব সত্যকে, সুরমা ঘটকের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও অসীম শিল্পনিষ্ঠায় দার্শনিক সত্যে উত্তরণের প্রয়াস করেছেন ঋত্বিক।
বঙ্গবন্ধু স্মরণে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) কলকাতা-সংযোগ তাঁর ছাত্রজীবন থেকে। পড়েছেন ইসলামিয়া কলেজে (এখন মৌলানা আজাদ কলেজ), ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ পড়ার সময় থেকেছেন বেকার হোস্টেলে। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে গত কাল ৮ নভেম্বর ‘বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক দর্শন’ নিয়ে আন্তর্জাল-আলোচনার আয়োজন করেছিল কলকাতার ‘ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ়’ ও ঢাকার নাগরিক-মঞ্চ ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’। ছিলেন দুই বাংলার রাজনীতি, কূটনীতি ও শিক্ষাজগতের বিশিষ্ট মানুষেরা। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা কী, ১৯৭৫-এ তাঁর চলে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতিকে কী ভাবে প্রভাবিত করেছে, ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় ভারত ও বাংলাদেশ কোন পথে এগোচ্ছে, উঠে আসে এই প্রসঙ্গগুলি।
হেমন্তিকা
বাতাসে হালকা শিরশিরানি, রাস্তার আলো ঘিরে কুয়াশার আস্তর— বহু বছর পরে কলকাতায় হেমন্ত এমন স্বপ্রকাশ, মৃদু ও মধুর। লকডাউন মিটলেও শহর এখনও থমকে, তাই কি হেমন্তও ফিরেছে তার বিষণ্ণ মন্থরতা নিয়ে? অনেকে পাচ্ছেন শৈশবের ঘ্রাণ, যখন বাঙালির দিওয়ালি ছিল না, কালীপুজো ছিল, ছিল সেই দীপাবলির রাত্রের হিম। অনেক না পাওয়ার বছরে এই নিঃশব্দ পাওয়াটুকুই বা কম কী!