ছবি: সংগৃহীত।
পুরনো কলকাতার বিখ্যাত আট জন বাবুর অন্যতম, হাটখোলা দত্তবাড়ির তনু দত্ত নাকি উঠোনে গোলাপজল ছিটোতেন আর জলশৌচ করতেন আতর দিয়ে! আঠারো-উনিশ শতকের বাবুদের শৌখিনতা ও ব্যয়বহুল জীবনশৈলীর অন্যতম সূচক ছিল আতরের ব্যবহার।
শৌখিনতা ছাড়াও, সম্মান প্রদর্শনেরও উপকরণ ছিল আতর। ১৮২৩ সালে বাবু হরিমোহন ঠাকুরের উদ্যানবাটী দেখতে এসেছিলেন সস্ত্রীক বিশপ রেজিনাল্ড হেবার। বাগান দেখে ফেরার সময় গৃহস্বামীর পক্ষ থেকে অতিথিদের হাতে উপহার হিসাবে তুলে দেওয়া হয়েছিল পুষ্পস্তবক ও আতর। সাহেবদের মধ্যেও আতর উপহার দেওয়ার প্রথার প্রচলন ছিল। ১৮২২ সালের সমাচার দর্পণ-এর খবর থেকে জানা যায় যে, বিচারপতি ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট দেশে ফেরার আগে তার সঙ্গে দেখা করতে আসা ছাত্রদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন পান ও আতর।
অভিজাত শ্রেণির কাছে আতরের কদর তার বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। ষোড়শ শতকে পর্তুগিজরা বাংলার আঞ্চলিক শাসককে সন্তুষ্ট করে ব্যবসার অনুমতি পেতে প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে মুর জাহাজ থেকে লুঠ করা কয়েক পেটি গোলাপ আতর দেখে নবাব প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিলেন।
চন্দন তেলের উপর মহার্ঘ ফুল-সহ নানা সুগন্ধি-নির্যাস মিশিয়ে তৈরি হয় আতর। পারফিউমে সেই ‘বেস’ তৈরি হয় অ্যালকোহল দিয়ে। তাই দাম ও গুণমানে আতরের সঙ্গে পারফিউমের পার্থক্য হয়ে যায়। আতরের গন্ধ পারফিউমের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়। আতর-শৌখিনরা ঋতুভিত্তিক সুগন্ধ নির্বাচন করেন। যেমন শীতে মাস্ক আর গ্রীষ্মে জুঁই বা জেসমিন। ঠিক সে ভাবেই দিনের কোন সময় কেউ তা ব্যবহার করবেন, তার উপরেও নির্ভর করে উদ খস, হায়াত, মাস্ক, কেওড়া, মোগরা, শাম্মা বা গুলাবের মধ্যে থেকে বেছে নেন রসিকরা। দামি আতরের মধ্যে জনপ্রিয় হল ‘উদ’।
উনিশ শতকের শেষ দিকে বাজারে কৃত্রিম সুগন্ধি এসে গেলেও, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বিক্রি হত দেশি আতর। আজও কলকাতার প্রাচীন আতরের দোকানিরা সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ বা নুরুল হাসানের পছন্দের আতর নিয়ে গল্প শোনান। এই সূত্রে মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের আতরপ্রীতির কথা বলতে হয়। প্রতিদিন বেড়াতে যাওয়ার সময় পছন্দমতো আতর নিজে মাখতেন, নাতিদেরও মাখাতেন তিনি। তাঁর ছিল রত্নখচিত একাধিক সোনার তৈরি আতরদান।
ধর্মীয় কারণে অ্যালকোহল ব্যবহার নিষিদ্ধ বলেও পারফিউমের বদলে আতর ব্যবহার করেন অনেকে। পার্বণের সময় অনেকটা বেড়ে যায় আতরের বিক্রি। বিশেষ করে ইদের সময় উৎসবের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে কলুটোলার আতরের (ছবি) ছোট-বড় দোকানে চূড়ান্ত ব্যস্ততা দেখা যায়। তবে দুর্গাপুজোতেও শোভাবাজার রাজবাড়ির সামনে বসা আতরওয়ালার থেকে আতর কেনেন অনেকে। পুজো কিংবা ইদ— আতরের খুশবুতে ফিরে আসে এক ঝলক সে-কালের শৌখিন কলকাতা।
স্মরণে সুচিত্রা
নিজের শর্তে সিনেমায় অভিনয়, নিজের ইচ্ছাতেই তাকে বিদায়। রুপোলি পর্দা আর তার বাইরের নিজস্ব জীবন মিলিয়েই তিনি ‘মহানায়িকা’। আজ, ৬ এপ্রিল সুচিত্রা সেনের জন্মদিন, আইসিসিআর-এর অবনীন্দ্রনাথ গ্যালারিতে শুরু হচ্ছে প্রদর্শনী ‘সুচিত্রা’। গ্যালারি ভরা তাঁর স্মৃতি: সিনেমার অরিজিনাল পোস্টার, বুকলেট, গানের বই, সুচিত্রার করা গানের রেকর্ড; বিজ্ঞাপন, ম্যাগাজ়িন কভার, সিনেমার স্থিরচিত্র। এই সম্ভারের অনেক কিছুই— বিশেষত পোস্টারগুলি সুদীপ্ত চন্দের সংগ্রহ থেকে, পুরনো দিনের ছবির হাতে-আঁকা ডিজ়াইনের পোস্টার ও সেই সঙ্গে ফিল্ম প্রচার-উপকরণ সংগ্রহে বিশেষ আগ্রহ ওঁর। সঙ্গে সহযোগিতায় সুরজিৎ কালা, তাঁর উদ্যোগে প্রকাশ পাবে নতুন বাংলা বছরের ক্যালেন্ডারও, সুচিত্রা-অভিনীত ছবির পোস্টারেই সেজে-ওঠা। গুণিজনের উপস্থিতিতে প্রদর্শনী উদ্বোধন করবেন সুচিত্রা-তনয়া মুনমুন সেন, দেখার সুযোগ আগামী ১২ এপ্রিল পর্যন্ত। ছবিতে আমার বৌ সিনেমার পোস্টার, সুদীপ্তর সংগ্রহ থেকে।
ছবি: সংগৃহীত।
নও আড়ালের
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণদিন চলে গেল। বিদায় নয়, বরং জন্মশতবর্ষে তাঁকে চির আবাহনেই গতকাল সন্ধ্যায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মেমোরিয়াল ট্রাস্ট-এর উদ্যোগে বাংলা আকাদেমিতে ছিল ‘কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা’। বললেন তাঁর ছাত্রী, শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে, সুরে কথায় স্মরণে মেদুর সন্ধ্যা। মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নিবেদনে আর একটি অনুষ্ঠান ৭ এপ্রিল শান্তিনিকেতনে, ‘আনন্দধারা’য়। গান গাইবেন রেজওয়ানা, বাংলাদেশের রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘সুরের ধারা’র শিল্পীরা, শান্তিনিকেতনের ‘কণিকাধারা’র ছাত্রছাত্রীরা: এই অনুষ্ঠানেই শুরু হবে শিল্পীর প্রতিষ্ঠিত ‘কণিকাধারা’র নতুন করে পথ চলা। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র-সংস্কৃতি পাঠে আগ্রহীরা ভর্তি হতে পারবেন।
পদ্মাপারের ছবি
বাংলাদেশের বই আর বইমেলার মতোই, বাংলাদেশের সিনেমা নিয়েও বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে এই সময়ের কলকাতা। সম্প্রতিকালে কয়েকটি সিনেমার বাণিজ্যিক ও বিশেষ প্রদর্শনে ভিড় পড়েছিল উপচে, সমাজমাধ্যমেও ফিল্মপ্রেমীরা রীতিমতো আলোচনা করেন পদ্মাপারের ছবি নিয়ে। এ বার সুবর্ণসুযোগ— শহর কলকাতায় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব’, শুরু হয়েছে সল্ট লেকের ঐকতান (ইজ়েডসিসি)-তে গতকাল। বিধাননগর ফিল্ম সোসাইটি ও ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া-র পূর্বাঞ্চলীয় শাখার আয়োজন, সহায়তায় পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ৫-৭ এপ্রিল বিকেল ৪টা ও ৬টায় দু’টি করে ছবি: মায়া দ্য লস্ট মাদার, পাপ-পুণ্য, বিউটি সার্কাস, পায়ের ছাপ, সাঁতাও ও দামাল।
কলমের মেলা
খোয়া যাওয়া শখের ঝর্না কলম ফেরত পেয়ে রবীন্দ্রনাথ আনন্দে বলেছিলেন, “এই তো আমার সাধের কলম!” তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একটা কলমে মাত্র একটাই উপন্যাস লিখতেন, তার পর প্রিয় কলমটিকে সযত্নে তুলে রাখতেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপহারে পাওয়া শৌখিন সোয়ান কলম দিয়ে এত লেখালিখি করতেন যে, অতিব্যবহারে কলমের নিব-জিপ বেরিয়ে এলেও সুতো দিয়ে তা এঁটেই লেখার কাজ চালিয়ে যেতেন! আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলম সংগ্রহের নেশা তো সবার জানা। এ বার সাধারণ মানুষের কলমপ্রীতি বাড়ানোর লক্ষ্যে ১২ থেকে ১৪ এপ্রিল আইসিসিআর-এ, পেন মহোৎসব আয়োজন করেছে কিশলয় ইভেন্টস ও পেন ক্লাব, দু’হাজারের বেশি ফাউন্টেন পেন নিয়ে। এই নিয়ে তৃতীয় বছর।
জামদানি-কথা
জামদানি কি শুধু শাড়িই এক? এক-একটা শাড়ি যেন নদীর মতো, তার বুকের আর দু’পাড়ের মানুষ, প্রকৃতি, জীবনের গল্প বলে কারুকাজে। শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ে ভেজা নারায়ণগঞ্জ, তার মাটি জল হাওয়ায় জন্ম সেই শাড়ির— ‘উস্তাদ’দের মনের কল্পনায় উড়াল দেয় তার আঁচল, শত শত সহকারীর হাতের গুণে ফুটে ওঠে তার জমিনের অলঙ্করণ। এ স্রেফ পরিধেয় বস্ত্রখণ্ড নয়, বাঙালির বয়নশিল্পের এক গৌরব-ইতিহাস, সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কলকাতার বুকে জামদানি শাড়ির সগর্ব সফর নিয়ে এ বার প্রদর্শনী আয়োজন করেছে লেক টেম্পল রোডের ‘ছবি ও ঘর’ আর্ট গ্যালারি, ‘জামদানি: থ্রেডস অব এলিগেন্স’। আজ বিকেল ৫টায় গুণিজন-সমাগম, উদ্বোধন করবেন অলকানন্দা রায়। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত, ৩টে থেকে রাত ৮টা, মঙ্গলবার বাদে।
পটচিত্রে ফেরা
বছর ষাট আগে ম্যানগ্রোভ, রয়্যাল বেঙ্গলের পাশে সহাবস্থান ছিল সুন্দরবনের পটচিত্রের, তাতে ফুটে উঠত মনসামঙ্গল চণ্ডীমঙ্গল রামায়ণ মহাভারত বনবিবির পালা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা মুছে যাচ্ছিল; গবেষকদের মতে, সেখানকার রাজা-রাজড়ার সংস্কৃতির অভাবই তার কারণ। কলকাতা সোসাইটি ফর কালচারাল হেরিটেজ বেশ কিছু দিন ধরে এই পটচিত্রের সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে কাজ করছে, সুন্দরবনের চল্লিশ জন প্রান্তিক মহিলাকে প্রশিক্ষিত করে ফিরিয়ে এনেছে পটচিত্র-চর্চায়। ছবির বিষয় এখানকার জীবন-অনুষঙ্গ: জল, জঙ্গল, বনবিবি, দক্ষিণ রায়, বাঘ, বাগদা। কাচের বোতল, মৃৎপাত্র, ফুলদানি, টি-শার্টেও ছবি আঁকছেন ওঁরা। এ বার এই সংস্থা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দক্ষিণ ২৪ পরগনা বন দফতরের উদ্যোগে মেয়েদের আঁকা পটচিত্রের (ছবি) প্রদর্শনী গ্যালারি গোল্ডে। ৯ থেকে ১১ এপ্রিল, দুপুর ৩টা-রাত ৮টা।
ছবি: সংগৃহীত।
যোগাযোগ
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিরক্ষামূলক নানা কাজের ভার ন্যস্ত শরৎ সমিতির উপর। অশ্বিনী দত্ত রোডে বাসভবন সংস্কারের পর শুরু হয় পাঠচক্র, সাহিত্য-আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান— চলছে এখনও। রবীন্দ্রনাথ-সহ তখনকার বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠেরা এসেছেন এখানে; প্রাঙ্গণে ঢুকতে চোখে পড়ে কাচের শো-কেসে আবক্ষ মূর্তি— শরৎচন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা বিশিষ্টজনের। এই ধারাতেই, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষে আগামী ১২ এপ্রিল তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি (ছবি) বসবে এখানে। সাহিত্যরসস্নিগ্ধ মন ছিল রাখালদাসের, লিখেছিলেন পাষাণের কথা উপন্যাস। সন্ধ্যায় তাঁর জীবনকৃতি নিয়ে আলোচনা, বলবেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম রায় ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌত্র দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: সংগৃহীত।
ভাষার প্রেমে
স্প্যানিশ ভাষাকে তিনি বলেন প্রেমিকা। ১৯৬৬ থেকে ভাষা শেখা শুরু: আংশিক সময়ের পাঠক্রম, ইন্দো-আমেরিকান সোসাইটি, রামকৃষ্ণ মিশনে; তার পর কাজ করতে করতে। অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগ থেকে অবসরের পর বেশির ভাগ সময় তরুণ কুমার ঘটক নিবেদন করেন ভাষাচর্চায়। স্প্যানিশ পড়িয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইএম, ইন্ডিয়ান পেটেন্ট অফিস-সহ নানা পরিসরে। প্রথম বই স্পেনের গল্পগুচ্ছ; সেরভান্তেসের কালজয়ী গ্রন্থ দন কিহোতে দে লা মাঞ্চা-র অনুবাদ দু’খণ্ডে প্রকাশিত স্পেনীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অনুদানে, এরই জন্য পান পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘লীলা রায় স্মারক পুরস্কার’। অনুবাদ করেছেন প্রায় ৪৫টি বই: লোরকা, নেরুদা, গার্সিয়া মার্কেস, লেয়োপোলদো আলাস, পিও বারোহা, বেনিতো পেরেজ় গালদোস-এর কাজ। বিরাশি বছরের মানুষটি এ বার পাচ্ছেন স্পেনের ‘অফিসার্স ক্রস অব দি অর্ডার অব সিভিল মেরিট’, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শ্রেষ্ঠ অবদানের জন্য।