মস্কো থেকে লেখা চিঠিতে লিখছেন, “...আপাতত রাশিয়ায় এসেছি— না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।” ১৯২৫ থেকে ১৯২৮-এর মধ্যে পাঁচ বার সোভিয়েট ভ্রমণের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শেষ অবধি ১৯৩০-এর ১১ সেপ্টেম্বর মস্কো পৌঁছন, ছিলেন ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যেই তাঁর ঠাসা কর্মসূচি, সাক্ষাৎ হয়েছিল রুশ সমাজের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে— কৃষক, শ্রমিক, শিল্পী, লেখক, শিক্ষক, ছাত্র, সংস্কৃতি কর্মী, মৈত্রী সমিতির নেতৃবর্গ।
সোভিয়েট রাশিয়া দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, “এখানে এরা যা কাণ্ড করছে তার ভালোমন্দ বিচার করবার পূর্বে সর্বপ্রথমেই আমার মনে হয়, কী অসম্ভব সাহস।... অনেকে বলেছে— ওরা অতি আশ্চর্য একটা পরীক্ষায় প্রবৃত্ত।” আর রাশিয়া কবিকে কী ভাবে স্বাগত জানিয়েছিল? মস্কোর এক পুস্তক প্রকাশকের কলম জানা যায়, “সোভিয়েট জনগণের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহান সাহিত্যিক, ঔপনিবেশিক পীড়ন ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে অক্লান্ত সংগ্রামী, জাতিতে জাতিতে মৈত্রী ও শান্তির সোৎসাহী প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত।” রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েট দেশে যথেষ্ট অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। কবির সফরকালে রাশিয়ায় তাঁর চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল। তিনি মস্কো আর্ট থিয়েটারে নাটক দেখেছিলেন, বলশয় থিয়েটারে বিখ্যাত ব্যালে। সের্গেই আইজ়েনস্টাইনের ছবি ব্যাটলশিপ পোটেমকিন দেখার পর চলচ্চিত্র কর্মীদের সভায় যোগ দিয়েছিলেন। কৃষকদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন যৌথখামার কৃষি-ব্যবস্থা রূপায়ণের কথা। তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছেন, এরা গোটা দেশ জুড়ে তা-ই করছে।
১৯৩০-এ সফরকালে কবির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল লেভ তলস্তয়ের মৃত্যুর পর স্মারক হিসেবে নেওয়া মুখের ছাঁচ ‘ডেথ মাস্ক’। তা রাখা আছে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবন মিউজ়িয়ামে। অনেক পরে, ১৯৯১ সালে মস্কোর ফ্রেন্ডশিপ পার্কে স্থাপিত হয়েছিল কবির মূর্তি (ছবিতে), বাঙালি ভাস্কর গৌতম পালের গড়া। এ বছর রবীন্দ্রনাথের সোভিয়েট সফরের নব্বইতম বার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতার রুশ দূতাবাসের বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক দফতর গোর্কি সদনে বিরাট উদ্যাপনের পরিকল্পনা করেছিল। করোনা-অতিমারিতে তা থমকে, অনুষ্ঠান তাই হচ্ছে আন্তর্জালে। গোর্কি সদন ও বিশ্বভারতীর রুশ ভাষা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা এবং রাশিয়ার বাংলা ভাষার পড়ুয়ারা নাচে-গানে-কবিতায় শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন। কবির সফর প্রসঙ্গে পড়া হয়েছে প্রবন্ধও। এ মাসেই রুশ সরকারের ওয়েবসাইটে দেখা যাবে সেগুলি। রুশ-ভারত মৈত্রীর অনন্য সংযোগসূত্র রবীন্দ্রনাথ, তাঁর রাশিয়া সফরের স্মরণ ও বিশ্লেষণের প্রাসঙ্গিকতা রয়েই গেল। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
জীবন্ত কিংবদন্তি
শতবর্ষীকে চোখের সামনে দেখা অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। তারই সাক্ষী রইলেন বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কল্যামপুড়ি রাধাকৃষ্ণ রাও-এর ছাত্ররা। স্ট্যাটিসটিক্সের জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি, খ্যাত ‘ডক্টর রাও’ নামে। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের স্নেহধন্য, কলকাতা আইএসআইয়ের সঙ্গে কয়েক দশকের যোগ। তাঁরই প্রচেষ্টায় বি স্ট্যাট ও এম স্ট্যাট কোর্স শুরু এখানে। ১৯২০-তে অন্ধপ্রদেশে জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কলকাতায় আসেন যুদ্ধে যোগ দিতে, ঘটনাচক্রে আইএসআইয়ে স্ট্যাটিসটিক্স পড়া। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্যাটিসটিক্স স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। গবেষণার জন্য প্রশান্তচন্দ্র ১৯৪৬-এ কেমব্রিজে পাঠিয়েছিলেন তাঁকে। দেশে ফিরে আইএসআইয়ে যোগ দেন, আটাশ বছর বয়সে প্রফেসর। দীর্ঘ শিক্ষকজীবনে তাঁর হাতে তৈরি পঞ্চাশেরও বেশি গবেষক। পেয়েছেন ১৯টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮টি সাম্মানিক ডক্টরেট, পদ্মবিভূষণ, পদ্মশ্রী, আমেরিকার ‘ন্যাশনাল মেডেল ফর সায়েন্স’। ১০ সেপ্টেম্বর শততম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কেক কাটলেন, ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’ গান শুনলেন তন্ময় হয়ে।
মঞ্চগানের বাংলা
উনিশ শতকের বাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রাণকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (১৮৫৬-১৯৩০)। যুক্ত ছিলেন স্বদেশি আন্দোলনে, বরানগরে কংগ্রেসের কাউন্সিলর ছিলেন, কলকাতা হাই কোর্টের জুরিও। তাঁর স্মৃতিতে প্রাণকৃষ্ণ ভট্টাচার্য স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের স্নাতকোত্তর বাংলা বিভাগের অন্তর্গত রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টার, সহযোগিতায় প্রাণকৃষ্ণের উত্তরসূরিরা। এ বারের তৃতীয় স্মারক বক্তৃতা হল অনলাইন, ১১ সেপ্টেম্বর। গবেষক-শিল্পী দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন ‘আলো-ছায়ায় মঞ্চগান’ নিয়ে। গোপাল উড়ের বিদ্যাসুন্দরের গান, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মানময়ী, গিরিশ ঘোষের আগমনী, বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ, মিনার্ভায় গিরিশের অনুবাদে ম্যাকবেথ-এ ডাইনিদের গান থেকে আলিবাবা নাটকের গানে ফুটে উঠল উনিশ শতকের বাংলা মঞ্চগানের ছবি। বিশ শতকে ডি এল রায়ের সাজাহান থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রায়শ্চিত্ত, শিশির ভাদুড়ীর সীতা, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের জননী নাটকে তরুণ শচীন দেব বর্মণের সুরারোপিত গান, সত্তর দশকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্রেশট-ছোঁয়া ভালোমানুষ বা মনোজ মিত্রের নরক গুলজার-এর গানে মুগ্ধ শ্রোতা।
শখের সংগ্রহ
স্বদেশি কারখানায় তৈরি দেশলাই বাক্সগুলো হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার দাবির মুখপাত্র। বাজেয়াপ্ত হয়েছিল ‘স্বাধীনতা সম সুখ নাই’ লেখা দেশলাই। তাঁর সংগ্রহে থাকা সেই ঐতিহাসিক দেশলাই বাক্স দেখালেন উৎপল সান্যাল, তাঁর পাখির বাসার সংগ্রহও। গ্রন্থাগার বিজ্ঞান পড়ার সময় সত্যজিৎ-বিষয়ক বিবলিয়োগ্রাফি তৈরির মধ্য দিয়ে সত্যজিতে আগ্রহ দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের, সেই কাজই তাঁকে এগিয়ে দিয়েছে সত্যজিৎ-সংগ্রহ যাত্রায়। সুন্দরবনের আঞ্চলিক ইতিহাসের উপাদান সন্ধানে মগ্ন উজ্জ্বল সর্দারের সংগ্রহে আছে সুন্দরবনে পাওয়া ফসিল, মুদ্রা, টেরাকোটা। অপূর্ব কুমার পান্ডা দেখালেন জার্মানি, জাপান ও পরে বাংলায় তৈরি পোর্সেলিনের দেবদেবীর মূর্তি। এই সবই জানা গেল ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের ‘শখের সংগ্রাহক’ ওয়েবিনারে।
গানমানুষ
কবিতার শরীরে সুর বসিয়ে গান করে তোলার জাদু জানতেন তিনি। জয় গোস্বামীর ‘বেণীমাধব’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘লোকটা জানলই না’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘যে যায়, সে যায়’, শঙ্খ ঘোষের ‘মেয়েদের পাড়ায় পাড়ায়’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভালবাসার বাঘ’ মন ছুঁয়ে যেত গানের আসর। লোপামুদ্রা মিত্রের কণ্ঠে সেই সব গানে সমীর চট্টোপাধ্যায় (ছবিতে) ওরফে চাঁদুদার স্বাক্ষর। কবিতার গানে উড়ানের ধারায় সলিল চৌধুরী, প্রতুল মুখোপাধ্যায়দের পরম্পরায় সমীরবাবুও শরিক। ক্রিকেট, ট্রেকিং, বাইক-অভিযানপ্রিয়, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারের ভক্ত মানুষটি কুণ্ঠিত থাকতেন প্রচারের সামনে। কিন্তু গানে রূপান্তরের সময় কবিতার কোন শব্দটা শেষে ফেরালে অভিঘাত তীব্র হবে, বুঝতেন অব্যর্থ। ৩১ অগস্ট গানের পালা সাঙ্গ হঠাৎই।
পথিকৃৎ
১৯৬৯। ডিঙি নৌকোয় উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে কলকাতা থেকে আন্দামান পৌঁছেছেন ডিউক-পিনাকী। সহযোগী সম্পাদকের পরামর্শে নির্বাচনী রাজনীতির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সে খবর ছাপা হল আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়। কাগজের বিক্রি বেড়ে গেল তাতে। এ ভাবেই বাংলা সাংবাদিকতায় আধুনিকতা এনেছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষ (১৯২০-১৯৮৫)। ১৯৪১-এ সাংবাদিক জীবন শুরু, আনন্দবাজার পত্রিকার কলকাতা দফতরে বার্তা সম্পাদক ১৯৫৮ সালে, ’৭৬-এ যুগ্ম সম্পাদক। তাঁর দেখানো পথে সাহিত্যরসে জারিত, চলিত ভাষায় খবর লেখার নতুন ধারায় বুঁদ হন পাঠক। তাঁর সাহিত্যের কলমটিও সংবেদনশীল। কিনু গোয়ালার গলি, শেষ নমস্কার: শ্রীচরণেষু মাকে, নানারঙের দিন প্রভৃতি উপন্যাসের লেখক সন্তোষকুমার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন একাধিক বার, পেয়েছেন অকাদেমি পুরস্কারও। তাঁর রবীন্দ্র-প্রীতিও কিংবদন্তি। গুণীর তিনি অভিভাবকতুল্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত প্রমুখ তাঁর ডাকেই যোগ দেন সংবাদপত্রে। লিটল ম্যাগাজ়িনে নতুন লেখকের লেখা মনে ধরলে তার কাছেও পৌঁছে যেত চিরকুট। ৯ সেপ্টেম্বর শতবর্ষ পার করলেন সন্তোষকুমার ঘোষ।
পাঠকপ্রিয়
প্রতাপাদিত্য রোডের ‘লালবাড়ি’তে ব্রিজের আড্ডা বসেছে রবিবার। আচমকা ফোন বেজে উঠল। ও পার থেকে অনুরোধ, ‘‘আপনার গল্প নিয়ে সিনেমার কথা ভাবছি, এক্ষুনি আসুন।’’ শুনে এ পারে গৃহকর্তার প্রতিক্রিয়া, ‘‘বন্ধুদের সঙ্গে এই একটা দিনই আড্ডা দিই। আজ যাচ্ছি না।’’ ফোনের ও পারে ছিলেন অভিনেতা ধর্মেন্দ্র, এ পারে লেখক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৯)। এই শহরের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগ, কলকাতার বিখ্যাত বাড়ি নিয়ে পত্রিকায় লিখতেন ধারাবাহিক নিবন্ধ, প্রাসাদপুরী কলকাতা। লিখেছেন তিনশোরও বেশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-সহ নানা কিছু। তাঁর লেখা থেকে হয়েছে বহু বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্র। উত্তমকুমারের সঙ্গে ভাইয়ের মতো সম্পর্ক, মহানায়কের ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে কাল তুমি আলেয়া-র স্ক্রিপ্ট লিখেছেন আশুতোষবাবু, জানালেন কন্যা সর্বাণী মুখোপাধ্যায়। নিবিড় সম্পর্ক ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। হেমন্ত এসে গান শোনাতেন আশুতোষ-পুত্র জয়কে, ‘লালবাড়ি’তে এসেছেন লতা-আশা-মুকেশ-মান্না-কিশোরও! ৭ সেপ্টেম্বর শতবর্ষ পূর্ণ হল পাঠকপ্রিয় এই লেখকের।
সেই সময়
১৯৮৪। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে বললেন তাঁর অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, এশিয়াটিক সোসাইটির মতো পুরনো, অসামান্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইম্পর্ট্যান্স’ বানাতে হবে। শুনলেন ইন্দিরা। প্রণববাবুর তাড়নাতেই সংসদে প্রস্তাব পেশ হল, পাশও হল। ১৭৮৪ সালে উইলিয়াম জোনস-এর হাতে কলকাতায় তৈরি যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জুড়ে ভারতের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের গৌরবময় ঐতিহ্য, দুশো বছরের মাথায় জাতীয় বিস্মৃতি থেকে তার রক্ষায় প্রণববাবুর অবদান মনে রাখার মতো। এশিয়াটিক সোসাইটির সেপ্টেম্বরের বুলেটিনে প্রাক্তন বাঙালি রাষ্ট্রপতির এই ভূমিকার উপর আলো ফেলা হল। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর আজীবন যোগ, প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করেছেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট-এও। ভুলে যাননি বাঙালির আসল গৌরবক্ষেত্রটি হল বিদ্যাবুদ্ধির চর্চা, প্রতিষ্ঠানগুলির লালন তার প্রথম ও জরুরি ধাপ। এ কাল ও সেকালের রাজনীতির মধ্যে এই এক মহাসাগরীয় তফাত। কাণ্ডজ্ঞানের তফাত।