সন্দেশ কাগজ আবার প্রকাশ করার সুযোগে পুরনো ‘সন্দেশে’ প্রকাশিত তাঁর লেখা ও ছবিগুলি আবার ভাল করে পড়তে ও দেখতে হচ্ছে... বারবার অনুভব করছি যে শিশুসাহিত্যের অনেকগুলো দিক উপেন্দ্রকিশোর যে ভাবে আয়ত্ত করেছিলেন তেমন আর কেউ করেনি।” ষাটের দশকের গোড়ায় লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়, নতুন উদ্যোগে সন্দেশ পত্রিকা ফের শুরু করেছেন তখন। আরও লিখেছিলেন: “পুরনো ‘সন্দেশ’-এর রূপসজ্জা আজকের দিনের যে কোন পত্রিকাকে অনায়াসে হার মানায়।”
সত্যজিৎ নেই, সন্দেশ আজও আছে তাঁদের প্রজন্মবাহিত সাহিত্যগুণ ও শিল্পকর্ম নিয়ে, তাঁর শতবর্ষ পূর্তিতে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হল এ বার। “নানান গুণীজনেরা বাবার নানান দিক নিয়ে লিখেছেন,” জানিয়েছেন সম্পাদক সন্দীপ রায়, আছে “ওঁর আঁকা নিজের গল্প ও প্রবন্ধের হেডপিস, ডায়রি, উইলিয়াম হীথ রবিনসনের ছবির সঙ্গে ওঁর ছড়া, ডি জে কিমারের সময় করা একটি কার্টুন ও বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ... বাবার স্ক্র্যাপবই... বাড়তি আকর্ষণ ১৯৮৩ সালে লেখা বাবার ফেলুদা চিত্রনাট্য ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’-র ধারাবাহিক প্রকাশ।” সম্পাদক স্বয়ং পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ছদ্মনামে আনন্দলোক পত্রিকায় একাধিক নিবন্ধ লিখেছিলেন সত্যজিতের প্রথম হিন্দি ছবি শতরঞ্জ কে খিলাড়ি নিয়ে, সেগুলি একত্র করে ‘শতরঞ্জ সংবাদ’ শিরোনামে প্রকাশ পেল এই সংখ্যায়। সত্যজিতের অগ্রন্থিত রচনাদিতে তাঁর শিল্পসাহিত্যের প্রতি আসক্তির উৎসগুলি খুঁজে পাওয়া যায়: কোনওটি উদয়শঙ্করের কল্পনা নিয়ে, কোনওটি কুলদারঞ্জন রায়কে নিয়ে, কোনওটি সিনেমার শিল্পরূপ নিয়ে, তাতে লিখছেন: “চিত্রপরিচালককে সব সময়েই যে শুধু সিনেমা থেকে প্রেরণা পেতে হবে তা নয়... সিনেমা শিল্পে যোগ দিতে আমাকে যিনি প্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি এ পথের কেউ নন। আচার্য নন্দলালের দ্বারাই আমি বেশি প্রভাবিত হয়েছি। তাঁর দৃষ্টিভংগী থেকে আমি মানুষকে, পরিবেশকে, তার আচরণকে দেখতে শিখেছি।” (১৯৫৮)।
শিক্ষকতা সূত্রে পাঠভবন স্কুলের ছোটদের প্রয়োজনে সত্যজিতের ছবির শুটিংয়ে জুগিয়ে দিতেন সত্যজিৎ-ঘনিষ্ঠ দীপঙ্কর সরকার, সুকুমার রায় তথ্যচিত্র তৈরির সময় তাদেরকেই বাঁদর সাজানো হয়েছিল ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এর দৃশ্যনির্মাণে। “ছোটোদের কোনোভাবে অভিনয় শেখাবার চেষ্টা করতেন না মানিকদা। প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলে বাকিটা ছেড়ে দিতেন ওদেরই ওপর,” লিখেছেন দীপঙ্করবাবু। ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এ যেমন ঘোরাফেরার এলাকাটা কতখানি তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ছোটরা অভিনয় করেছিল ওদের মতো: “বাঁদরের দলকে খুবই সপ্রতিভ লেগেছিল ছবিতে। মানিকদা এটাই চেয়েছিলেন।” পত্রিকা থেকে নেওয়া ছবিতে শুটিংয়ের সময় সত্যজিৎ রায় ও ছেলের দল, সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চিরঞ্জিৎ বিমল দেব রমেশ মুখোপাধ্যায়।
শতবর্ষে সুরস্রষ্টা
চোরকে হাতেনাতে ধরেও ছেড়ে দিলেন ছোটখাটো চেহারার মানুষটি। না হয় নিয়ে পালাচ্ছিল দুষ্প্রাপ্য স্বরলিপিই, তাতে কী। “আহা, ও যে গান ভালবাসে!” এমনই ছিলেন ভি বালসারা (১৯২২-২০০৫) (ছবিতে)। বাংলার সুরকে ভালবেসে পার্সি এই সুরসাধক মনেপ্রাণে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালিই। স্টুডিয়ো ফ্লোরের বাইরে নাম ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। পিয়ানো, পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন, হারমোনিয়াম হাতে মঞ্চে একক বাদনের গুরু, বাংলা গানের পাশাপাশি ভজন ও গজলে স্নিগ্ধ সুরবিন্যাস— রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায় তাঁর অর্কেস্ট্রেশন-ভাবনাও অনন্য। তাঁর সঙ্গে কাজ করে ধন্য হয়েছেন বাংলার তাবড় সঙ্গীতগুণীরা। গত ২২ জুন জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হল ভি বালসারার, রবীন্দ্র সদনে ওঁর স্মরণে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল ভি বালসারা মেমোরিয়াল কমিটি এবং কলকাতা ইউনাইটেড কালচারাল সোসাইটি। কথায় গানে সুরে হল শিল্পী স্মরণ।
যাপনের রসদ
আমাদের ছোটবেলায় যখন পরিবেশ শব্দটার প্রচলন তত ছিল না, তখন বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তুর পরিচয় দিয়ে পড়ানো হত, এরা মানুষের কী কী কাজে লাগে। যেন মানুষের কাজে লাগাটাই বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের অস্তিত্বের প্রাথমিক শর্ত। ভাগ্যিস, এরা কেউ মানুষকে পাল্টা প্রশ্ন করে না যে, তোমরা আমাদের কী কাজে লেগেছ? কথাগুলি লেখক ও পরিবেশবিদ জয়া মিত্রের। গত ১৫ জুন বিকালে নেহরু চিলড্রেন’স মিউজ়িয়ম-এ সিনে অ্যাকাডেমি এবং ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস-এর যৌথ উদ্যোগে হয়ে গেল দশম কল্যাণ মৈত্র স্মারক বক্তৃতা, জয়া মিত্র বললেন ‘পরিবেশের মানুষ’ বিষয়ে। নিত্যজীবনের উদাহরণে দেখালেন, মানুষ যে পরিবেশে থেকেছে, সেখান থেকেই খুঁজে নিয়েছে যাপনের রসদ। খাদ্যভ্যাস, ঘর তৈরি, জল সংরক্ষণ, আলপনা, সবেতেই পরিবেশেরই ছবি।
চাঁদ কবি
রবীন্দ্রনাথ সস্নেহে ডাকতেন ‘চাঁদ কবি’, অবনীন্দ্রনাথ বলতেন ‘মাই আর্টিস্ট’। অগ্রজ সুধাকান্তের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে আসেন নিশিকান্ত রায়চৌধুরী (১৯০৯-১৯৭৩)। ছাত্র ছিলেন কলাভবনে, কবিতাও লিখতেন, ‘টুক্রী’ ছাপা হয়েছিল বিচিত্রা-য়, পরবর্তী জীবনে অলকানন্দা, দিগন্ত, নবদীপন বা ইংরেজি কাব্য ড্রিম কেডেন্সেস-এ রয়েছে তাঁর কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর। গান রচনায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত, বন্ধু দিলীপকুমার রায়ের সুরসঙ্গতে উজ্জ্বল তারাও। ১৯৩৩ থেকে আমৃত্যু কাটে পন্ডিচেরিতে, অরবিন্দের আশীর্বাদধন্য ছিল তাঁর যোগজীবন। নিশিকান্ত রায়চৌধুরীর জীবন ও সৃষ্টিকে ‘চাঁদ কবি’ নিবেদনে তুলে ধরবে সংস্কৃতিদল ‘পুনশ্চ’, কৃষ্ণেন্দু সেনগুপ্তের নেতৃত্বে, ২৬ জুন সন্ধ্যা ৬টায়, রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে। প্রকাশিত হবে পাঁচটি গানের স্বরলিপি-পুস্তিকা নিশিকান্ত, দিলীপকুমার রায় যে ভাবে গেয়েছিলেন তার ভিত্তিতে রচিত।
সমাজচিত্র
আইনের ধারক আইনজীবীরা, অথচ তাঁদেরই একাংশের মদতে আইনের ফাঁক গলে শাস্তি এড়ায় অপরাধীরা। রূঢ় এই বাস্তবের আধারে ‘থেসপিয়ানস’ নাট্যদলের নতুন নাটক উইটনেস, ২৮ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে। পার্থ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় এ নাটকে নামভূমিকায় শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাজাহান থেকে আগাথা ক্রিস্টি আধারিত ক্রাইম থ্রিলার— নানা প্রযোজনা ঝুলিতে, ‘কোর্টরুম ড্রামা’ এই প্রথম। অন্য দিকে, নাট্যচর্চায় ছয় দশক পেরোনো দল ‘হ-য-ব-র-ল’ নতুন প্রযোজনা নিয়ে আসছে কাল ২৬ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়, অ্যাকাডেমি মঞ্চে। সাফল্যশিখরে পৌঁছনোর বাসনা কোন জটিল আবর্তে ঠেলে দিচ্ছে মানুষকে, সেই নিয়েই তপন বিশ্বাসের নির্দেশনা— মোহ।
মৈত্রীর ৭৫
ডিসেম্বর, ১৯৪৭। নয়াদিল্লি পৌঁছলেন সোভিয়েট রাষ্ট্রদূত কিরিল নোভিকভ। সদ্যস্বাধীন ভারতের সঙ্গে নতুন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হল সোভিয়েট ইউনিয়নের। সেই বন্ধন ক্রমে দৃঢ়তর হয়েছে, বিশেষত ১৯৭১-এ ইন্দো-সোভিয়েট মৈত্রী চুক্তির পরে। স্বাধীনতা এ বার পঁচাত্তর পূর্ণ করছে, ভারত-রুশ দ্বিপাক্ষিক সম্বন্ধও। সেই উপলক্ষে বিশেষ স্মারক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে কলকাতার রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গোর্কি সদন। সকলের দেখার জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে সংগ্রহ— ভারতীয় ও রুশ শিল্পীদের কাজ, পুরনো ছবি, বই, পত্রপত্রিকা, ডাকটিকিট-সম্ভার। উদ্বোধন ২৭ জুন বিকাল ৫টায়, উপস্থিত থাকবেন আলেক্সি ইদামকিন ও সুরঞ্জন দাস। চলবে ৬ জুলাই পর্যন্ত, রোজ ৩টে-৬টা, শনি-রবি বাদে।
জন্মদিনে
“যাহার শক্তিতে আছে অনাগত যুগের পাথেয়/ সৃষ্টির যাত্রায় সেই দিতে পারে আপনার দেয়।”— বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে কবিতা-প্রণতি রবীন্দ্রনাথের। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে চিরচলমান স্রোতে বইয়ে দেওয়ার পুরোধা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আগামী কাল ২৬ জুন তাঁর ১৮৪তম জন্মবার্ষিকী, নৈহাটিতে তাঁর জন্মভিটে ও বসতবাড়িতে বঙ্কিম ভবন-গবেষণা কেন্দ্রে (ছবিতে) তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগিতায় তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান শুরু সকাল ১০টায়। ২৭ জুন বঙ্কিমী গান ও রচনানির্ভর শ্রুতিনাটক, ২৮ জুন আলোচনায় আবুল আহসান চৌধুরী ও কৃষ্ণা রায়। সূতিকাগৃহে বঙ্কিমচন্দ্রের আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা হবে, প্রকাশিত হবে বঙ্গদর্শন পত্রিকার নতুন সংখ্যা, কপালকুণ্ডলা-র সটীক সংস্করণ ও কৈলাসচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের একটি বই। অন্য দিকে, ‘সূত্রধর’-এর উদ্যোগে ‘এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল স্টেশন’ ইউটিউব চ্যানেলে বঙ্কিমচন্দ্রের মননভুবন নিয়ে বলবেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও সুজয় মণ্ডল, আগামী কাল রবিবার সন্ধ্যা ৭টায়।
নৃত্যবিভঙ্গে
যশোরের মেয়ে গেলেন প্যারিসে, সেখানেই উদয়শঙ্করকে দেখা। অমলাশঙ্করের (১৯১৯-২০২০) (ছবিতে) পুরো জীবনটাই জড়িয়ে গেল শিল্পী ও শিল্পের সঙ্গে। আগামী ২৭ জুন ১০৩তম জন্মবার্ষিকী প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পীর, মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানির আয়োজনে হবে দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান। ২৬ জুন ইজ়েডসিসি-তে বিশিষ্টজনের স্মৃতিতর্পণ, সৌরিতা শঙ্কর ঘোষের পরিচালনায় করোনেশন অব রাম; কল্পনা ছবির নানা মুহূর্ত জুড়ে দৃশ্যশ্রাব্য কোলাজ এভারগ্রিন মেমরিজ় এবং সব শেষে মমতাশঙ্করের নির্দেশনায়, চন্দ্রোদয় ঘোষের চিত্রনাট্য ও ভাষ্যে আজকের একলব্য— গুরু-শিষ্য পরম্পরার নানা স্তর, আঙ্গিক ও টানাপড়েন নিয়ে বিশেষ নৃত্যনাট্য। ২৭ জুন উদ্যাপন মধুসূদন মঞ্চে, মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানির সদস্যদের নিবেদন মিসিং ইউ— নৃত্য পরিচালনা অমলাশঙ্করের, সঙ্গীত আনন্দশঙ্করের। দু’দিনই অনুষ্ঠান শুরু সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে।
আজও অম্লান
ট্রামে আগুন ধরাতে এসেছে উদ্ধত যুবারা, যাত্রীরা সরে পড়লেও তিনি অবিচল বসে: আমি নামব না কারণ তোমরা কোনও ভাল কাজ করছ না। সেই সত্তর দশকেই তিনি যখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে সভায় ডাকলেন দেশের সব উপাচার্যদের, জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধন নিয়ে মত জানতে। তাঁর পালা এলে তিনি বলতে দ্বিধা করেননি, জরুরি অবস্থার ফলে কী ভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অম্লান দত্ত (১৯২৪-২০১০) ছিলেন এমনই— আপসহীন, দৃঢ়চিত্ত। জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে গত ১৭ জুন তাঁর জন্মদিনের সন্ধ্যায় এক সভার আয়োজন করেছিল অম্লান আত্মীয় সমাজ, জিজ্ঞাসা, বিদ্যাসাগর চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র, বেগম রোকেয়া অ্যাকাডেমি, স্বরাজ অভিযান, সমতট, একুশ শতাব্দী-সহ অনেকগুলি সংগঠন। বললেন শোভনলাল দত্তগুপ্ত, নিরঞ্জন হালদার।