আজ থেকে বাষট্টি বছর আগে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন: “অনেক ভাল ছবি জনপ্রিয় ছবি নয়; আর জনপ্রিয়তা শিল্পে উৎকর্ষের সংজ্ঞাও নয়।” শিল্পসম্মত ছবি তৈরির প্রয়াস নিয়ে কথা বলেছিলেন সত্যজিৎ। চল্লিশের দশকের শেষে তিনি নিজেই মেতে উঠেছিলেন শিল্পসম্মত ছবি দেখা ও দেখানো নিয়ে। বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন যে ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’, ১৯৪৭ থেকে তা কলকাতায় চলচ্চিত্রের শিল্পিত চর্চায় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৫৯-এ ‘ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া’ (এফএফএসআই)-এর জন্ম। ইতিমধ্যে ১৯৫২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোৎসব ঘটে গিয়েছে, পথের পাঁচালী বাংলা তথা ভারতীয় ছবিকে বিশ্বের মানচিত্রে ঠাঁই দিয়েছে, সত্যজিতের পাশাপাশি ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনও ছবি পরিচালনা শুরু করেছেন। ভারতে সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায়, বিশেষত জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে ফিল্ম সোসাইটিগুলি সারা দেশ জুড়ে ছবি দেখানোর এক আন্তর্জাতিক পরিসর তৈরি করে। শুধু এ শহরে বসে নিজের অঞ্চলের ছবি দেখা নয়, কলকাতা পেরিয়ে, সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন শহরের শিল্পমণ্ডিত ছবি দেখা, সারা পৃথিবীর ছবি দেখা।
এফএফএসআই নিয়ম করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকারদের ছবি এ শহরে দেখানোর উদ্যোগ করেছে। এমনকি আশির দশকের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি কলকাতায় প্রথম আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসবের আয়োজন শুরু করে সিনে সেন্ট্রাল। পরবর্তী কালে অবশ্য রাজ্য সরকারের উদ্যোগেই ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ শুরু হয়, অদ্যাবধি যা সযত্নে অনুষ্ঠিত।
ফিল্ম সোসাইটির এই ঐতিহ্যের পরম্পরাতেই এফএফএসআই-এর পূর্বাঞ্চলীয় শাখা আগামী ২০-২৫ সেপ্টেম্বর নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে আয়োজন করছে প্রথম ‘কলকাতা ওয়র্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। সহযোগিতায় ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ়, এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগ এবং ফিপরেস্কি-ইন্ডিয়া। শেষোক্ত সংস্থা দু’টির সচিব প্রেমেন্দ্র মজুমদার জানালেন, “উৎসবে ‘ইন্টারন্যাশনাল উইন্ডো’ ও ‘ইন্ডিয়ান প্যানোরামা’-য় এই সময়ের দেশি-বিদেশি ছবির সমাহার। রয়েছে গিরিশ কাসারাভল্লির সাম্প্রতিকতম কাহিনিচিত্র। প্রতিবেশী দেশের চলচ্চিত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাই বাংলাদেশের এক গুচ্ছ ছবি। সেই সঙ্গে রেট্রোস্পেকটিভ শ্রীলঙ্কার বিশিষ্ট পরিচালক অশোক হান্দাগামা-র, যাঁর ছবি এই প্রথম দেখানো হচ্ছে কলকাতায়। সিনেমার সিরিয়াস দর্শকের জন্য এ উৎসব, বিশুদ্ধ নান্দনিকতার চর্চাই মূল অভিপ্রায়।” ছবিতে শ্রীলঙ্কার টকিং অ্যাবাউট লাভ, ভারতের বারাহ বাই বারাহ ও বাংলাদেশের লাল মোরগের ঝুঁটি ছবির দৃশ্য, দেখা যাবে এ উৎসবে।
সারস্বত
১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখেন ক্ষিতিমোহন সেন— কার্জন থিয়েটারে ‘স্বদেশি সমাজ’ প্রবন্ধপাঠের এসেছিলেন কবি। চার বছর পর রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে তাঁর শান্তিনিকেতন আসা, তিন দশকেরও বেশি রবীন্দ্রসান্নিধ্য, ১৯৪১-এ আশ্রম থেকে কবির শেষ বিদায়ক্ষণ পর্যন্ত। কবীর দাদূ রজ্জব প্রমুখ মরমিয়া সাধকদের চিনিয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন, তাঁর মননাশ্রয়ে ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা, ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা মূর্ত হয়েছে গ্রন্থাকারে, লিখেছেন বাউল থেকে রামমোহন, নানা বিষয়ে। বিভেদে দীর্ণ এই সময়ে তাঁকে পড়া দরকার আরও বেশি করে। সেই তাগিদ থেকেই ‘ক্ষিতিমোহন সেন বিশেষ সংখ্যা’ প্রকাশ করেছে দিবারাত্রির কাব্য পত্রিকা (সম্পা: আফিফ ফুয়াদ)। ৩৮টি প্রবন্ধ, বাংলার সাধনা-র পুনর্মুদ্রণ, সারস্বতের জীবন ও কাজকে ফিরে দেখা। সঙ্গের ছবিতে পত্রিকার প্রচ্ছদ।
বঙ্গ ও বিশ্ব
স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব বাংলা ছাড়িয়ে ভারতে, দেশ পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়া আমেরিকা ইউরোপে, বঙ্গীয় চিত্রকলা সাহিত্য বিজ্ঞান বেয়ে। তার কান্ডারি রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতা অবনীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্র... আরও কত জন! বিশ শতক-শুরুতে ভারতে এলেন ওকাকুরা কাকুজ়ো, নিবেদিতার মাধ্যমে পরিচিত হলেন বাংলার অনেক মনীষী ও দেশপ্রেমিকের সঙ্গে, তাঁর দি আইডিয়ালস অব দি ইস্ট গ্রন্থের শুরুর বাক্যটিই ঐক্যের বার্তাবহ: ‘এশিয়া ইজ় ওয়ান’। চিত্রকলায় প্রাচ্যরীতির চর্চা শিল্পের দিগন্ত খুলে দিয়েছিল, ওকাকুরার উদ্যোগে টাইকান প্রমুখ শিল্পীরা এলেন কলকাতায়, বাঙালি শিল্পী শিখলেন জাপানি তুলিকলা। জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানচর্চা ভারতকে চেনাল বিশ্বের দরবারে। রবীন্দ্রনাথের জাপান ও চিন-যোগ, টোকিয়োর মিউজ়িয়মে নেতাজির আগমন... এই সবই উঠে এল অধ্যাপক সুগত বসুর ‘স্বদেশি আন্তর্জাতিকতাবাদ’ বক্তৃতায়; মিলন মন্দির তথা ফেডারেশন হল-এ ‘সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তৃতা’-য়, গত ৩০ অগস্ট সন্ধ্যায়।
উৎসবমুখর
অনীক নাট্যদল আয়োজিত নাটকের আন্তর্জাতিক উৎসব ‘গঙ্গা যমুনা নাট্য উৎসব’ পঁচিশ বছরে এ বার। রজতজয়ন্তী উৎসব গোটা বাংলা জুড়ে, প্রথম পর্যায় তপন থিয়েটারে ১৮-২৫ সেপ্টেম্বর, দশ নাট্যদলের দশটি নাটক নিয়ে। মুখোমুখি, রঙরূপ, অন্য থিয়েটার, সংস্তব, নান্দীপট, আখর, যাদবপুর মন্থন, গড়িয়া কৃষ্টি-র মতো কলকাতার নাট্যদল ছাড়াও থাকবে বেঙ্গালুরুর স্মরণিক; অনীক-এরও নাটক। আগামী কাল সন্ধ্যায় উদ্বোধনে মেঘনাদ ভট্টাচার্য, থাকবেন রঞ্জন সেন হৈমন্তী চট্টোপাধ্যায় গৌরী বসু প্রমুখ। স্পেয়ার পার্টস, নক্সী কাঁথার মাঠ, টাইপিস্ট, আবৃত্ত, প্রথম রাজনৈতিক হত্যা, গর্ভধারিণী, শেষ শৃঙ্গ, উড়ন্ত তারাদের ছায়া, হারিয়ে পাওয়া, মাথুর-এর মতো নাটক— পুজোর আগেই নাট্যপ্রেমীদের উৎসব যাপন।
তথ্যচিত্রের পথ
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বাংলা, ১৯১১-র দিল্লি দরবার, দেশবন্ধুর শেষযাত্রা ক্যামেরায় তুলেছিলেন হীরালাল সেন, বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক তথ্যচিত্র তৈরির পুরোধা তিনিই। ব্রিটিশ ভারতে তথ্যচিত্র তৈরি ও প্রদর্শনের প্রক্রিয়াটি ছিল শাসকের নজরাধীন, স্বাধীনতা-উত্তর কালে যে কাজটি করেছে ফিল্মস ডিভিশন। তবু তারই মাঝে ছবি-করিয়েরা খুঁজে নিচ্ছিলেন নিজস্ব অন্তর্ঘাত-প্রকরণ: দৃশ্যকল্প, নেপথ্যভাষ্য, মানুষের মুখের কথার ব্যবহারে। বিমল রায় এসএনএস শাস্ত্রী সুখদেব ঋত্বিক ঘটক সত্যজিৎ আনন্দ পট্টবর্ধন দীপা ধনরাজ রাকেশ শর্মা সঞ্জয় কাক... ১৮৯৭ থেকে আজ পর্যন্ত ভারতীয় তথ্যচিত্রের যাত্রাপথটি তুলে ধরলেন দ্বৈপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, গত ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সুজাতা সদনে— পিপল’স ফিল্ম কালেক্টিভ-এর উদ্যোগে।
রূপান্তরের রূপ
সুর ভুলে, সৃষ্টির আনন্দে, আবার কখনও প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের সুর-তাল-ছন্দ বদলেছেন, কখনও গানে বাণী পাল্টেছেন নাটকের প্রয়োজনে। ১৮৮১-তে রচিত বউ ঠাকুরাণীর হাট নাটকে বসন্ত রায়ের গান ‘আজ তোমারে দেখতে এলেম’ অন্য সুরে দেখা গেল ১৯০৯-এ রচিত প্রায়শ্চিত্ত নাটকে। এ এক দীর্ঘ বিচিত্র যাত্রা, ১৯৩৯-এ কবির আটাত্তর বছর বয়সে রচিত অভ্যর্থনাসঙ্গীত ‘সবারে করি আহ্বান’ পর্যন্ত যার বিস্তার। স্বরবিতানে মুদ্রিত রূপান্তরিত গানের সংখ্যা প্রায় ৫৮, এমন কিছু গানই তুলে ধরল সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘যাদুবিন্দু’— ‘রূপান্তরী: ভিন্নতায় রবীন্দ্রনাথ’ নামে এক অনুষ্ঠানে। রামজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় হয়ে গেল গত ১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়, বেহালার শরৎ সদনে।
জীবনশিল্পী
তরুণ মজুমদার চলে গিয়েছেন গত জুলাইয়ে। সমাজমাধ্যমে শহর শ্রদ্ধালু হয়েছে যত, পরিচালকের কাজ নিয়ে বিশ্লেষণমূলক উদ্যোগ তত চোখে পড়েনি। পল্লিজীবন, সমাজ, যাপনের স্বপ্ন ও রূপকথা ক্যামেরায় তুলেছিলেন যিনি, ফিরে েদখা জরুরি তাঁকে। সেই তাগিদ থেকেই যৌথ উদ্যোগ আইজ়েনস্টাইন সিনে ক্লাব, নর্থ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি ও তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের— আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টায় গোর্কি সদনে স্মরণ-অনুষ্ঠান। থাকবেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় গৌতম ঘোষ বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। অরিজিৎ মৈত্র ও শীর্ষেন্দু মজুমদারের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে তরুণ মজুমদারের ছবির পোস্টার লবি-কার্ড বুকলেট স্থিরচিত্র বই ইত্যাদি নিয়ে প্রদর্শনীও শুরু সে দিন, চলবে ২২ তারিখ পর্যন্ত, দুপুর ৩টে থেকে সন্ধ্যা ৬টা। সঙ্গে সুকুমার রায়ের তোলা ছবিতে সত্যজিৎ রায় ও তপন সিংহের সঙ্গে তরুণ মজুমদার।
বিস্ময়
স্কেচখাতায় দুশোরও বেশি পাতায় কখনও ওয়াশে, তুলি-কালিতে, কিংবা কালি-কলমে করা স্কেচ। আবার ছবির পাশাপাশি নিজস্ব শিল্পভাবনাও লেখা। রয়েছে চিঠির মকশোও, কে জি সুব্রহ্মণ্যন তথা ‘মানিদা’-কে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের আহ্বান। সনৎ করের ১৯৭৯ সালের এই স্কেচখাতায় আশির দশকে শিল্পীর করা কিছু লিথোগ্রাফের প্রাথমিক লেআউটও আভাসিত। ফার্ন রোডের দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাসে গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পী সনৎ করের একক চিত্রপ্রদর্শনী ‘জার্নি অব ফিফটি ইয়ারস’, তারই প্রারম্ভে প্রকাশিত হল এই স্কেচখাতাও। প্রদর্শনীতে প্রায় ৫০টি চিত্রকৃতি— উড ইনট্যাগলিয়ো সানমাইকা ইনট্যাগলিয়ো এচিং লিথোগ্রাফ টেম্পারা প্যাস্টেল ড্রয়িং-এর সম্ভার (ছবিতে একটি), পাঁচ দশকের। ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, মঙ্গলবার বাদে দুপুর আড়াইটে থেকে রাত সাড়ে ৮টা।
ভোকাট্টা!
ঘুড়ি নিয়ে কত গল্প! প্লেগের ভয়ে চৌরঙ্গির বাগানবাড়িতে এসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শখ হল, ঘুড়ি ওড়াবেন। গোড়ায় সাধারণ সুতোয় ওড়ানোয় কাটা পড়ল এক ঢাউস ঘুড়ি, পরে এল টোন সুতোয় ওড়ানোর বিলিতি বক্স কাইট। বোঁ বোঁ শব্দে সে উপরে উঠতেই বাকি সব ঘুড়ি সাফ, একটা খুঁটিতে ঘুড়ির সুতো বেঁধে তখন তামাক খাচ্ছেন অবন ঠাকুর— লিখেছেন কন্যা উমা দেবী। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিকথায় (কথায় কথায় রাত হয়ে যায়/আনন্দ)লিখেছেন মান্না দে-র কথা, গায়কের বান্দ্রার বাড়ির সামনে পার্ক, উল্টো দিকে মহম্মদ রফির বাড়ি। পুলকবাবু গিয়েছেন মান্না দের কাছে, হঠাৎ একটা ঘুড়ি উড়তে দেখে কাজ ছেড়ে গায়ক বার করলেন ঘুড়ি-লাটাই, পুলকবাবুর হাতে লাটাই দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু। অচিরে তাঁর টেনে প্যাঁচ খেলার সামনে কাটা পড়ল বিপক্ষের ঘুড়ি! ঘরে ফিরতেই ফোন, ‘টেনে প্যাঁচ খেলা’ শিখতে চাওয়ার অনুরোধ নিয়ে ও পারে মহম্মদ রফি, যাঁর ঘুড়ি এই একটু আগেই কাটা পড়েছে!