আমি একা নই, প্রত্যেকে তাঁকে দেখছিলেন একজন ‘অ্যাগ্রেসিভ প্রোভোকেটর’ হিসেবে, ধ্রুপদী সিনেমার যে রীতিরেওয়াজে আমরা অভ্যস্ত তার সমস্ত কিছুকেই প্রশ্ন করছিলেন তিনি।” জঁ-লুক গোদারের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি লিখেছেন ফোলকার শ্লোনডর্ফ, সাইট অ্যান্ড সাউন্ড পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায়, শ্লোনডর্ফ ছাড়াও গোদারকে নিয়ে জিয়া ঝাঙ্কে, সোফিয়া কোপোলা বা বেলা টার-এর মতো চিত্রপরিচালকদের লেখা। লন্ডনের ফিল্মপত্রিকাটির পাশাপাশি কলকাতাতেও এখন চর্চিত গোদার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোৎসবে দেখানো হচ্ছে তাঁর একগুচ্ছ ছবি।
এ শহরে গোদার-চর্চার ঐতিহ্য সুদীর্ঘ, চল্লিশ বছর আগে ১৯৮২-র আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসবে (অধুনালুপ্ত) ‘সোসাইটি’ সিনেমাহলে গোদারের ছবি দেখতে রাতভর দর্শকের ভিড় এ শহরের স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল। এই মুহূর্তে নন্দনে উৎসবপ্রাঙ্গণে আর নজরুলতীর্থে গোদারকে নিয়ে প্রদর্শনীটিও কলকাতা চলচ্চিত্রোৎসবকে আকর্ষণীয় করে তুলছে। এ বারের উৎসব নানা দিক থেকেই বর্ণময়, কোভিড-মুক্তির পর ডানা মেলেছে আন্তর্জাতিক আকাশে, বিভিন্ন দেশের সব ছবি দেখানো হচ্ছে ‘সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল’, ‘ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজেস’ ইত্যাদি বিভাগে। জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দেখানো হচ্ছে অ্যালাঁ রেনে, পাসোলিনি, মাইকেল ক্যাকোয়ানিসের বেশ কিছু ছবি। নন্দন, রবীন্দ্রসদন, শিশির মঞ্চ, চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবন, রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন, নজরুলতীর্থে দর্শক সমাগম আরও জমকালো করে তুলেছে শীতকে।
তবে নজরকাড়া ছবি আজ নন্দন-১’এ সন্ধ্যা ৭টায়, গৌতম ঘোষের মুজিব ইন ক্যালকাটা— অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন আন্তর্জাতিক এই ছবি-উৎসবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ-পূর্তিতে পরিচালক তৈরি করেছেন ছবিটি, গতকালই ছিল বাংলাদেশের বিজয় দিবস। পড়শি দেশের আর্কাইভ থেকে তো বটেই, কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকা-র গ্রন্থাগার থেকেও প্রচুর তথ্য ও নথি পেয়েছেন, জানালেন পরিচালক। পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক সাক্ষাৎকার, সঙ্গে ছিলেন তাঁর বোন রেহানাও। “মূলত শেখ মুজিবের ছাত্রজীবন ও যৌবনে কলকাতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দিনগুলিকেই ধরতে চেয়েছি। চল্লিশের দশকে দুর্ভিক্ষ, হিন্দু-মুসলমান বিভেদ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নেতাজির অন্তর্ধান, দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে শাসকবিরোধী আন্দোলন... এ সমস্ত কিছুর সঙ্গে ওতপ্রোত শেখ মুজিবুর রহমান কী ভাবে পৌঁছচ্ছেন এক অসাম্প্রদায়িক, সহিষ্ণু, বাংলাভাষী দেশ ও জাতির স্বপ্নে, হয়ে উঠছেন ‘বঙ্গবন্ধু’, সেই পরিক্রমাই এ ছবির বিষয়,” মুম্বই থেকে জানালেন তিনি, সেখানে নতুন ছবির শুটিংয়ে ব্যস্ত এখন। ছবিতে ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে কলকাতা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে শহরবাসীর ভিড়।
শতবর্ষে শ্রদ্ধা
একশো বছর ছুঁয়েও তিনি আমাদের মধ্যে আছেন, এবং আশা করা যায়, আরও অনেক একশো বছর আমাদের মধ্যে থাকবে তাঁর বৌদ্ধিক অবদান সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ়। ভারতের বাইরে সারস্বত জগতের এক বড় অংশ সমসাময়িক ভারতীয় বৌদ্ধিকতার মান নিয়ে সম্ভ্রম পোষণ করেন এই ইতিহাসবেত্তার তত্ত্বের কথা মনে করে। এ শহরে রণজিৎ গুহের (ছবি) শতবর্ষ পালনের আয়োজন করল ‘ভাবুক সভা’, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ছাত্রশিক্ষক গোষ্ঠী, যার মধ্যে সক্রিয় প্রেসিডেন্সি-প্রাক্তনী অন্যান্য কৃতীরাও। সাবঅল্টার্ন ইতিহাস তত্ত্ব ও প্রয়োগ, সাহিত্য ও তত্ত্বের যোগ, তাঁর জীবনের নানা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি ও নানা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর সংযোগ নিয়ে বললেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, গৌতম ভদ্র, অজয় স্কারিয়া, জ্ঞান প্রকাশ, প্রজিতবিহারী মুখোপাধ্যায়, বোধিসত্ত্ব কর ও আরও অনেকে, গত ১৫-১৬ ডিসেম্বর।
শতগান
জন্মশতবর্ষ অতিক্রান্ত বাবু রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর গানের অনুরাগীদের অনুযোগ, শিল্পীর বৈঠকি গানের রেকর্ডিং তত সুলভ নয়, ক্যাসেট বা সিডির রমরমার যুগেও তেমন সঙ্কলন হাতে গোনা। চন্দন রায়চৌধুরীর সঙ্গীতায়োজনে আমেরিকার ‘বিশ্বাস রেকর্ডস’ শিল্পীর পড়ন্তবেলায় শতাধিক গান ডিজিটালি রেকর্ড করেছিল, সেগুলি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মেলে। এ বার খ্যাতনামা গীতিকার প্রণব রায়ের পুত্র, ‘পেরেনিয়াল রেকর্ডস’-এর কর্ণধার প্রদীপ্ত রায়ের উদ্যোগে গত ২৭ নভেম্বর প্রকাশ পেল শিল্পীর গাওয়া একশো গানের ডিজিটাল সঙ্কলন ‘শতবর্ষে শতগান’, পেরেনিয়াল রেকর্ডস-এর ইউটিউব চ্যানেলে। এ গানগুলি সঙ্কলন করেছেন সংগ্রাহক শুভজিৎ সরকার। বছর শেষে সুপ্রাপ্তি।
অন্য ইতিহাস
আর একটি ইতিহাসগ্রন্থ প্রকাশ পেল শহরে। নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য, অধ্যাপক রঞ্জন চক্রবর্তীর লেখা ক্লাইমেট, ক্যালামিটি অ্যান্ড দি ওয়াইল্ড: অ্যান এনভায়রনমেন্টাল হিস্ট্রি অব দ্য বেঙ্গল ডেল্টা, ১৭৩৭-১৯৪৭ (প্রাইমাস বুকস) প্রকাশিত হল গত ২ ডিসেম্বর, বিশ্ববিদ্যালয়েরই সুভাষচন্দ্র সভাঘরে। বাংলার গাঙ্গেয় বদ্বীপভূমির পরিবেশ ও জলবায়ুগত ইতিহাস উপজীব্য এ গ্রন্থের, ইতিহাসের সীমায় পরিবেশ নিয়ে যে নীরবতা, তাকে ভাঙতে চায় এ বই। বাংলার বদ্বীপীয় ভূমিতে ফসলের উৎপাদন, বাণিজ্য, জনবিন্যাস, সংস্কৃতি-অর্থনীতির সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছেন লেখক; সুপারসাইক্লোন, ঝড়, বন্যা কী ভাবে এই জনপদের শস্য, সমাজ, সম্পদ ও আরণ্যক জীবনে প্রভাব ফেলেছে, করেছে ধ্বংস ও উচ্ছেদও, রয়েছে তার খতিয়ানও। প্রকাশ-অনুষ্ঠানে ছিলেন জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী-সহ বিশিষ্টজন।
অতিথি
কলকাতায় আসছেন প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব হাবিব তনভীরের কন্যা নাগিন তনভীর। আগামী ২২ ডিসেম্বর তপন থিয়েটারের দোতলায় তাপস সেন সভাগৃহে ‘পারমিক বারাকপুর’-এর আয়োজনে বিভিন্ন নাটকের গান পরিবেশন করবেন এই শিল্পী। হাবিব তনভীরের নয়া থিয়েটার (ভোপাল)-এর চরণদাস চোর, রাজরক্ত, আগরা বাজার, জিসনে লাহৌর নহি দেখা ইত্যাদি কালজয়ী প্রযোজনার গান শোনা যাবে নাগিনের কণ্ঠে। সেই অনুষ্ঠানের আগেই, ভবানীপুর সঙ্গীত সম্মিলনী সভাগৃহে আজ শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর বেনারস অঙ্গের ঠুংরি-দাদরা শোনাবেন নাগিন। আগামী বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতে হাবিব তনভীরের জন্মশতবর্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন শুরু, তার মধুর শুভারম্ভ যেন হয়ে গেল কলকাতাতেই!
গানে নাটকে
নান্দীকারের উদ্যোগ ‘নাট্যগানের পরম্পরা’, সোহিনী সেনগুপ্ত ও অম্বরীশ ভট্টাচার্যের কণ্ঠে তিন শতকের বাংলা নাটকের গান। অম্বরীশের মতে, এ আসলে ‘থিয়েটারের গানের ফর্ম, কম্পোজ়িশন, বিষয় ও উপস্থাপনার বিবর্তন’কেই ভাগ করে নেওয়া; “বাংলা নাটকের গানের বিশাল ভান্ডার নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছনোর ভাবনা থেকেই এ অনুষ্ঠান,” বললেন সোহিনী। অ্যাকাডেমি মঞ্চে ২০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় নান্দীকারের ৩৯তম জাতীয় নাট্যোৎসবের শুরুতেই এই নিবেদন। প্রথম দিন সংবর্ধিত হবেন বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ, আর উড়ন্ত তারাদের ছায়া, ঘুম নেই, শব চরিত্র কাল্পনিক, চৈতন্য বিমঙ্গল, টিকিটো কা সংগ্রহ, মৈমনসিংহ গীতিকা, নান্দীকারের রাণী কাদম্বিনী, এক থেকে বারো ও মানুষ, ছোটদের তিন নাটকও রয়েছে উৎসবে— ২৫ তারিখ পর্যন্ত।
সেরা দশ
চলচ্চিত্র-সমালোচকদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের ভারতীয় অংশ ‘ফিপরেস্কি-ইন্ডিয়া’-র সদস্যদের বাছাইয়ে গত অক্টোবরে প্রকাশ পেয়েছে সর্বকালের সেরা দশ ভারতীয় চলচ্চিত্রের তালিকা। প্রথম স্থানে পথের পাঁচালী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় যথাক্রমে মেঘে ঢাকা তারা ও ভুবন সোম, চার থেকে দশে পর পর এলিপত্থয়ম, ঘটশ্রাদ্ধ, গরম হাওয়া, চারুলতা, অঙ্কুর, পিয়াসা, এবং শোলে! দশ চলচ্চিত্রের দশটি স্থিরচিত্র (সঙ্গের ছবিটি পথের পাঁচালী থেকে) নিয়ে ২০২৩-এর নতুন ডেস্ক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করল ফিপরেস্কি-ইন্ডিয়া, সঙ্গে প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র রাজা হরিশচন্দ্র ও প্রথম ভারতীয় সবাকচিত্র আলম আরা-রও দু’টি ছবি। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোৎসবে পাওয়া যাবে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া-র স্টলে।
রস-সন্ধান
এক বইদোকান ছিল, নাম ‘শিব্রাম চকরবরতীর বইয়ের দোকান’। ১৯৭৪-এ কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের সে দোকান থেকেই বেরোয় শিব্রাম রচনাবলী, খোদ লেখক সম্পাদিত। দোকানটি শিবরাম করে দিয়েছিলেন পাড়ার পাতানো ভাগনে গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দুজনকে নিয়ে চালু নানা গল্প— এক বার শিবরামের অনুপস্থিতিতে তাঁর মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মেসবাড়ির ঘরের দেওয়াল চুনকাম করে দেন গোপালবাবু, যে দেওয়ালে পরিচিতজনের ঠিকানা-ফোন নম্বর লিখে রাখতেন লেখক! ঘরে ফিরে ফর্সা দেওয়াল দেখে রেগে গোপালবাবুর সঙ্গে দীর্ঘ দিন কথা বলেননি শিবরাম। গোপালবাবুর ছেলে জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শিবরামের ১৯৭৫-এ পাওয়া ‘প্রফুল্লকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার’-এর মানপত্র (ছবিতে) রাখা আজও। সন্ধান মিলেছে লেখকের ইচ্ছাপত্রেরও, শিবরামের বইয়ের স্বত্ব প্রদত্ত গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিবরাম-ভ্রাতা শিবসত্য চক্রবর্তীকে। এমন জানা-অজানা তথ্য, সঙ্গে শৈল চক্রবর্তীর অলঙ্করণে ৩১টি হাসির গল্প নিয়ে ‘বুক ফার্ম’ প্রকাশ করল লেখায় শিব্রাম, রেখায় শ্রীশৈল দ্বিতীয় খণ্ড (সম্পা: সুশান্ত রায়চৌধুরী ও বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়)। ১৩ ডিসেম্বর জন্মদিন ছিল শিবরামের, প্রকাশনাঘরে হল সম্পাদক ও শিবরাম-ভক্তদের আড্ডা।
দেড়শোয় কার্টুন
বাংলা কার্টুনের যাত্রা শুরু হয়েছিল দেড়শো বছর আগে, ১৮৭২ সালে। সেই ঐতিহাসিকতা উদ্যাপন করছে কলকাতার ‘কার্টুনদল’, রাজ্য নৃত্য সঙ্গীত ও দৃশ্যকলা আকাদেমির সহযোগিতায়। ‘বাংলা কার্টুনের ১৫০ বছর’ নামে দশ দিনের উৎসব চলছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির উদয়শঙ্কর হল-এ, ১০ ডিসেম্বর থেকে। কার্টুন ঘিরে অভিনব আয়োজন: আড্ডা, আলোচনা, লাইভ ক্যারিকেচার; বিশিষ্ট শিল্পীদের পরিচালনায় জিঙ্কের ব্লক তৈরি, বই বাঁধাই ও কার্টুন আঁকার কর্মশালা। প্রদর্শনীতে রয়েছে দুষ্প্রাপ্য বহু কার্টুনের সম্ভার; পোস্টার, ক্যালেন্ডার, আর্কাইভাল ব্যঙ্গচিত্র-সমন্বিত ডায়রি আর বই-ও। উৎসব চলবে ১৯ তারিখ পর্যন্ত। কলকাতায় এমন উৎসব মেলে না বড়, সে কারণেই এ আরও গুরুত্বের।