বিদেশি ফোটোগ্রাফারদের তোলা পুরনো কলকাতা বা দিল্লির ছবি যত সুলভ, সেই তুলনায় এদেশীয় চিত্রগ্রাহকদের লেন্সে লন্ডন বা পশ্চিমের জীবন ক্যামেরাবন্দি হওয়ার নমুনা চোখে পড়ে না তত। বসন্তের চোরা হাওয়ার মতো মাঝেমধ্যে দোলা দিয়ে যায় ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে এক বাঙালি মহিলার তোলা লন্ডনের রাস্তার ছবি: পার্কের নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা, দোকানে একাকী ম্যানেকুইন, হাইড পার্কে মহিলাদের রাজনৈতিক সমাবেশ। সময়েরই ধারাবিবরণী। চিত্রপরিচালক বিমল রায়ের স্ত্রী মনোবীণা রায়ের তোলা এই সব ছবি প্রাচ্যের দৃষ্টিতে পাশ্চাত্যকে দেখার এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ।
ব্রিটেন যে কোনও চিত্রগ্রাহকেরই স্বর্গ, বৈচিত্রের বরণডালা সাজিয়ে প্রস্তুত। ক্যামেরাশিল্পী তুলে ধরতে পারেন প্রকৃতি ও জনজীবনের সেই বিচিত্রতা, সঙ্গে চিত্রভাষায় নিজস্ব দর্শনও। এ বার তেমনই এক অভিজ্ঞতা কলকাতার ফোটোগ্রাফি-রসিকদের সামনে— কলকাতা ও লন্ডন, দুই মহানগরের ফোটোগ্রাফারদের ক্যামেরায় উঠে আসা ব্রিটেন। আনপ্লাগড: বেস্ট অব দি ইউকে—নামের এই প্রদর্শনীটি গতকাল ১০ মার্চ শুরু হল কলকাতায়, কলকাতার ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশন, ইন্দো-ব্রিটিশ স্কলার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বেঙ্গল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন-এর একত্র আয়োজন। লন্ডন, ব্রাইটন, এডিনবরা, গ্লাসগো-সহ নানা জায়গায় তোলা আশিরও বেশি আলোকচিত্র, এ ছাড়াও ডিজিটাল ছবির সম্ভার।
কলকাতার ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনের ‘গ্রেট ব্রিটিশ সিজ়ন’-এর অঙ্গ এই প্রদর্শনীটি। ভারত ও ব্রিটেন, দুই দেশের মধ্যে এক সজীব সংলাপ গড়াই লক্ষ্য এই প্রকল্পের— সংস্কৃতি, শিক্ষা, ক্রীড়া, প্রযুক্ত, পর্যটন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। এরই মধ্যে ইডেন গার্ডেনস-এ হয়েছে ইন্দো-ব্রিটিশ হেরিটেজ কাপ ক্রিকেট ম্যাচ, ‘গ্রেট ব্রিটিশ ওপেন কুইজ়’, প্রকাশিত হয়েছে ‘ইউকে-ইন্ডিয়া স্পোর্টস ক্যালেন্ডার’, আরও নানাবিধ উদ্যাপন।
আনপ্লাগড প্রদর্শনীটিও এই ধারাতেই এক অনন্য সংযোজন; ছবিতে তুলে ধরবে ব্রিটেনের নিসর্গ, সমুদ্রতট, স্থাপত্যকীর্তি, উৎসব-উদ্যাপন ও জনজীবন। প্রদর্শনীর সার্বিক পরিকল্পনা করেছেন ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনের অমিত সেনগুপ্ত এবং ইন্দো-ব্রিটিশ স্কলার্স অ্যাসিয়েশন-এর সপ্তর্ষি কর; তাঁদের দুজনেরই তোলা ছবি রয়েছে প্রদর্শনীতে, কলকাতা ও ব্রিটেন মিলিয়ে দেখা যাবে মোট সতেরো জন আলোকচিত্রীর কাজ— অংশগ্রহণ করেছেন বেঙ্গল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ইউকে-র সদস্যরাও। ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের খুব কাছে, হোয়াইটহল-এ ব্রিটিশ যুদ্ধ স্মারক ‘উইমেন অব ওয়র্ল্ড ওয়র-টু’র ছবি তুলেছেন অমিত, সপ্তর্ষির ছবিতে প্রাচীন সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল ও আধুনিক গণপরিবহণের সহাবস্থান (ছবিতে), শুভম পাল, ঈপ্সিতা-সহ সব শিল্পীর ক্যামেরাই বাঙ্ময়— জনজীবন ও প্রকৃতির সনিষ্ঠ ভাষ্য। আইসিসিআর-এর বেঙ্গল গ্যালারিতে এই প্রদর্শনীটি দেখার সুযোগ আগামী কাল ১২ মার্চ পর্যন্ত, দুপুর ৩টে থেকে রাত ৮টা।
স্মরণ
বিজ্ঞান ও জনসমাজকে মেলানোর লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে পথ চলা শুরু ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞানকর্মী সংস্থা’-র। ১৯৮২-র ৬ অগস্ট হিরোশিমা দিবসে বহু বিজ্ঞান সংগঠনের একত্র মিছিল হয়েছিল তাদের উদ্যোগেই, যা থেকে জন্ম নেয় ‘গণবিজ্ঞান সমন্বয় কমিটি’। নিউক্লিয়ার ও অন্যান্য দূষণ বিরোধী প্রচার ও এই নিয়ে লেখালিখির পাশাপাশি, ’৭৮-এ পশ্চিমবঙ্গে বন্যা থেকে শুরু করে সুন্দরবনে হয়ে চলা দূষণ, ভারতে নিউক্লিয়ার বিপদ ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত আলোচনার আয়োজন করেছে এই সংস্থা। তাদের দ্বিমাসিক মুখপত্র বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী-ও প্রকাশিত হচ্ছে একটানা প্রায় চার দশক। সেই পত্রিকারই উদ্যোগে এ বার তাঁরা স্মরণ করবেন ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস)-এর পথিকৃৎ দিলীপকুমার মহলানবিশকে (ছবি), সেই সঙ্গে শম্ভুনাথ দে, ধীমান বড়ুয়ার মতো বিস্মৃতপ্রায় বিজ্ঞান-ব্যক্তিত্বদেরও। আজ বিকেল ৫টায়, সুকিয়া স্ট্রিট মোড়ে রামমোহন লাইব্রেরি হল-এ।
ছয় ঘরানা
এর আগে মহানগরে ‘সরোদ উৎসব’-এর আয়োজন করেছিল অন্নপূর্ণা দেবী ফাউন্ডেশন, এ বার বসন্তোৎসবের শহরে তাদের নিবেদন ‘সেতার উৎসব’। জি ডি বিড়লা সভাঘরে শুরু হয়েছে গতকাল, চলবে ১২ মার্চ পর্যন্ত। মাইহার, বিষ্ণুপুর, ইনদওর, রামপুর সেনিয়া, কিরানা, ইটাওয়া... সেতারের নানা ঘরানার বিশিষ্ট সঙ্গীতগুণীরা নিবেদন করবেন সুর-অর্ঘ্য। প্রথম দিনের শিল্পীরা ছিলেন বিদুষী মিতা নাগ, পণ্ডিত সুরেন্দ্র রাও, পণ্ডিত তন্ময় বসু প্রমুখ। আজ সন্ধ্যা ছ’টা থেকে পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায় ঈশান ঘোষ হরশঙ্কর ভট্টাচার্য ও পরিমল চক্রবর্তীর পরিবেশনা। আগামী কাল সন্ধ্যায় সাহানা বন্দ্যোপাধ্যায় রফিক খান উস্তাদ শাহিদ পারভেজ, তবলা সঙ্গতে রূপক ভট্টাচার্য, রামদাস পালসুলে ও হিন্দোল মজুমদার। ছয় ঘরানায় বসন্তের তিন সন্ধ্যা।
নারী ভাবনা
৮ মার্চ ছিল বিশ্ব নারী দিবস, এক গুচ্ছ আয়োজনে দিনটি উদ্যাপন করছে কলকাতার রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্র গোর্কি সদন। ৯-১৬ মার্চ, সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে তারা, রুশ ও ভারতীয় নারী শিল্পীদের চিত্রকৃতি দিয়ে। প্রদর্শনীর ভাবনাকে প্রসারিত করে ১৩ মার্চ সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টায় আলোচনা, বিষয় ‘সমাজভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিস্যুয়াল আর্টিস্টদের ভূমিকা ও দায়’। বাংলার প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব কানন দেবীকে নিয়ে শম্পা মিত্রের তথ্যচিত্র কানন দেখানো হবে ১৫ মার্চ বিকেল সাড়ে ৫টায়, ১৬ মার্চ একই সময়ে তারামণি ঘোষের একক পরিবেশনায় ‘হাওড়া সৃজন’-এর নাটক অন্য তৃতীয়া। চিত্রপ্রদর্শনীটি দেখা যাবে ছুটির দিন বাদে, বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।
স্মৃতিমধুর
হাতিবাগানের নলিন সরকার স্ট্রিটে জন্ম শ্যামল ঘোষালের। তাঁর প্রপিতামহ শশীভূষণ রেড রোডে এক সাহেব দম্পতির ফিটনের কোচোয়ানকে চাবুক সমেত এক ঝটকায় ধরাশায়ী করেছিলেন, অন্য দিকে তাঁর পিতা অসিত ঘোষালের গান শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: “শান্তিনিকেতন এসো, তোমার কণ্ঠে আমি আরও সুর ঢেলে দেব।” দিদিমা অনুজা ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের সহোদরা সুনয়নী দেবীর কন্যা, আর বড়দিদি রেখা ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের বেয়ান, অভিনয়ও করেছেন সোনার কেল্লা ছবিতে। উত্তর কলকাতার বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে ঘোষাল পরিবারের ঐতিহ্য নিয়ে। সে কাল-এ কালের বহু মানুষ, বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহ উঠে এসেছে শ্যামলবাবুর স্মৃতিকথন ঋতুর দু’ধারে বইয়ে (প্রকা: বিচিত্রা গ্রন্থন বিভাগ)। তথ্যসমৃদ্ধ বর্ণময় এই ইতিহাস কাজে দেবে নতুন প্রজন্মের, বই-শুরুতে মন্তব্য সন্দীপ রায়ের।
নাট্যময়
তাঁর নাটক বাংলা থিয়েটারের বড় আপন। অন্যায় ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে, আধিপত্যবাদ ও একতন্ত্রের সমালোচনায়, শান্তির পক্ষে বের্টোল্ট ব্রেখট স্থাপন করেছিলেন সাধারণ মানুষকে। রাষ্ট্র যখন দেশ দমনে মন দেয়, তখন যে ১৯৩৩ আর ২০২৩-এ তফাত থাকে না, সেই কথাটি ব্রেখটের ১২৫ বছরে তাঁরই নাটকের মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছে ‘অশোকনগর নাট্যমুখ’। ১২ মার্চ মধুসূদন মঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তাদের নতুন প্রযোজনা হাউ মাচ ইজ় ইয়োর আয়রন?, অভী চক্রবর্তীর নির্দেশনায়। অন্য দিকে, ‘সুখচর পঞ্চম’-এর ২৮তম নাট্যমেলা ‘দর্শকের দরবার’, ১০-১৪ এবং ১৭-২০ মার্চ পানিহাটি লোকসংস্কৃতি ভবনে একগুচ্ছ নাটক: সোক্রাতেস, ওয়ার্ড নম্বর ৬, জনতার আফিম, আজ কী শকুন্তলা, দায়বদ্ধ, দায় আমাদেরও, দাদার কীর্তি, বিয়েগাউনি কাঁদন চাঁপা, অগম অন্তর পারাবারে, চৈতন্য, সত্য ফিরে এসো, প্রথম রাজনৈতিক হত্যা।
শতবর্ষ পরে
১৯৩৫-এর জুনে প্রথম অভিনীত হয় টি এস এলিয়ট-এর মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল, ১১৭০ সালে ক্যান্টারবেরি ক্যাথিড্রালে আর্চবিশপ টমাস বেকেট-এর হত্যাকাণ্ডের (ছবিতে ১৮৬৪ সালে মুদ্রিত বইয়ে সেই দৃশ্যকল্পনা) উপর আধারিত যে কাব্যনাট্য। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের পড়ুয়ারা এই নাটক অবলম্বনেই তৈরি করেছে একাঙ্ক আ ফিউনারাল, অভিনয় আগামী ১৫ মার্চ অপরাহ্নে, মরকতকুঞ্জ প্রাঙ্গণে বিনোদিনী মঞ্চে। উপলক্ষটিও বিশেষ, ১৯২২-এ টি এস এলিয়ট-এর কবিতা দি ওয়েস্ট ল্যান্ড এবং জেমস জয়েস-এর উপন্যাস ইউলিসিস প্রকাশের শতবর্ষ উদ্যাপন। বিশ শতকের সাহিত্যে নবযুগের সূচনায় এই দু’টি সৃষ্টি দুই অবিসংবাদী স্মারকচিহ্ন— শতবর্ষের আলোয় তাদের ফিরে দেখবে এক আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র, সে দিন সকাল সাড়ে ৯টায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিজননী সারদা কক্ষে। বলবেন নর্থ ক্যারোলাইনা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যান্টনি কুডা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামসাদ মর্তুজ়া। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
নব নব রূপে
ফোটোগ্রাফি ঘিরে একটা মস্ত বাণিজ্যিক দিক হল পোর্টফোলিয়ো শুট, ফ্যাশন, বিয়ে বা এই ধরনের পরিসরে কাজ। এ কালে তাদের কেমন রমরমা তা চার পাশে কান পাতলেই বোঝা যায়, বহু হবু দম্পতিরই মনোগত বাসনা— ‘প্রি-ওয়েডিং শুট’-এ যদি সত্যজিৎ রায়ের ছবির চরিত্র হয়ে ওঠা যেত! দক্ষিণ দমদমের ‘মনছবি’ স্টুডিয়ো ও অ্যাকাডেমি ২০২৩-এর এক টেবিল ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে সত্যজিতের অপুর সংসার, চারুলতা, দেবী, মহানগর, নায়ক, ঘরে বাইরে-র চিরচেনা পোস্টার বা স্থিরচিত্রগুলিকে এই সময়ের রূপ রং ভাব প্রেক্ষাপটে ফেলে, এ কালের ‘পাত্রপাত্রী’দের সেই চরিত্ররূপে কল্পনা করে। বাঙালির প্রিয় পরিচালকের প্রতি এ তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য, তাদের নিজস্ব ভাবনায়। রয়েছে জয় বাবা ফেলুনাথ, গুপী গাইন বাঘা বাইন, জন-অরণ্য, অরণ্যের দিনরাত্রি-র (ছবিতে) রূপকল্পও। আইডিয়া মন্দ নয়, এ বার গৃহীত হওয়ার পরীক্ষা।
অশেষের ধনে
মানবশরীর এক রহস্য, অপূর্ব সম্পদও এক— ভরা অশেষের ধনে। মৃত্যুর পরেও কাজে লাগে শরীরের নানা অঙ্গ ও কলা: ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, কিডনি, ক্ষুদ্রান্ত্র, কর্নিয়া, ত্বক, হৃৎপিণ্ডের ভালভ, হাড়, কার্টিলেজ/ লিগামেন্ট; সমগ্র দেহটিই দান করা যায় চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োজনে। মরণোত্তর দেহদান নিয়ে সমাজের একটা বড় অংশ অন্ধকারে, তাদের আলোয় আনার সেই কাজটিই গত চার দশক ধরে করে চলেছে ‘গণদর্পণ’-এর মতো সংস্থা। নানা কর্মকাণ্ড তো আছেই, সেই ধারাতেই এ বার যুক্ত হল একটি বই, মৃত্যুই শেষ কথা নয় (প্রকা: নবজাতক প্রকাশনী)। লেখক শ্যামল ইতিহাসের পথ বেয়ে, বিজ্ঞানের হাত ধরে তুলে ধরেছেন জরুরি এ বিষয়টি। মরণোত্তর চক্ষুদান, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের গুরুত্ব কতটা, দেহ বা অঙ্গদানে ইচ্ছুকদের কী করণীয়— বুঝিয়ে দিয়েছেন সহজ করে।