ময়মনসিংহ থেকে বেরোত কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত সৌরভ পত্রিকা, সেখানেই কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন জনৈক চন্দ্রকুমার দে। কলকাতায় তা চোখে পড়ে দীনেশচন্দ্র সেনের। সেটা ১৯১৩ সাল, তার অনেক আগেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, দীনেশচন্দ্রকে দিয়েছে প্রতিষ্ঠা। নিজের বই লিখতে গিয়ে পূর্ববঙ্গের বহু পল্লিগ্রাম ঘুরেছেন দীনেশচন্দ্র, পুঁথি সংগ্রহ করেছেন অনেক কষ্টে, “কোন কোন দিন ১০ মাইল পদব্রজে গমন ও সেই ১০ মাইল প্রত্যাবর্ত্তন কেবল গমনাগমন সার হইয়াছে।” জহুরির চোখ ঠিক লোককে চিনেছিল। ১৯১৩ সালে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে মাসিক সত্তর টাকা বেতনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পালাগান সংগ্রাহক’-এর পদে চন্দ্রকুমারকে নিযুক্ত করেন দীনেশচন্দ্র সেন। চন্দ্রকুমারের সংগ্রহ ও সঙ্কলন, দীনেশচন্দ্রের সম্পাদনা— এই দুইয়ের ফসল মৈমনসিংহ-গীতিকা; যার ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’, ‘চন্দ্রাবতী’-সহ পালাগুলি আখ্যান গান ভাব ভাষা কল্পনার সম্ভারে বাংলা ও বাঙালির সাহিত্য-ঐতিহ্যের অংশ। বেরিয়েছিল ১৯২৩-এ, এ বছর তার প্রকাশের শতবর্ষ।
একশো বছর পরে আজ কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে মৈমনসিংহ-গীতিকা? সে কি শুধুই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের পাঠ্যক্রমের অংশ? বঙ্গ-থিয়েটার, সিনেমা বা জনসংস্কৃতিতে ইতিউতি মুখ দেখানো কেবল? মৈমনসিংহ-গীতিকা’র ভূমিকা-শেষে দীনেশচন্দ্র আহ্বান জানিয়েছিলেন বাংলার এই ‘গাথাসাহিত্য’ উদ্ধারকল্পে সাহায্যের: “নিম্নের ঠিকানায় আমাকে স্মরণ করিবেন।” দীনেশচন্দ্রের জন্মের সার্ধশতবর্ষ অতিক্রান্ত, চন্দ্রকুমার-কেদারনাথদের আজকের ক’জন বাঙালি চেনেন!
রবীন্দ্রনাথ মৈমনসিংহ-গীতিকা’র প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে বলেছিলেন, “বাংলা সাহিত্যে এমন আত্মবিস্তৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয়নি।” বাঙালির সাহিত্যধারার সেই রসবিস্তারে এ বার উদ্যোগী হয়েছে দুই বাংলার দু’টি প্রতিষ্ঠান, কলকাতার ‘আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন রিসার্চ সোসাইটি’ ও বাংলাদেশের ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম’। আগামী ২৮ মার্চ আশুতোষ মেমোরিয়াল হল-এ বিকাল ৫টা থেকে মৈমনসিংহ-গীতিকা’র শতবর্ষ উদ্যাপন তাদের। শতবর্ষে ফিরে দেখা তো আছেই, সঙ্গে দীনেশচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত ‘দীনেশ-রবীন্দ্র পত্র সম্মাননা’য় ভূষিত হবেন দুই বাংলার বিশিষ্ট গবেষক-অধ্যাপকেরা; প্রধান অতিথি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, উদ্যোক্তাদের তরফে থাকবেন দীনেশচন্দ্রের উত্তরসূরি দেবকন্যা সেন ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল হাসান শেলী। ফোরামের পক্ষে নতুন করে প্রকাশিত হবে বই মৈমনসিংহ গীতিকা, সঙ্গে স্বপন ধরের সম্পাদনায় বাংলাদেশের জলদ (উত্তরকাণ্ড) পত্রিকার ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা শতবর্ষ সংখ্যা’। ছবিতে মহুয়া পালার ‘পলায়ন দৃশ্য’, শিল্পী সতীশ সিংহের মূল চিত্রকৃতি থেকে এ কালের শিল্পীদের পুনর্নির্মাণ, জলদ (উত্তরকাণ্ড) পত্রিকার প্রচ্ছদ থেকে।
নৃত্যভাষ
শুধু মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের কন্যা বলে নয়, স্বকীয় ভাবনা ও নৃত্য-উপস্থাপনায় এক স্বতন্ত্র শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন রঞ্জাবতী সরকার (ছবি)। ‘গঙ্গাবতরণ’, ‘ফেবল ফর লা গ্রান সাভানা’, ‘কাসান্দ্রা’-র মতো তাঁর উপস্থাপনাগুলি তারই সাক্ষী। ভারতীয় সমকালীন নৃত্যধারার এই শিল্পীর জন্মদিন ২৯ মার্চ, ডান্সারস’ গিল্ড তাদের ৪০তম বর্ষ উদ্যাপনের অঙ্গ হিসাবে সে দিন নিবেদন করবে নৃত্য-প্রযোজনা ‘অ্যান্ড স্টিল আই রাইজ়: তবুও উঠে দাঁড়াব’— একুশ শতকে লিঙ্গবৈষম্য-নিপীড়নের যন্ত্রণা ও তা থেকে উত্তরণের কথা। রঞ্জাবতীকে নিয়ে বলবেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যা বিভাগের প্রধান ঐশিকা চক্রবর্তী, সম্মাননায় ভূষিত হবেন মমতাশঙ্কর, সুতপা তালুকদার ও শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়। থাকছে ‘কলকাতা সংবেদ’-এর বিশেষ প্রযোজনাও। অনুষ্ঠান সল্টলেকের মৃত্তিকা প্রেক্ষাগৃহে, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়।
নবতরঙ্গে
মনন ও বাস্তব কর্মকাণ্ডকে পরিপূরক হিসাবে দেখা বামপন্থার ভিত্তি, বাংলায় অধুনাবিরল সেই দৃষ্টির অধিকারীদের এক জন ছিলেন অরুণ চৌধুরী। রাজনৈতিক নেতা, মগ্ন পাঠক, সমাজ গবেষক, গ্রন্থ সংগ্রাহক, জনশিক্ষা আন্দোলনের পুরোধা— তাঁর নানা পরিচিতিগুলো ছিল পরস্পরের অঙ্গাঙ্গি। এই যোগ যে বামপন্থী আন্দোলন ও মানবজগৎকে কত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তা দেখিয়ে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা, সেখানকার নানা দেশে সমাজতন্ত্রের নতুন নতুন তরঙ্গ, চেতনা ও কর্মের বহু নতুন অভিজ্ঞতা। শহরে সপ্তম ‘অরুণ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা’ দিতে আসছেন ইকুয়েডর সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞানী ও জনকর্মী এডগার ইশ লোপেজ়, বলবেন লাতিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের নবতরঙ্গ নিয়ে। সরলা রায় মেমোরিয়াল হলে, ৩১ মার্চ বিকাল ৫টায়।
ইতিহাস-চর্চা
ইতিহাসের গ্রিক দেবী ‘ক্লিয়ো’র নামে ইতিহাস-অনুসন্ধানী প্রয়াস, রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয় নরেন্দ্রপুর (স্বশাসিত)-এর ইতিহাস বিভাগ তার নাম রেখেছে ‘ক্লিয়ো ভেঞ্চার’। ২০১৭-তে কলেজে শুরু ইতিহাসকেন্দ্রিক এই সারস্বত ‘উৎসব’, বিশেষ একটি বিষয় ঘিরে চলে চর্চা: বক্তৃতা, প্রবন্ধ উপস্থাপন। অতিমারিতে দু’বছর বন্ধ ছিল, ফের স্বমহিমায় ফিরছে এই উদ্যোগ। এ বারের ভাবনা লোককথন বা ‘ফোক টক’: লোককথা, লোকসঙ্গীত ও নৃত্য, লোকনাট্য, লোকক্রীড়া, লোকদেবতা, লোকচিকিৎসা-সহ নানা উপবিষয় ঘিরে। ভাস্কর চক্রবর্তী অচিন্ত্য বিশ্বাস কণাদ সিংহ প্রমুখ বিশিষ্ট অতিথি বক্তাদের পাশাপাশি বলবেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। ২৮ মার্চ, সকাল ১১টা থেকে দিনভর।
নব্বইয়ে
প্রকৃতি, দেশ-কাল, দোষেগুণে গড়া মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা তাঁর কলমকে উজ্জীবিত করেছে। কুবেরের বিষয় আশয়, শাহজাদা দারাশুকো, আলো নেই-এর মতো উপন্যাসের স্রষ্টা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ৯০তম জন্মদিন আজ, ২৫ মার্চ। দ্য অ্যান্টনিম পত্রিকা ও ‘গল্পমেলা’-র উদ্যোগে আজ সন্ধ্যা ৬টায় রোটারি সদনে তারই উদ্যাপন, বলবেন অভিজিৎ সেন তিলোত্তমা মজুমদার রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বিষ্ণুপ্রিয়া চৌধুরী প্রমুখ; প্রকাশিত হবে চৈতি মিত্রের অনুবাদে শ্যামলের চন্দনেশ্বর জংশন, দুই বাংলার লেখিকাদের ছোটগল্পের অনুবাদ সঙ্কলনও। ২০২২-এ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছোটগল্প থেকে সেরা বারো বেছে নিয়ে গল্পকারদের ভূষিত করা হবে ‘শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ছোটগল্প সম্মান’-এ।
মিলন মহান
মনজ়িলাত ফতিমার অওয়ধি খাবারের গুণগ্রাহী কলকাতার খাদ্যরসিকেরা। তাঁর রান্নার হাতেখড়ি পারিবারিক পরিসরে সাধারণ ঘরোয়া খাবার দিয়ে, ক্রমে হাত পাকানো পারিবারিক সূত্রে পাওয়া নবাবি হেঁশেলের পদে। বিহারী পরিবারে বিয়ে, রান্নাতেও এল সেই প্রভাব। এই সব নিয়েই গড়ে উঠল নিজস্ব এক ঘরানা। রান্নাঘর থেকে খাবারের বৃহত্তর বিশ্বের এই যাত্রার কথা মনজ়িলাত শোনালেন গত ১৪ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ উর্দু আকাদেমিতে। আয়োজক ‘দাস্তান’, আন্তঃবিষয়ক চর্চার মধ্য দিয়ে ভারতের বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক পরিচয়টি তুলে ধরতে আগ্রহী যারা। গৌরমোহন শচীন মণ্ডল মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, খাদ্য-ইতিহাস সন্ধানী রঞ্জিনী গুহ বললেন ভারতীয় ও বাঙালি রান্নাঘরে পর্তুগিজ উপাদান ও রন্ধনশৈলীর প্রভাব নিয়ে।
সরাচিত্র
বাংলায় সরা চিত্রকলার ঐতিহ্য সুদীর্ঘ। সরা আঁকার চল রয়েছে আজও, তার বিষয় মূলত দেবদেবী। এই সরার গায়েই আলপনা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে অনন্য নজির গড়েছেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের দুই প্রাক্তনী সৌরভ ঘোষ ও তৃণা চট্টোপাধ্যায়। সৌরভের আলপনায় হাতেখড়ি তাঁর বাবা ননীগোপাল ঘোষের কাছে। নন্দলাল বসুর ছাত্র ছিলেন তাঁর বাবা, কলাভবনের অধ্যাপকের লেখায় রেখায় সেজে উঠত ‘দেশিকোত্তম’ সম্মানের মানপত্র। বাবার দেখানো পথে যাত্রা শুরু করে, দ্বিমাত্রিক এই শিল্পকে স্বতন্ত্র পথ দেখিয়েছেন সৌরভ, বাড়ির মেঝে থেকে ঘরের দেওয়াল, সরা বা ক্যানভাসে ঠাঁই করে নিয়েছে তা। দীর্ঘ দিন শিল্পশিক্ষক হিসাবে কাজ করেছেন তৃণাও। তাঁদের সরা-আলপনা ও পেপার ম্যাশ-এর শিল্পকৃতি (ছবিতে) নিয়ে গ্যালারি চারুবাসনা-য় চলছে প্রদর্শনী ‘রিদমিক নেচার অ্যান্ড নস্টালজিয়া’। ৯ এপ্রিল পর্যন্ত, বিকেল ৩টে থেকে রাত ৮টা, সোমবার ও ছুটির দিন বাদে।
বিরল
তাঁর সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমার অন্যতম প্রিয় ছাত্র।” অধ্যাপক ওসমান গনী (ছবি) প্রয়াত হলেন গত ১৭ মার্চ, অষ্টাশি বছর বয়সে। সুকুমার সেনের কাছে পিএইচ ডি গবেষণা, তাঁর শিক্ষকেরা তাঁকে বিশেষ সম্মান করতেন— যে তালিকায় ছিলেন সুনীতিকুমারও। বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, উর্দুতে সুপণ্ডিত মানুষটি কোরআন ও হাদিসের বাংলা অনুবাদ করেছেন, ইসলাম ধর্মের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন প্রামাণ্য বই। ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ, ইসলাম ও সুফীসমাজ, ইসলামে চিন্তা ও চেতনার ক্রমবিকাশ বইগুলি তাঁর আজীবন মননচর্চার ফসল। দেশভাগের পর যখন এ-পার বাংলায় মুসলিম সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি জগতে শূন্যতা তৈরি হয়, তখন থেকেই এ বাংলায় এক জরুরি স্থান তাঁর। আজ যখন হিন্দু-মুসলমান দুই সমাজেই সেই শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মানুষ কমে আসছে যাঁরা আন্দোলনের ডাকে প্রয়োজনে রাস্তায় নেমে পড়তে পারেন— সেই আকালেও সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে ধর্নামঞ্চে রোজ যোগ দিতেন তিনি। বিরল এক চিন্তক চলে গেলেন।
তাঁকে নিয়ে
“সারাটা জীবন তিনি ব্যাপৃত রাখলেন লিটল ম্যাগাজিনকে আদর করে, তাকে লালন করে, তার অমর্যাদার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তার প্রাপ্য সম্মান যথাসম্ভব প্রতিষ্ঠা করে।” অথ পথ পত্রিকার (সম্পা: হরিসাধন চন্দ্র) ভূমিকায় এই কথাগুলি আজ আরও বেশি করে বুকে বাজছে, কারণ চলে গিয়েছেন সন্দীপ দত্ত। লিটল ম্যাগাজ়িন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেই নয়; কলকাতা, এই রাজ্য, বাংলাদেশ, এমনকি বহির্বিশ্বের মনোযোগী বাংলা ভাষা সাহিত্য-চর্চাপথের অগণিত পথিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উপকৃত তাঁর কাছে। সন্দীপ দত্তের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে আলাপচারিতার মুদ্রিত রূপ প্রাণভ্রমরা এই পত্রিকার, সঙ্গে তাঁকে নিয়ে শঙ্খ ঘোষ পবিত্র সরকার সুভাষ ভট্টাচার্য অমর মিত্র প্রমুখের কথা, তাঁকে নিয়ে।