শ’দুয়েক বছর আগেই কলকাতার আশেপাশে দর্শন দিতেন দক্ষিণ রায়। ১৮১৯ সালের সমাচার দর্পণ দমদম অঞ্চলে বাঘ ও মানুষের সংঘর্ষের খবর দিয়ে মন্তব্য করেছিল, গঙ্গাসাগরে বন কেটে বাঘ তাড়িয়ে বসতি হওয়ায় বাঘ মানুষের এলাকায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সশরীরে কলকাতার বুকে তেমন সুবিধে করতে না পারলেও চিহ্ন ও প্রতীক হিসেবে বাঘ সর্বত্রগামী। চিৎপুরে চিত্তেশ্বরী মন্দিরে দেবীর পদতলে ঘোড়ামুখ সিংহের পাশে বাঘের অস্তিত্ব তারই নিদর্শন। ‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় থেকে বিপ্লবী বাঘা যতীন, ‘বেঙ্গল টাইগার’ কলকাতার রাজপুত্র বয়ে চলেছেন স্বীয় ক্ষেত্রে বাঙালির গৌরবকেতন। বাংলার জামাই ‘টাইগার’ পটৌডী আর জামাইয়ের পাতে ‘টাইগার প্রন’-এও বাঘের অনুষঙ্গ!
পোষ্য এক জোড়া বাঘের কল্যাণে নদিয়া রাজবংশের কলকাতার আবাস ‘নদিয়া হাউস’লোকমুখে ‘বাঘওয়ালা বাড়ি’ নামেই পরিচিতি পায়। মূল ফটকের উপর সিংহমূর্তি থাকা সত্ত্বেও শোভাবাজারে রাধাকান্ত দেবের ঠাকুরদালানকে লোকে বলে বাঘওয়ালা বাড়িই! বিপণন-জগতে নানা পণ্যের প্রতীক হয়েছে বাঘ। ফিনাইল, দেশলাই, বিস্কুট থেকে ইমারতি দ্রব্যের ব্র্যান্ডিংয়ে বাঘের ছড়াছড়ি। ট্রেনে বাসে ফেরিওয়ালারা বিক্রি করেন ব্যথানাশক মলম বা ‘বাম’, তার নামেও বাঘ!
বিনোদনবিশ্বেও বাঘের দর ঈর্ষণীয়। সার্কাসে বাঘা শ্যামাকান্ত বা শার্দূলসুন্দরী সুশীলার বাঘের খেলা ধর্মতলা এলাকার ‘টাইগার’ সিনেমাহলের মতোই বিলুপ্ত হলেও তার স্থায়ী আসন বিনোদন-ইতিহাসে। দাপুটে বাঘের ইমেজ মেকওভারও হয়েছে এ শহরে, প্রমাণ কলকাতায় দক্ষিণ এশীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ‘ম্যাসকট’ শান্তশিষ্ট বাঘ ‘বাবু’ আর শহরের দোকানে সফ্ট টয় খোকা বাঘেদের দল। ফেলুদার রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য থেকে এ শহরের কাফে-পানশালার নামেও ডোরাকাটার উল্লম্ফন!
স্বাধীনতা-উত্তর যুগে কলিকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার লাল বাসগুলিতে আঁকা থাকত প্রতীক— বাঘের মুখ। সরকারি বাস লাল থেকে নীল হয়েছে, সেই প্রতীকও উধাও। বিডন স্ট্রিটে এক পুরনো বাড়ির গায়ে ইত্তেফাক-ইতেমাদ-কুরবানি মন্ত্র আর রানি ঝাঁসি বাহিনীর নামফলকের মাঝে আজও চোখে পড়ে লাফানো বাঘের ছবি। মহানাগরিক অস্তিত্ব অস্তিত্ব থেকে বন্য বাঘ দূরে সরে গেলেও শহরের মনোজগতে তার ছাপ মোছেনি, তাই হয়তো আলিপুর চিড়িয়াখানার পাশাপাশি সে ফিরে আসে শহরের পথপাশে কি পার্কে, ফাইবার গ্লাসের অবতারে (ছবিতে)। পরিবেশ সংরক্ষণে বাঘের গুরুত্বের কথা মনে করাতে ২৯ জুলাই পালিত হয় আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস— চলে গেল গতকাল। সেই উপলক্ষে আজ বিকেল ৫টা থেকে বৌবাজারের বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভায় ‘সম্প্রীতি আকাদেমি’-র আয়োজনে আলোচনা সুন্দরবনের জল জঙ্গল বাঘ মানুষ নিয়ে, সেই সঙ্গে হবে সুরঞ্জন মিদ্দের লেখা বিপন্ন বাঘ: নিরন্ন বিধবা (একুশ শতক) গ্রন্থপ্রকাশও। ছবি: শুভেন্দু চাকী
অন্বেষক
গবেষক সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষের প্রয়াণদিন ছিল গত ২৪ জুলাই। ইতিহাস, নৃতত্ত্বের সীমা পেরিয়ে বহুধাবিস্তৃত তার কর্মপরিধি: নাগরিক মনন নিয়ে কলকাতার ইতিহাস সন্ধানের পাশাপাশি খুঁজেছেন পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতিতে লুকিয়ে থাকা সমাজচিত্র; ক্ষেত্রসমীক্ষা, পুঁথি, দলিল আদি প্রাথমিক উৎসভিত্তিক গবেষণায় তাঁর কৃতির সাক্ষী কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, মেট্রোপলিটন মন, মধ্যবিত্ত, বিদ্রোহ ইত্যাদি গ্রন্থ। আবিষ্কারের আনন্দে কাজ করে যাওয়া মানুষটি বার বার জীবিকা বদলেছেন। কাজ করেছেন ফরওয়ার্ড, যুগান্তর, দৈনিক বসুমতী-তে, অরণি পত্রিকায় তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শভিত্তিক লেখাগুলিও ভাবায়। গত ২৪ জুলাই তাঁর জীবনকৃতি নিয়ে আন্তর্জালে বললেন বাসবী চক্রবর্তী, ‘ভয়েজেস ইনটু দ্য পাস্ট: অতীতপ্রবাহ’ ফেসবুক পেজের উদ্যোগে। শোনার সুযোগ এখনও। ছবি ই-প্রচারপত্র থেকে।
মেলবন্ধন
‘ইন্দিরা’ সঙ্গীত শিক্ষায়তন আয়োজিত ‘সুভাষ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা’র সপ্তম বছর এ বার, হয়ে গেল গত ১৬ জুলাই, ইন্দুমতী সভাগৃহে। রুশতী সেন বললেন সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রগানের প্রয়োগ নিয়ে। তেরোটি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সেরা আখ্যা দিয়েছিলেন সত্যজিৎ, ছবিতে ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে দু’টি, কাঞ্চনজঙ্ঘা-য় অমিয়া ঠাকুরের গাওয়া ‘এ পরবাসে রবে কে’ তারই একটি। কাপুরুষ ছবিতে বিমলের বাংলোয় আসে অমিতাভ, করুণা তখন চিত্রাঙ্গদা শোনায় মগ্ন। সেই সন্ধ্যায় দৃশ্যের ফাঁকে নানা নাটকীয় মোড়ে শোনা যায় চিত্রাঙ্গদা-র গান। তিন কন্যা-তেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর, অপুর সংসার-এ অপুর বাঁশিতে বাজে ‘আমার সোনার বাংলা’। আগন্তুক-এ শ্রমণা গুহঠাকুরতার কণ্ঠে ‘বাজিল কাহার বীণা’... রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পূর্ণত শোনানো সত্যজিৎ-ছবিতে ব্যতিক্রম। রবীন্দ্রগান ও সত্যজিতের ছবির একাত্মতা উদ্ভাসিত বক্তার বিশ্লেষণে।
ছোট ছবি
২০১৮ সালে শুরু হয় ‘সাউথ এশিয়ান শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া-র পূর্বাঞ্চলীয় শাখার উদ্যোগে— দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশের ছোট ছবির সাগর ছেঁচে মণিমুক্তো তুলে আনা আর দেখানোর পরিসর— সিনেমাপ্রেমী এ শহরে। পঞ্চম বছরের উৎসব এ বার নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে, আগামী ৩-৬ অগস্ট, দুপুর দেড়টা থেকে সন্ধে সাড়ে ৭টা। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালের ছবি-করিয়েদের তৈরি শর্ট ফিকশন ও তথ্যচিত্র বিন্যস্ত হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক ও প্যানোরামা-সহ চারটি বিভাগে, ভারতীয় ছবিই বেশি। ‘সাউথ এশিয়ান শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটে (এসএএসএফএফ ডট ইন) জানা যাবে উৎসবের বিশদ তথ্য।
স্মৃতি ও কথা
৩১ জুলাই তাঁর প্রয়াণদিন, বছরটি ২০১৪। পরের বছর নবারুণ ভট্টাচার্য স্মরণে যে সংখ্যাটি প্রকাশ করে তাঁরই হাতে গড়া ভাষাবন্ধন পত্রিকা, তার শিরোনাম ছিল ‘পেট্রল দিয়ে আগুন নেভাবার স্বপ্ন’। স্বপ্ন বেঁচে আছে আজও, তাঁর প্রয়াণদিন স্মরণে ভাষাবন্ধন পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থা, লেখক-পরিবার ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা মিলে প্রতি বছর আয়োজন করেন একটি স্মারক বক্তৃতা। আগে সেখানে বলেছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অম্লান দাশগুপ্ত হিরণ মিত্র সোহিনী সেনগুপ্ত মৈত্রীশ ঘটক প্রমুখ, সাহিত্য শিল্প শিক্ষাজগতের বিশিষ্টজনেরা। আজ ৩০ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাগৃহে এ বছরের নবারুণ ভট্টাচার্য স্মারক বক্তৃতা, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন ‘বিজন-মহাশ্বেতা-নবারুণ’ নিয়ে। নানা সূত্রে নানা সময় তিন জনেরই ঘনিষ্ঠ ছিলেন বক্তা, উঠে আসবে সেই সব স্মৃতি ও কথা। রয়েছে গ্রন্থপ্রকাশও।
৫০ পেরিয়ে
৫০ পূর্ণ করে ৫১ বছরের পথে যাত্রা শুরু করল ‘নাট্যরঙ্গ’। এই নাট্যদলটি বাংলা থিয়েটারকে উপহার দিয়েছে আত্মকথা, সিরাজদ্দৌলা, ঘরে বাইরে, সাজাহান, শ্রীশম্ভু মিত্র, মিস্টার ভুলু, ঝড়ের পাখি, শ্রীমধুসূদন-এর মতো বহু দর্শকধন্য নাটক। দলের কর্ণধার স্বপন সেনগুপ্ত, এ দল থেকেই বেড়ে উঠেছেন সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মঞ্চাভিনেতা। ৩ ও ৪ অগস্ট অ্যাকাডেমি মঞ্চে সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছে দল, তারই অঙ্গ হিসেবে প্রথম দিন সংবর্ধিত হবেন মঞ্চরূপকার বিলু দত্ত, দেবশঙ্কর হালদারের হাতে। অভিনীত হবে পৌলমী চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘মুখোমুখি’র দু’টি নাটক টাইপিস্ট ও অন্ধযুগ, নাট্যরঙ্গের নাটক অঙ্গীকার।
ত্রয়ী
সনৎ কর, গণেশ হালুই, যোগেন চৌধুরী। তিন জনেরই জন্ম গত শতকের ত্রিশের দশকে মধ্য ও শেষ ভাগে, তিন জনেরই শিল্পপাঠ প্রতিষ্ঠান কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ। স্বাধীনতা-উত্তর কালে, বেঙ্গল স্কুল-পরবর্তী সময়ে বাংলার শিল্পে নবধারা ও আধুনিকতার সংযোজনে এই তিন শিল্পীর অবদান স্মরণীয়। সনৎ করের ছাপচিত্র চর্চা ও ‘প্লাইউড ইন্তাল্লিয়ো’র প্রবর্তন, গণেশ হালুইয়ের বিমূর্ত শিল্পসৃষ্টি, যোগেন চৌধুরীর চিত্রকৃতির বিস্তৃত পরিসর বঙ্গ তথা ভারতশিল্পকে পৌঁছে দিয়েছে বৈশ্বিক উত্তরণভূমিতে। এ বার এই তিন শিল্পীর কাজ নিয়ে ‘মায়া আর্ট স্পেস’ গ্যালারিতে শুরু হতে চলেছে প্রদর্শনী, বেঙ্গল মাস্টার্স— আজ সন্ধ্যা ৬টায়। চলবে ৭ অগস্ট পর্যন্ত, প্রতি দিন দুপুর দু’টো থেকে রাত ৮টা। নীচে ছবিতে বাঁ দিকে সনৎ করের লিথোগ্রাফ, ডান দিকে যোগেন চৌধুরীর চিত্রকৃতি।
মল্লারসুরে
গুজরাতি লোকসংস্কৃতিতে আছে সেই দুই বোনের কথা— তানা আর রিরি। দীপক রাগ গেয়ে তানসেন যখন দগ্ধপ্রায়, গুজরাতের বড়নগরের সুগায়িকা এই দুই বোনের কণ্ঠে মল্হার বা মল্লার রাগ সুরসাধকের শরীর জুড়িয়েছিল, শান্ত করেছিল অন্তর। হিন্দুস্থানি মার্গসঙ্গীতে মল্লার রাগের সঙ্গে জড়িয়ে এমনই বহু আখ্যান ও কিংবদন্তি। বর্ষার অবিরত ধারাপাতের সঙ্গে আশ্লিষ্ট সুগম্ভীর স্বর ও মেজাজের এই রাগ; কত রকম তার রূপও— শুদ্ধমল্লার, মেঘমল্লার, গৌড়মল্লার, তানসেন ও মীরাবাইয়ের মল্লার, রামদাসি ও সুরদাসি মল্লার, দেশমল্লার, আনন্দমল্লার। বাংলায় ভরা শ্রাবণ এখন, শহরের মেঘমুলুকে জমেছে বাদলরাগিণী। শিল্পীর কণ্ঠে ও বাদনেও বর্ষার রণন শোনা যাবে আজ, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কের বিবেকানন্দ হল-এ, সন্ধে সাড়ে ৫টায় মল্লার উৎসবে। সরোদে পণ্ডিত পার্থসারথি চৌধুরী, তবলায় পণ্ডিত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়; কণ্ঠসঙ্গীতে ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সঙ্গতে গৌরীশঙ্কর কর্মকার ও গৌরব চট্টোপাধ্যায়। ছবিতে রাগমালা চিত্রাবলিতে মল্লার রাগের দৃশ্যরূপ, ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
উত্তরণ
তিন বোনের গল্প। আসলে কর্কশ বাস্তব। মানসিক চিকিৎসার হাসপাতালে ফেলে আসা হয়েছিল তাঁদের। বহু বছর পেরিয়ে তাঁদের পরিবারে ফেরার, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা... এই নিয়েই পুতুল মাহমুদের ছবি থ্রি সিস্টার্স। তিন বোনের কঠিন শ্রম যেন এক ভ্রমণ, অন্ধকার তার অনেকটাই। ‘নন-ফিচার’ বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেল ছবিটি, ক’জনই বা খবর রাখি! সাদা-কালোর বাস্তবে কাহিনিচিত্রও গড়ে তোলে মায়াবী পর্যটন, প্রমাণ সুপ্রতিম ভোলের ক্যামেরায় তোলা অভিযাত্রিক; সিনেম্যাটোগ্রাফির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেলেন তিনি এ বার। শুভ্রজিৎ মিত্রর পরিচালনায় সেরা বাংলা ছবির শিরোপাও এ ছবির। ভারতের মানচিত্রে স্বর শোনা গেল কলকাতার, বঙ্গসংস্কৃতির নিস্তরঙ্গ দৈনন্দিনে অনাস্বাদিত উত্তরণস্পর্শ।