শঙ্কায় শহর, রাতভর উল্লাসে দাপাবে শব্দদৈত্য

মাঝ রাত পেরিয়ে পাড়ায় জলসা শেষ হচ্ছে না। উল্টে জোর থেকে জোরালো হচ্ছে ‘ডিজে’ বক্সের আওয়াজ। তীব্র আওয়াজে নাজেহাল দক্ষিণ শহরতলির একটি পাড়ার বাসিন্দারা। কিন্তু স্থানীয় ক্লাবের সদস্যদের ‘ভয়ে’ কেউই প্রতিবাদ করতে পারেননি। অবশেষে পরিচয় গোপন রেখেই ফোন করেছিলেন লালবাজার কন্ট্রোলে।

Advertisement

শিবাজী দে সরকার ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:৪২
Share:

মাঝ রাত পেরিয়ে পাড়ায় জলসা শেষ হচ্ছে না। উল্টে জোর থেকে জোরালো হচ্ছে ‘ডিজে’ বক্সের আওয়াজ। তীব্র আওয়াজে নাজেহাল দক্ষিণ শহরতলির একটি পাড়ার বাসিন্দারা। কিন্তু স্থানীয় ক্লাবের সদস্যদের ‘ভয়ে’ কেউই প্রতিবাদ করতে পারেননি। অবশেষে পরিচয় গোপন রেখেই ফোন করেছিলেন লালবাজার কন্ট্রোলে। বার বার ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। তারও বেশ কিছু পরে বন্ধ হয়েছিল ওই জলসা!

Advertisement

দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর রাতে শব্দের তাণ্ডব শহরবাসীর কাছে অচেনা নয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পাড়ায়-পাড়ায় গজিয়ে উঠছে বর্ষবরণ উৎসব। তার জেরেই বর্ষশেষের রাতে শব্দ দূষণের দাপটে নাকাল হন মানুষ।
যার উদাহরণ দক্ষিণ শহরতলির ওই পাড়া। শব্দদানবের এই নয়া রূপ আটকাতে এ বার উঠেপড়ে লাগছে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।

পরিবেশ দফতরের জারি করা এক নির্দেশিকা অনুযায়ী, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় দিনে-রাতে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা কত থাকবে, তা নির্দিষ্ট রয়েছে। পর্ষদ সূত্রে খবর, সেই নির্দেশিকা যাতে বর্ষশেষের রাতে জোরালো ভাবে লাগু করা হয়, সে কথা জানানো হয়েছে। পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘বর্ষবরণ উৎসব যাতে মানুষের কাছে কষ্টের না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করতে চাই’’।

Advertisement

পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, এ বছর বড়দিনের আগের রাত থেকেই শহরের নান প্রান্তে মাঝ রাত পর্যন্ত জলসা শুরু হয়েছে। হরিদেবপুর, বেহালা, ট্যাংরা, ঠাকুরপুকুর, টালিগঞ্জ, পাটুলি থেকে প্রায় প্রতি রাতেই অভিযোগ আসছে। অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলেও দাবি পুলিশকর্তাদের। পরিবেশকর্মীদের অনেকেই বলছেন, ২০০৯-এ এই নির্দেশিকা জারি হলেও এটি লাগু করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন ধরেই গাফিলতি আছে। ফলে উৎসবের রাতে জলসা, পিকনিকে গাঁক-গাঁক করে মাইক বাজে। কিন্তু গত বছর পর্যন্তও এ নিয়ে পর্ষদ, পরিবেশ দফতর বা পুলিশের তেমন মাথাব্যথা ছিল না। পরিবেশকর্মীদের অনেকে অবশ্য বলছেন, এ নিয়ে বারবার সরব হয়েছিলেন তাঁরা। সম্প্রতি পরিবেশ সংগঠনের যৌথ মঞ্চ ‘সবুজ মঞ্চ’র প্রতিনিধিরা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনারের দফতরে সক্রিয় হওয়ার আর্জি জানিয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন।

পরিবেশকর্মীদের একাংশ অবশ্য বলছেন, শব্দের দাপট রুখতে নির্দেশিকা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু শব্দবাজি, মাইকের উৎপাত রুখতে আগেও নির্দেশিকা জারি হয়েছে। কালীপুজোর রাতে সক্রিয় থাকে পুলিশ ও পর্ষদ। তাতে কাজের কাজ হয় কি? আমজনতার অভিজ্ঞতা, কালীপুজোর রাতে তো রেহাই মেলেই না, পরেও টানা ক’দিন জলসা চলতে থাকে। অনেক সময়েই প্রশাসনের সাহায্য মেলে না।

পুলিশের একাংশ বলেন, শব্দবাজি হোক বা মাইক, অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে অভিযোগই তো মেলেই না, আটকাতে গেলে স্থানীয়েরা প্রতিবাদ করেন। সবুজ মঞ্চের আহ্বায়ক নব দত্ত অবশ্য বলছেন, ‘‘পরিবেশ দফতরের নির্দেশিকা বলে পুলিশ নিজেই মাইক বন্ধ করতে পারে। তা না করে অভিযোগ আসার অপেক্ষায় থাকে।’’ তাঁর কথায়, পাড়ার অনুষ্ঠানের প্রতিবাদ করলে সমস্যা হতে পারে, এই আশঙ্কায় অনেকে অভিযোগ জানান না। ফলে ফি বছর মাইকের উৎপাত বাড়ছে। পর্ষদের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমরা শব্দ দূষণ রোখা নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আইন লাগু করতে পুলিশ-প্রশাসনের উপরে নির্ভর করতে হয়।’’ তবে নববাবুর দাবি, পর্ষদও সম্পূর্ণ দায় এড়াতে পারে না।

অভিযোগ পেলেও সর্বদা যে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে না, তা মেনে নিয়েছে পুলিশের একাংশ। তাঁরা বলছেন, প্রায় সব ক্লাবের মাথায় কোনও রাজনৈতিক নেতার হাত থাকে। তাই ব্যবস্থা নিতে গিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়। উত্তর কলকাতার এক ওসি-র অভিজ্ঞতা, মাঝ রাতে ডি়জে বাজছে অভিযোগ পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যেতেই ফোনে এক নেতার ঠান্ডা গলায় ‘অনুরোধ’, ‘‘কিছু কিছু বলবেন না। একটু পরেই জলসা শেষ হবে।’’ ফিরে গিয়েছিলেন ওই ওসি।

তাই এ বার নির্দেশিকা হাতে নিয়েও কাজের কাজ কতটা হবে, সেই ধন্দ রয়েছে পুলিশের অন্দরেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement