পুরসভায় তৃণমূল বোর্ড। সরকারও দলেরই হাতে। তবু অভিযোগ, কলকাতায় ভেজাল খাবার বিক্রি রুখতে পরিকাঠামো গড়ার পুর-প্রচেষ্টায় বাদ সাধছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরেরই খাদ্য সুরক্ষা বিভাগ। পরিকাঠামো গড়ার টাকাপয়সা মজুত। এসে গিয়েছে কেন্দ্রের অনুমতিও। তবু বিষয়টি এ রাজ্যে ‘লাল ফিতের ফাঁসে’ আটকে রয়েছে বলে অভিযোগ।
নিজেদের সরকারেরই এই ‘বিমাতৃসুলভ’ আচরণে ক্ষুব্ধ পুরকর্তারা। পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘মজার কথা হল, ওই পরিকাঠামো গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের অনুমোদন মাস কয়েক আগেই পৌঁছে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও অনুমোদনের বিষয়টি আটকে রয়েছে রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে।’’ কেন্দ্র ছাড় দিলেও কেন আটকে রাখছে রাজ্যের খাদ্য সুরক্ষা কমিশনারের দফতর? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজ্যের খাদ্য সুরক্ষা কমিশনার গোধূলি মুখোপাধ্যায় শুধু বলেন, ‘‘এ রকম কোনও ব্যাপার নেই।’’
পুরসভা সূত্রের খবর, ২০১২ থেকে ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত ফুড লাইসেন্স বাবদ প্রায় ৬ কোটি টাকা পুরসভার ভাঁড়ারে জমা রয়েছে। পুরসভার এক অফিসার জানান, বর্তমানে শহরের ১৪৪টি ওয়ার্ডের জন্য ফুড ইনস্পেক্টরের সংখ্যা মাত্র ২২ জন। ভেজাল খাবারের নমুনা পরীক্ষার জন্য নেই কোনও আধুনিক ল্যাবরেটরিও। তাই পুর-প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়, ফুড লাইসেন্স বাবদ আদায় হওয়া ওই টাকা থেকে প্রতি বছর ২ কোটি টাকা করে ব্যয় করা হবে পরিকাঠামো গড়ার কাজে। লোকবল বাড়ানো, পরীক্ষাগার তৈরির মতো কাজে ফুড লাইসেন্স খাতে আদায় হওয়া টাকা খরচের অনুমতি চেয়ে গত অগস্টে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীন ফুড সেফটি কমিশনারের কাছে আবেদন জানান পুর-কমিশনার খলিল আহমেদ। সেপ্টেম্বরে তা অনুমোদন করে পাঠায় দিল্লি। জানিয়ে দেয়, ফুড লাইসেন্সের জমা টাকা থেকে ভেজাল প্রতিরোধের পরিকাঠামো তৈরি করতে পারে কলকাতা পুরসভা।
নিয়ম মাফিক পরে বিষয়টি রাজ্য ফুড কমিশনারের কাছেও অনুমোদনের জন্য পাঠান পুর কতৃর্পক্ষ। কিন্তু চার মাস পার হলেও এখনও তার কোনও জবাব মেলেনি। সর্বশেষ গত ২৯ নভেম্বর পুরসভা রাজ্য ফুড কমিশনারের কাছে বিষয়টি অনুমোদনের জন্য আবেদন জানায়। ওই চিঠিতেই জানানো হয়েছে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ফুড লাইসেন্স বাবদ পুরসভার ভাঁড়ারে জমা রয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। ভেজাল রুখতে পুরসভা কী পরিকাঠামো করতে চায়, তার একটি রোডম্যাপও ওই চিঠির সঙ্গে দেওয়া হয়। এ-ও বলা হয়, ওই বাবদ খরচ হতে পারে ২ কোটি ৬২ লক্ষ টাকার মতো। কিন্তু এখনও তার কোনও জবাব আসেনি বলে পুরসভা সূত্রের খবর।
কলকাতা শহরে খাবারে ভেজাল দেওয়া রুখতে অনেক কাল আগে হল্লা পার্টির অভিযান দেখা যেত। পুরসভাতেও ভেজাল প্রতিরোধের দফতর রয়েছে। তবে দীর্ঘকাল ওই দফতরের কোনও কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি শহরবাসীর। যখনই এ নিয়ে কথা উঠেছে, বারবারই পুরসভার তরফে বলা হয়েছে এত বড় শহরে অভিযান চালানোর মতো পরিকাঠামো পুর-প্রশাসনের নেই। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে তৃণমূল পুর-বোর্ড ভেজাল খাবারের বিরুদ্ধে অভিযান কর্মসূচি নেয়। এমনকী, পুজোর চার দিনেও শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে রাস্তার ধারের ছোটখাটো খাবার দোকান থেকে শুরু করে নামীদামি রেস্তোরাঁতেও হানা দেন পুরসভার ফুড ইনস্পেক্টরেরা। তবে অনেকের মতে, সে সময়ে যতটা গর্জন করা হয়েছিল, পরে তাতে ক্রমশই ভাটা পড়েছে। এর প্রধান কারণ যে পরিকাঠামোর অভাব, তা জানাতে ভোলেননি পুরসভার এক আমলা।
সেই ‘অক্ষমতা’ থেকে ভেজাল দফতরকে চাঙ্গা করার কাজে উদ্যোগী হয় পুর-প্রশাসন। কিন্তু ফুড লাইসেন্স বাবদ মজুত টাকা ব্যবহারে রাজ্য সরকারের অনুমোদন না মেলায় পুরো বিষয়টিই এখনও আটকে।
পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ এ বিষয়ে বলেন, ‘‘গত জুন মাসে রাজ্য ফুড কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলাম। সেখানেই শহরের ভেজাল প্রতিরোধে পরিকাঠামো গড়ার বিষয়ে কথাবার্তা হয়। ফুড লাইসেন্স বাবদ জমা টাকা থেকে ওই কাজ করার ব্যাপারেও কথা হয়।’’ অতীনবাবু জানান, তার ভিত্তিতেই দিল্লিতে আবেদন জানানো হয়েছিল। সেই অনুমতি এলেও আপাতত রাজ্যেই তা আটকে থাকায় পরিকাঠামো গঠনের বিষয়টি থমকে গিয়েছে বলে মনে করছে পুর-প্রশাসন।