দক্ষিণের পাশাপাশি উত্তরের একাধিক ওয়ার্ডেও ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ছে। ফাইল চিত্র।
ডেঙ্গির দাপট শহরে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। গত কয়েক মাসে পর পর মৃত্যু এবং আক্রান্তের ঊর্ধ্বমুখী লেখচিত্র দেখে তুলনা টানা হচ্ছে ২০১৯ সালের ডেঙ্গি পরিস্থিতির সঙ্গে। অথচ, মশাবাহিত এই রোগ নিয়ন্ত্রণে কলকাতা পুরসভার নিজস্ব ভেক্টর কন্ট্রোল বিভাগ রয়েছে। যে বিভাগে আছেন এক জন মুখ্য পতঙ্গবিদ, চার জন পতঙ্গবিদ ও প্রায় ১৭০০ ‘ফিল্ড ওয়ার্কার’। পুর বাজেটে যে বিভাগের জন্য বছরে বরাদ্দ হয় প্রায় ৬০ কোটি টাকা। ১৪৪টি ওয়ার্ডে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে ৪০টি গাড়ি মোতায়েন করা হয়েছে বলেও দাবি পুরসভার। ফলে প্রশ্ন উঠছে, এত কিছু থাকা সত্ত্বেও কেন বার বার ফিরে আসছে আতঙ্ক? তা হলে এই বিপুল পরিকাঠামো কী কাজে লাগছে?
মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) তথা ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ অতীতে দাবি করেছিলেন, ‘‘মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে কলকাতা পুরসভার যা পরিকাঠামো রয়েছে, অন্য কোথাও তা নেই।’’ যে পরিপ্রেক্ষিতে সব স্তর থেকে প্রশ্ন উঠছে, রোগই ঠেকানো না গেলে ‘সেরা পরিকাঠামো’ থেকে লাভ কী?
এই মুহূর্তে দক্ষিণের পাশাপাশি উত্তরের একাধিক ওয়ার্ডেও ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ছে। কলকাতা পুরসভা প্রতি বছর শুধু মশাবাহিত রোগ ঠেকাতে যত টাকা বাজেটে বরাদ্দ করে, তা ছোটখাটো কোনও পুরসভার সার্বিক বাজেট বরাদ্দের সমান। বিজেপি কাউন্সিলর সজল ঘোষের অভিযোগ, ‘‘মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে পুরসভা কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। অথচ, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি বেড়েই চলেছে। তা হলে এত খরচ করে লাভ কী হচ্ছে?’’
ভেক্টর কন্ট্রোল বিভাগের কাজ নিয়ে সরব স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসকদের একাংশও। তাঁদের অভিযোগ, মশাবাহিত রোগ ঠেকানোর দায়িত্ব এই বিভাগের। অথচ, ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়লেই সব দায় চিকিৎসকদের ঘাড়ে এসে পড়ে। এক পুর স্বাস্থ্য আধিকারিকের অভিযোগ, ‘‘ভেক্টর কন্ট্রোল বিভাগের কাজে খামতি আছে। তাই ডেঙ্গির দাপট বাড়ছে।’’ মশাবাহিত রোগ দমনে ২০০৬ সাল থেকে পুরসভা ‘ফিল্ড ওয়ার্কার’ নিয়োগ করছে। বর্তমানে গোটা শহরে প্রায় ১৭০০ জন এমন কর্মী আছেন। ১৪৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে এক জন করে ওয়ার্ড ভেক্টর কন্ট্রোল ইন-চার্জ নিয়োগ করা হয়েছে। আবার ১৬টি বরোতে এক জন করে বরো ভেক্টর কন্ট্রোল ইন-চার্জ রয়েছেন। ওয়ার্ড ভেক্টর কন্ট্রোল ইন-চার্জের কাজ হল, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশাবাহিত রোগ সম্পর্কে তথ্য নেওয়া (কোথাও জল জমে রয়েছে কি না বা আবর্জনা পড়ে রয়েছে কি না)। আবার ওয়ার্ড ভেক্টর কন্ট্রোল ইন-চার্জেরা ঠিক মতো কাজ করছেন কি না, তা দেখার দায়িত্ব বরো ভেক্টর কন্ট্রোল ইন-চার্জের। অভিযোগ, ওয়ার্ড ও বরোর খাতায়-কলমে এই সব গালভরা নামের পদ থাকলেও পথে নেমে তাঁদের কাজ করতে দেখেছেন, এমন লোক বিরল।
পুর স্বাস্থ্য বিভাগের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘অধিকাংশ ফিল্ড ওয়ার্কারদের মনোনীত করেন কাউন্সিলরেরা। তাঁরা যে ওয়ার্ডের বাসিন্দা, সেই ওয়ার্ডেই কাজ করেন। তাই তাঁদের কাজ নিয়ে অভিযোগ উঠলে কাউন্সিলরেরা ঢাল হয়ে দাঁড়ান। ফলে অভিযোগ করেও কাজের কাজ কিছু হয় না।’’ ওই কর্মীদের আবার দাবি, তাঁদের কাজে খামতি নেই। তবে চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় তাঁদের বিস্তর ক্ষোভও রয়েছে।
যদিও ভেক্টর কন্ট্রোল বিভাগের কাজে খুশি মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) ও মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) দাবি করেন, ‘‘মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে আমাদের যা পরিকাঠামো রয়েছে, ভারতের কোথাও তা নেই। আমাদের প্রত্যেক কর্মী মশা চেনেন। আমরা কলকাতায় ডেঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। যেখানে সিঙ্গাপুরের মতো দেশও ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।’’ অতীনের যুক্তি, ‘‘ডেঙ্গি হবে না, এই গ্যারান্টি কে দেবে? ২২২ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে কলকাতা বিস্তৃত। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫ হাজার মানুষের বাস। অনেকেই বাড়িতে জল জমিয়ে রাখছেন, নোংরা করছেন। এত মানুষকে সচেতন করা কি সোজা?’’
পুরসভার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুব্রত রায়চৌধুরীর দাবি, ‘‘ভেক্টর কন্ট্রোল বিভাগ যথেষ্ট ভাল কাজ করছে। জনগণ সচেতন না হলে কিছু করার নেই। ওই বিভাগ না থাকলে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতে পারত।’’