প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ছাত্রদের সঙ্গে কমল শর্মা। খড়্গপুরে। ছবি: কিংশুক আইচ
আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, খেলোয়াড়দের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। ম্যাচ ও প্রস্তুতির সময়ে মাঠে থাকবে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, অ্যাম্বুল্যান্স, এক জন চিকিৎসকও। দ্রুত পদক্ষেপ করতে পর্যবেক্ষকের পাশাপাশি আম্পায়ারদেরও ‘সিপিআর’ (কার্ডিয়ো-পালমোনারি রিসাসিটেশন)-এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কিন্তু এত দিনেও সেই সব আশ্বাস কার্যকর হয়েছে কি?
প্রশ্নটা করতে করতেই গলা বুজে আসে মেদিনীপুরের বছর বাষট্টির কমল শর্মার। ছেলে হারানোর শোক কোনওমতে সামলে তিনি বলেন, ‘‘কোনও মৃত্যুতেই কারও হুঁশ ফেরে না। মৃত্যুর মিছিল চলতে থাকে।’’
কমলবাবুর একমাত্র ছেলে, বাংলার উঠতি ক্রিকেটার অনিকেতের মৃত্যু হয় ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি। তখন উত্তর কলকাতার পাইকপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে প্রথম ডিভিশন লিগ খেলছিলেন বছর একুশের অনিকেত। ক্রিকেটার সুশীল শিকারিয়ার হাত ধরেই ময়দানে আসা তাঁর। ম্যাচের আগের দিন প্রস্তুতি চলাকালীন হঠাৎ মাঠে পড়ে যান অনিকেত। আর জি করে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয় তাঁকে।
সতীর্থেরা জানিয়েছিলেন, সে দিন কিছু ক্ষণ অনুশীলনের পরে ফুটবল খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন কোচ। কিন্তু ফুটবল নিয়ে আসার কিছু ক্ষণের মধ্যেই পড়ে যান অনিকেত। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। পরে দেহের ময়না-তদন্ত হয়।
এর পরে একই রকম ঘটনা ঘটে বাটা ক্লাবের মাঠে। খেলার মাঝেই মৃত্যু হয় বালিগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের ২২ বছরের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান সোনু যাদবের। দ্রুত ট্যাক্সি করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সিএবি-র মেডিক্যাল ইউনিটে। সেখান থেকে সিএবি-র অ্যাম্বুল্যান্সে করে এসএসকেএমে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রশ্ন ওঠে, একের পর এক এমন ঘটনাতেও কেন মাঠে প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগটুকু থাকবে না? কেন অ্যাম্বুল্যান্স না পেয়ে অ্যাপ-ক্যাব বা ট্যাক্সিতে হাসপাতালে পাঠাতে হবে?
রবীন্দ্র সরোবরে রোয়িং করতে নেমে ঝড়বৃষ্টিতে দুই স্কুলছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাতেও এখন এমনই একাধিক প্রশ্ন উঠছে। কেন রোয়িংয়ের নিয়ম মেনে কোনও অনুসরণকারী নৌকা রাখা হয়নি? কোনও পর্যবেক্ষক ছিলেন না কেন? ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও কেন জলে নামতে দেওয়া হল— প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েও। ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার ন্যূনতম পরিকাঠামোটুকু নেই শহরের অধিকাংশ মাঠে। ইডেন লাগোয়া ময়দানে তবু সিএবি-র মেডিক্যাল ইউনিটের সাহায্য পাওয়া যায়। সিএবি-র অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু শহরের অন্য মাঠগুলিতে সেই সুযোগও নেই।
কমলবাবু বলেন, ‘‘এমন কিছু ঘটলে কয়েক দিন আলোচনা হয়, তার পরে যে কে সেই। সমস্যা মেটাতে নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তাই ছেলের নামে কোচিং ক্যাম্প তৈরি করেছি। সেখানে সপ্তাহে চার দিন ৪৫ জন ক্রিকেটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সব রকম নিরাপত্তার বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে। অনিকেতের মতো আর কারও যেন এমন পরিণতি না হয়।’’
ছেলের মৃত্যুর পরে তার স্মৃতিবিজড়িত খড়্গপুরের দক্ষিণ ইন্দার বাড়িতে থাকতে পারেননি। স্ত্রী নিপাদেবীকে নিয়ে গোলবাজার এলাকায় উঠে এসেছেন কমলবাবু। বাবার উৎসাহেই অনিকেতের ক্রিকেটে হাতেখড়ি। আট বছরের ছেলেকে মাঠে নিয়ে যেতেন বাবা। এর মধ্যেই সুযোগ আসে বাংলার অনূর্ধ্ব-১৪ দলে। কমলবাবুর দাবি, পর পর চার বার এই সুযোগ এসেছিল। অনূর্ধ্ব-১৭ দলেও সুযোগ মিলেছিল দু’বার। কলকাতায় প্রথম ডিভিশনের ১০টি ম্যাচে ৭৫০-এরও বেশি রান ও ২৫টি উইকেট নিয়েছিলেন অনিকেত। কিন্তু সে সবই এখন স্মৃতি। ভারতীয় দলের হয়ে ছেলেকে খেলতে দেখার স্বপ্ন পূরণ হল না শর্মা দম্পতির। কিন্তু বাকিরা যাতে তা পারেন, সে জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়েছেন তাঁরা।
সোনুর বাবা রমেশ যাদব অবশ্য এখন ক্রিকেট থেকে অনেক দূরে। ফিরে গিয়েছেন বিহারের সিওয়ানে। ফোনে বললেন, ‘‘ছেলেটাই নেই, আর ক্রিকেট নিয়ে ভেবে কী হবে?’’
(চলবে)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।