সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলাকালীন আরজি করে। ছবি: সুমন বল্লভ।
সারা রাত জেগে চলেছিল প্রতিবাদ-আন্দোলন। তার পরেও, এতটুকু ক্লান্তি না রেখে নতুন উৎসাহ নিয়ে সকালটাও শুরু হয়েছিল।
আর জি করের আন্দোলন মঞ্চে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল প্রোজেক্টর ও স্ক্রিন। তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার প্রতীকী ছবিতে মালা পরিয়ে ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল বেদী। মোমবাতি জ্বালিয়ে চলছিল শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। সবের মধ্যেই যেন একটা ‘বিশ্বাস’-এর ছাপ দেখা যাচ্ছিল আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের। কিন্তু সোমবার বেলা গড়াতেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ধাক্কা দিল এক মাস ধরে সঞ্চয় করা মনোবলে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দিল, মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে কাজে যোগ দিতে হবে জুনিয়র চিকিৎসকদের। তা না করলে রাজ্য সরকার কোনও ব্যবস্থা নিলে আদালতের কিছু করার থাকবে না। প্রধান বিচারপতির এমন নির্দেশের পরেই আন্দোলনকারীদের চোখে-মুখে ফুটে উঠল হতাশার ছবি। অথচ ওই নির্দেশের আগে প্রধান বিচারপতি ওয়াই এস চন্দ্রচূড় যখন রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বলের কাছে তরুণী চিকিৎসকের ময়না তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় চালান দেখতে চাইলেন, তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে তা দেখতে দেখা গিয়েছিল আন্দোলনকারী আবাসিক চিকিৎসকদের। কপিল যখন জানালেন, চালান তাঁর কাছে নেই, সেই সময়ে কয়েক জন আন্দোলকারীর চোয়াল শক্ত হতে দেখা গেল। তারও আগে যখন প্রধান বিচারপতির সামনে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে, তখনও হাততালি পড়েছে আন্দোলন মঞ্চে। আবাসিক চিকিৎসকদের চোখে-মুখে তখনও ছিল আশার আলো।
কিন্তু কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে ফেরার নির্দেশ শুনে প্রায় সকলেই বললেন, ‘‘আমরা হতাশ।’’ আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা জানান, রাজ্য তো বটেই সারা দেশ এ দিন তাকিয়ে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের দিকে। কিন্তু সেখানেও স্পষ্ট হল না যে তদন্ত কতটা এগিয়েছে। এত দিনেও ঘটনার নেপথ্যের কারণ জানা গেল না বলেও অভিযোগ তুললেন আন্দোলনকারীরা। কয়েক জন বললেন, ‘‘ রাজ্যের আইনজীবী জানালেন ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেটা ঠিক নয়। সিনিয়র চিকিৎসকেরা পরিষেবা দিচ্ছেন। আমরাও টেলিমেডিসিন, স্বাস্থ্য শিবির চালাচ্ছি। জঘন্য ঘটনাকে ঘিরে যে প্রতিবাদ, তার ভবিষ্যৎ কী, সেটা স্পষ্ট হল না।’’
সুপ্রিম কোর্টের শুনানি শেষ হতেই আন্দোলন মঞ্চ ছেড়ে আর জি করের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে আবাসিক চিকিৎসকদের জটলা করতে দেখা গেল। তত ক্ষণে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একটি প্রশাসনিক বৈঠক করেছেন। সেখান থেকে তিনি কর্মবিরতি প্রত্যাহার, উৎসবে যোগ দেওয়ার বার্তা দিয়েছেন দেখে আরও হতাশা বেড়ে গেল আন্দোলনকারী আবাসিক চিকিৎসকদের। এমনকি আন্দোলনকারীদের সব দাবি তিনি নাও মেনে নিতে পারেন বলে মুখ্যমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তাতে উষ্মা প্রকাশ করেন আবাসিক চিকিৎসকেরা। আর জি করে আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের তরফে অনিকেত মাহাতো বলেন, ‘‘আলু পটলের ব্যবসা করছি না। তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিবাদ করে কিছু ন্যায় সঙ্গত দাবি রেখেছি। এইটুকু দাবি যদি রাজ্য সরকার মানতে না পারে, তা হলে পথে নামা সাধারণ মানুষকে অসম্মান করা হচ্ছে।’’
আবাসিক চিকিৎসকেরা আরও জানান, আন্দোলনে প্রথম থেকেই তাঁরা রাজনীতির রং লাগতে দিতে চাননি। চিকিৎসক-পড়ুয়া হিসাবে সাধারণ কিছু দাবি রেখেছেন মাত্র। সেগুলি মানতে সরকারের অসুবিধা কোথায়, প্রশ্ন তোলেন ওই জুনিয়র চিকিৎসকেরা। অনিকেত মাহাতো, কিঞ্জল নন্দেরা বলেন, ‘‘আমরা কখনও মুখ্যমন্ত্রী বা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইনি। তবে আশা করেছিলাম, আমাদের ন্যায্য দাবিগুলি সহমর্মিতার সঙ্গে বিবেচনা করে রাজ্য প্রশাসন পদক্ষেপ করবে।’’ পরে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট’-এর সদস্যেরা বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’-স্লোগানেই জারি থাকছে কর্মবিরতি।