তিনি পুলিশ ডেকে ছাত্রদের মার খাইয়েছিলেন। পরে বলেছেন, ছাত্ররা তাঁর সন্তানতুল্য। সেই ‘সন্তানতুল্য’ ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু তাঁকে চাইছেন না। বুধবার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে গণভোটের ফল প্রকাশের সঙ্গেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সিংহভাগই উপাচার্য পদে অভিজিৎ চক্রবর্তীকে মানতে পারছেন না। অভিজিৎবাবুর অবশ্য তাতে হেলদোল নেই।
গত ৩০ ও ৩১ অক্টোবর কলা বিভাগের ৯৭% ছাত্রছাত্রী অভিজিৎবাবুর পদত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এই মঙ্গলবার এবং বুধবার ভোটাভুটি করেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রছাত্রীরা। এ দিন তার ফল ঘোষণা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও ৯৭% পড়ুয়ার মত হল, অভিজিৎবাবু উপাচার্য থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। দুয়ে মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাগুরু পড়ুয়াদের মতই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
কলা বিভাগের ২৯৭০ জন পড়ুয়ার মধ্যে ভোটার ছিলেন ২৬০২ জন। তার মধ্যে ২৪৯৭ জন উপাচার্যের পদত্যাগ চান। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মোট ৫০৮১ পড়ুয়ার মধ্যে ৪৫৩৩ জন ভোটে অংশ নিয়েছেন। ৪৩৯৭ জন পদত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কারণে সেখানে ভোটাভুটি স্থগিত আছে। ওই বিভাগে কমবেশি ১৩০০ ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, কমবেশি মোট ৯৩০০ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এখনই সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬৮৮৯ জনের মত গিয়েছে অভিজিৎবাবুর বিরুদ্ধে। আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের দাবি, বিজ্ঞান বিভাগেও কমবেশি ১৩০০ ছাত্রছাত্রীর শতকরা ৯৫ ভাগেরই সমর্থন তাঁদের দিকে।
অর্থাৎ কলরবের স্বর ব্যালট বাক্সেও এতটুকু দুর্বল হয়নি। বিপুল সংখ্যায় ভোট দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, আইনি বৈধতা না থাকলেও এই গণভোট তাঁদের অসন্তোষের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর যৌন নিগ্রহের ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত চেয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৬ অক্টোবর মাঝরাতে ঘেরাও আন্দোলন ভাঙতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ঢোকার পরে তা অন্য মাত্রা পায়। ২০ অক্টোবরের মহামিছিল, শিক্ষক-অধ্যাপক-বিশিষ্ট জনেদের পথে নামা, লাগাতার বিক্ষোভ-অবস্থান-পথসভা-গণকনভেনশন-মানবশৃঙ্খল-শ্বেতপত্র প্রকাশ অভিজিতের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছেই। তার মধ্যেই তিনি উপাচার্য পদে অস্থায়ী থেকে স্থায়ী হয়েছেন। ছাত্র-শিক্ষকদের বিরূপতা তাঁকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করেনি।
এ দিনও গণভোটের ফলকে গুরুত্ব দিতে চাননি অভিজিৎবাবু। এই ভোটের যে কোনও আইনি বৈধতা নেই, সেই যুক্তির পাশাপাশি এর নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “উপাচার্য, রেজিস্ট্রার বা পরীক্ষা নিয়ামক কে হবেন, সেটা ঠিক করা কি ছাত্রছাত্রীদের এক্তিয়ারভুক্ত? এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না।”
কলা শাখার ভোটের পরেই গণভোট প্রক্রিয়ার আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও। কিন্তু ভোটের আইনি বৈধতা আছে, এমন দাবি কেউই করছেন না। তবে শিক্ষাজগতের বড় অংশেরই মত হল ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক শুধু আইন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু বাতাবরণ বজায় রাখতে হলে ছাত্র, শিক্ষক এবং উপাচার্যের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা এবং সম্মানের সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। আইনের বলে উপাচার্য পদ আঁকড়ে থাকতে পারেন, কিন্তু পড়ুয়াদের ভালবাসা এবং সহকর্মীদের সহযোগিতা পাবেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদদের অনেকেই। যাদবপুরেরই প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু এ দিন বলেন, “এই ভোট প্রমাণ করল, বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই উপাচার্যকে চায় না। এই অবস্থায় কাজ চালানো কঠিন বলেই আমার মত।”
ছাত্রদেরও বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ২০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি করছেন বলে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, সেটা ভুল প্রমাণ করাই গণভোটের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার ছাত্রনেতা চিরঞ্জিত ঘোষ দাবি করছেন, সামনে পরীক্ষা না থাকলে আরও ভোট পড়ত।
ছাত্রী নিগ্রহ এবং তার পরবর্তী ঘটনার নিরিখে পাঁচটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের সামনে। (ক) উপাচার্যের পদত্যাগ চান কি না, (২) ছাত্রছাত্রীদের উপরে পুলিশি জুলুমের বিচারবিভাগীয় তদন্ত চান কি না, (৩) ছাত্রী নিগ্রহের অভিযোগের বিচারবিভাগীয় তদন্ত চান কি না, (৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অভিযোগগ্রহণ কেন্দ্রের পুনর্গঠন চান কি না, (৫) বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভিতরে পুলিশ পিকেট, সিসিটিভি চান কি না। প্রথম প্রশ্নের পক্ষে ভোট পড়েছে ৯৭%, দ্বিতীয় প্রশ্নের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৯৭.৩৯%, তৃতীয় প্রশ্নের পক্ষে ৯৭%, চতুর্থ ও পঞ্চম প্রশ্নের পক্ষে যথাক্রমে ৯৬.২৭% এবং ৮৬.১% ছাত্র ছাত্রী ভোট দিয়েছেন। এ দিন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ফল ঘোষণা
হওয়ার পরে ছাত্রছাত্রীরা ফের অভিজিৎবাবুর পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দিতে শুরু করেন।
১৬ই অক্টোবর রাতে পুলিশ ডাকার পিছনে অভিজিৎবাবুর যুক্তি ছিল, ঘেরাও হয়ে থাকার সময় তিনি প্রাণহানির আশঙ্কা করছিলেন। পরে অবশ্য শিক্ষক সংগঠন আবুটা-কে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানান, ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে ঘটনার ‘আকস্মিক অভিঘাতে’ তিনি বিপর্যস্ত বোধ করেছিলেন। তাঁর তৎকালীন প্রতিক্রিয়া সেই বিপর্যস্ত অবস্থারই প্রতিফলন। ছাত্রছাত্রীরা তাঁর ‘সন্তানতুল্য’ বলেও দাবি করেন তিনি। বুধবার গণভোটের ফল জানার পরেও অভিজিৎবাবু বলেন, “ছাত্রছাত্রীরা আমার সন্তানের মতো। তাদের আমি খুবই স্নেহ করি। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা থাকা উচিত।” তাঁর দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই ছাত্রছাত্রীদের এই আচরণ সমর্থন করছেন না।
কী বলছেন শিক্ষকরা? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন জুটা ইতিমধ্যেই অভিজিৎবাবুর বিরুদ্ধে তাঁর মত জানিয়েছেন। পথে নেমেছেন। সুকান্ত চৌধুরীর মতো প্রবীণ অধ্যাপকও বারবারই বলেছেন ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক-প্রাক্তনী, কোনও পক্ষেই বর্তমান উপাচার্যের প্রতি সমর্থন নেই। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন জুটা-র সভাপতি কেশব ভট্টাচার্য বলেন, “এটা প্রমাণিত হল যে, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশেরই অপছন্দের। এখন উপাচার্য কী করবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার।”
উপাচার্য জানিয়েছেন, “ইস্তফা দেওয়ার প্রশ্নই উঠছে না।” রাজ্য সরকার অবশ্য বরাবরই উপাচার্যের পাশে। বুধবারও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই ভোটাভুটির কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। ওখানে পরিদর্শক হিসেবে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সকলেই সরকার-বিরোধী বলে পরিচিত।” জবাবে পরিদর্শকদের অন্যতম, নাট্যকর্মী কৌশিক সেন বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের আমন্ত্রণে আমি একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করতে গিয়েছিলাম। আমার দায়িত্ব ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে কি না, দেখা। এখানে সরকার-বিরোধিতার প্রশ্ন উঠছে কেন?”