ছবি: সুমন বল্লভ
নিশিভোজে সাহেবিয়ানা মানেই পার্ক স্ট্রিট— সে গরিমা ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছিলই। ইতিউতি আরও রেস্তোরাঁ দরজা খুললেও তবু কলকাতার একমাত্র ‘ফুড স্ট্রিট’-এর পালক ঢের বেশি দিন গোঁজা ছিল মুকুটে। শহর যত বড় হল, পাল্লা দিয়ে বাড়ল ‘ইটিং আউট’। বাড়ল খানাপিনার ঠেক। যার হাত ধরে এখন প্রতিযোগিতার মুখে পার্ক স্ট্রিটও!
প্রথম চ্যালেঞ্জটা এসেছিল বেশ ক’বছর আগে, শরৎ বসু রোডের কাছ থেকে। প্রথমে একটা, তার পরে আরও গোটা তিনেক। বাড়তে বাড়তে গোটা রাস্তার দু’ধারে এখন রকমারি রেস্তোরাঁর রমরমা। চিনা হোক বা কন্টিনেন্টাল, নিপাট বাঙালি হোক বা ইতালীয় এমনকী জাপানি, লেবানিজ— যে স্বাদ চাইবেন, তেমনটিই হাজির। বছর গড়িয়েছে একের পর এক। একে একে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ছে ই এম বাইপাস, কসবা, রাজারহাট-নিউ টাউনও। আর শুধু ফুড স্ট্রিটই বা কেন, রেস্তোরাঁ-হাব হয়ে কলকাত্তাইয়া চিনেপাড়া ট্যাংরা বা ধর্মতলা-অফিসপাড়ার সঙ্গে টক্করে নেমেছে সেক্টর ফাইভ, সল্টলেক, কাঁকুড়গাছি, গোলপার্কও।
এক কালে ‘এক বেলার সাহেব’ হতে বাঙালি ছুটত পার্ক স্ট্রিট। তা সে টি থ্রি, ফ্লুরিজে চা-বৈঠক হোক বা মুলা রুঁজ-ওয়ালডর্ফ-ম্যাগনোলিয়ায় পিয়ানো-ভায়োলিনের সুরে ভেসে স্টেক-ককটেলের নিশিভোজ। বিশ্বায়নের হাত ধরে ভিনদেশি সুস্বাদের সঙ্গে পরিচয় যত বেড়েছে, খানিকটা হলেও কমে গিয়েছে ক্ষণিকের বিলিতিয়ানার গৌরব। চিনা-মোগলাই-দক্ষিণ ভারতীয় স্বাদ পেরিয়ে চল বেড়েছে রেস্তোরাঁয় কব্জি ডুবিয়ে বাঙালি ভোজেরও। শহুরে রসনায় বৈচিত্র আনতে এমনকী হাজির আদিবাসী হেঁশেলও। সেই সঙ্গেই রাস্তার সুখাদ্যে ভয়-পাওয়াদের ভরসা হয়ে খুলে গিয়েছে বেশ কিছু স্ট্রিট-ফুড রেস্তোরাঁ। এক ছাদের নীচে এক ঝাঁক রেস্তোরাঁ নিয়ে শহরের ভোজ-মানচিত্রে নাম লিখিয়েছে মলগুলোও।
আর এই স্বাদবদলের ঠিকানা হয়েই ময়দানে নেমে পড়েছে নতুন নতুন ভোজ-সরণি, রেস্তোরাঁ-পাড়াগুলো। শরৎ বসু রোডে যেমন চিনা রেস্তোরাঁ ম্যান্ডারিন, মাল্টি ক্যুইজিন কারি ক্লাব, পেপার চিনো, দক্ষিণী ট্যামারিন্ডের পরে একে একে পর্দা উঠেছে সিলভার ওক, দ্য ওয়াল, ফায়ার অ্যান্ড আইস, কাসা টসকানা, সাড়ে চুয়াত্তর থেকে হালফিলের শহর-কাঁপানো কর্নার কোর্টইয়ার্ড, রয়্যাল লেবানিজের। শরৎ বসু রোড হয়ে গিয়েছে ‘যেমন খুশি খাও’-এর অন্যতম ঠিকানা। রাজারহাট-নিউটাউনই বা কম কীসে? আর্টারিয়াল রোডের উপরে ওশন গ্রিল, আরসালান, আমিনিয়া, লাজিজ এক্সপ্রেস, পিপল ট্রি, কষে কষার পাশাপাশি সিটি সেন্টার ২, অ্যাক্সিস মলে-এর ব্লু নাইল কিংবা দ্য ওরিয়েন্ট, আফরা ডেলি, ইন ইয়াং, মেহেক-এ-পঞ্জাব, ৪৭ সাউথ ট্যাংরা রোড-এর মতো এক গুচ্ছ রেস্তোরাঁ। দু’ধারে রেস্তোরাঁ নিয়ে কলকাতার ফুড-স্ট্রিট হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে ই এম বাইপাস বা কসবাও। বাইপাসে সন্ঝা চুলহা, বাইপাস ধাবা, সিলভার আর্কেডে সিগ্রি, মেনল্যান্ড চায়না, অ্যাম্বারের মতোই লোক টানছে কসবার হার্ভিজ, নওশিজান, লাজিজ, রেড ব্যাম্বু শ্যুট বা অ্যাক্রোপলিস মলের হপ্পিপোলা।
গোটা মহল্লার রেস্তোরাঁ হাব হয়ে ওঠার দৌড়ে অবশ্য এগিয়ে সেক্টর ফাইভ। তথ্যপ্রযুক্তি তালুকের অফিসে ঘেরা থাকার সৌজন্যে ভিড়ে ঠাসা থাকে মাল্টিক্যুইজিন বিবি’জ, ব্যাকস্টেজ, বিস্ত্রো ওয়াই, রেড হট চিলি পেপার, বার্বিকিউ নেশন, জয়সলমির, কন্টিনেন্টাল প্যারিস কাফে, ওড়িয়া হেঁশেলের ডালমা, দক্ষিণী বনানা লিফ, কোরামণ্ডল এক্সপ্রেস, মিশন কাফে, রং দে বসন্তী ধাবা, পিন্ড পঞ্জাবি ধাবা, জব্বর আফগানি, ভজহরি মান্নার মতো রকমারি স্বাদের রেস্তোরাঁ। আদিবাসী হেঁশেল সান্তা’জ ফ্যান্টাসি-র সঙ্গেই গোলপার্কে জাইকা, গ্রাব ক্লাব, স্পাইসেস অ্যান্ড সসেস, সরসোঁ, সল্টলেকের সিক্স বালিগঞ্জ প্লেস, অউধ, কাঁকুড়গাছি দ্য রোজ, হানি দা ধাবা, দিল্লি দরবার, হং কং বা গো গ্রিন-ও সপ্তাহান্তের ভিড়ে জমজমাট।
শহর কলকাতার বহু সাবেক রেস্তোরাঁয় অবশ্য বিসর্জনের বাদ্যি। পরের প্রজন্ম মুখ ফেরানো-সহ নানা সমস্যায় ইতিমধ্যেই ঝাঁপ ফেলেছে ধাবা, পিপিং, টি-থ্রি-র মতো বেশ কিছু পুরনো রেস্তোরাঁ। তাদেরই জায়গা নিচ্ছে রোজ কলকাতার এখান-ওখানে নিত্যনতুন ভোজ-সরণি।
তবে কি পার্ক স্ট্রিটের ‘সে দিন গিয়েছে’? কী বলছে কলকাতা?