সুরের মায়ায় শহরকে জড়ালেন ইরানের শিল্পী

এক মুখ দাড়ি-গোঁফ। ৩২ বছরের সুফি শিল্পী হেসে বলছেন, ‘‘আমি তো নিজের ইচ্ছায় বাজাই। সেই বাজনা শুনে কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে গ্রহণ করি। আমার বাজনা কেনা যায় না।’’

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:৫৭
Share:

মূর্ছনা: শহরে দামুন ইয়াঘোবি। নিজস্ব চিত্র

বেহালার সুরে শহরের রাজপথ ভাসিয়ে কলকাতা ছাড়লেন দামুন ইয়াঘোবি। বলে গেলেন, ‘‘আবার আসব। বড় ভাল লেগেছে আপনাদের শহরটাকে।’’

Advertisement

মাত্র ১৫ বছর বয়সে বেহালা আর দোতার নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন। প্রথমে নিজের দেশ ইরানেরই অন্য শহর, পরে অন্য দেশ ঘুরে কলকাতার অতিথি হয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি গোলপার্কে লেকের ভিতরে নিরিবিলিতে বেহালার ছড় টানতেই ভিড় জমিয়েছিলেন আশপাশের মানুষ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দামুনের সুরে ভেসে গিয়ে এক তরুণী তাঁর হাত ধরে বলেছিলেন, ‘‘আমার স্বামীর জন্মদিনের পার্টিতে আপনি এসে বাজান। যত টাকা লাগে দেব।’’

এক মুখ দাড়ি-গোঁফ। ৩২ বছরের সুফি শিল্পী হেসে বলছেন, ‘‘আমি তো নিজের ইচ্ছায় বাজাই। সেই বাজনা শুনে কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে গ্রহণ করি। আমার বাজনা কেনা যায় না।’’ স্রেফ ভালবেসে সুর বাঁধেন তিনি। গত তিন সপ্তাহ ধরে কখনও গোলপার্কে, কখনও পার্ক স্ট্রিটে, কখনও রাসবিহারীতে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে শহরবাসীকে শোনাতে চেয়েছিলেন সেই সুর। বাদ সেধেছে শহরের শব্দ-তাণ্ডব। গাড়ির হর্নের কর্কশ স্বর বিঘ্নিত করেছে তাঁর মনঃসংযোগ। খেই হারিয়ে গিয়েছে সুরের। দামুন বলেন, ‘‘বিদেশের বিভিন্ন শহরে রাস্তার পাশে কেউ বেহালা, কেউ গিটার নিয়ে গান শোনান। সেখানে এত হর্নের আওয়াজ থাকে না।’’

Advertisement

আরও একটা নেশা রয়েছে দামুনের। ছবি আঁকা। এই শহরের রাস্তার পাশের কিছু দেওয়াল তিনি তাঁর রঙের জাদুতে ভরিয়ে দিতে চান। ঠিক যেমন ভরিয়ে দিয়েছেন ভুবনবাড়ির সিঁড়ি, ছাদের পাঁচিল। হেদুয়ার কাছে এই ভুবনবাড়িকে পুরনো আসবাবে সাজাচ্ছেন সেটির মালিক গৌরব পাণ্ডে। সেই ভুবনবাড়ির উদ্বোধনে অন্য রকম কিছু চেয়েছিলেন তিনি। তখনই গৌরব খোঁজ পান দামুনের। তিনি যখন বাজাবেন, তঁর সামনে কেউ মদ্যপান করতে পারবেন না, এই শর্তে দামুন রাজি হয়ে যান। তবে থেকে দামুনের ঠিকানা ছিল ওই ভুবনবাড়ি।

তারই ছাদে বসে এক দিন বেহালায় ছড় টানলেন টকটকে ফরসা, প্রায় ছ’ফুট উচ্চতার ইরানি যুবক। বাবা মোস্তাফাও ছিলেন শিল্পী মানুষ। কাস্পিয়ান সাগরের পাড়ে, উত্তর ইরানের লাহিজানে তাঁদের বাড়ি। কাকার সাইকেল সারাইয়ের দোকানে কাজ করে, টাকা রোজগার করে মাত্র ১০ বছর বয়সে প্রথম বেহালা কিনেছিলেন দামুন। এখন সঙ্গে অনেকটা ভারতীয় সরোদের আদলে তৈরি দোতার নিয়ে ঘোরেন। সেই দোতারের তারে মরুভূমির সুর। ১৫ বছর বয়সে বাবাই বলেছিলেন, সঙ্গীত ও আঁকা শিখতে হলে বেরিয়ে পড়তে হবে। মা এবং দুই ভাই-বোনকে ছেড়ে প্রথমে বাবারই হাত ধরে তেহরান। পরে একা আর্মেনিয়া।

ইতালি যেতে চেয়েছিলেন দামুন। ভিসা পাননি। তুরস্ক, জর্জিয়া, নেপাল-সহ আরও বহু দেশ ঘুরে এক বছরের ভিসা পেয়ে ভারতে এসেছেন। যে দেশেই গিয়েছেন, সেখানে রাস্তায় চোখ বুজে ডুবে গিয়েছেন বেহালা ও দোতারের সুরে। সুরের মূর্ছনায় মন্ত্রমুগ্ধ ভিড় তুলে দিয়েছে দান। তাই দিয়েই চলেছে দিন যাপন। মাঝেমধ্যে ফিরেছেন ইরানে। কয়েক মাস থেকে ফের বেরিয়ে পড়েছেন। দিল্লি, ধর্মশালায় নিজের কনসার্টও করেছেন।

সেই কনসার্ট নিয়েই কলকাতায় ফিরতে চান দামুন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement