উদ্যাপন: ভাষা দিবসের প্রাক্কালে সাফসুতরো করা হচ্ছে ময়দান চত্বরের ভাষা শহিদ স্মারক। নিজস্ব চিত্র
‘‘বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়তাম। তাই বাংলা না পড়ে আমার উপায় ছিল না। কিন্তু এখনকার পড়ুয়ারা যদি বলে বাংলার পিছনে সময় কেন দেব, সে কি খুব ভুল বলবে? যদি জানিই যে এই ভাষাটার কোনও বাণিজ্যিক মূল্য নেই, তা হলে সেটার জন্য শ্রম বা সময় কেন কেউ নষ্ট করবে?’’ কথাগুলো বলছিলেন এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র অনুপম ঘোষ।
অনুপম আরও জানাচ্ছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি তো বটেই উচ্চশিক্ষার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ শাখাতেই কোনও বাংলা বই নেই। তাই মেধা থাকা সত্ত্বেও বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়াকে এই ভীতির মধ্যে বড় হতে হয়, উচ্চশিক্ষা নিতে গেলে হঠাৎ করে ইংরেজি ভাষায় সব মানিয়ে নেওয়া যাবে তো? অনুপমের কথায়, ‘‘সেই ভীতি থেকে যদি অভিভাবকেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলকে বেছে নেন, তা হলে তাঁদেরও কি দোষ দেওয়া যায়?’’
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষার উদ্যাপনের মধ্যে অনুপমের মতোই আরও অনেকের মনে ওঠা প্রশ্নটা যে অস্বীকার করার উপায় নেই, তা গত বছরের দু’টি ঘটনার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। প্রথমটি ঘটেছিল গত অগস্টে। যখন উত্তরপাড়া ও হিন্দমোটর স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় পদার্থবিদ্যার এক ছাত্রের দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। জানা গিয়েছিল, ইংরেজিতে সাবলীল না হওয়া এবং শহুরে সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারাই ছিল তাঁর আত্মহত্যার কারণ। সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল গত নভেম্বরে, যখন সরকারি হাসপাতালের নার্সিংয়ের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছিলেন। পরিবারের তরফে জানানো হয়েছিল, ঠিক মতো ইংরেজি বুঝতে না পারার অবসাদ ও ভীতিই ছিল মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
ফলে দু’টি ঘটনাই এই অপ্রিয় ও কঠিন সত্যকে সামনে এনেছিল যে, বাংলা মাতৃভাষা ঠিকই। কিন্তু চাকরির দরখাস্ত থেকে শুরু করে বায়োডেটা, অফিসের সাধারণ কোনও চিঠি— যেখানে সব কাজই ইংরেজিতে করা হয়, ব্যবহারিক জীবনে সেখানে বাংলা ভাষা কোন কাজে আসবে?
ইংরেজিতে বায়োডেটা জমা নেওয়া প্রসঙ্গে মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশ জানাচ্ছেন, শুধু বাংলা নয়, কোনও প্রাদেশিক ভাষাতেই বায়োডেটা জমা নেওয়া হয় না। এর পিছনে যে ওই ভাষাকে তাচ্ছিল্য করা বা গুরুত্ব না দেওয়ার মানসিকতা রয়েছে, এমনটা নয়। কিন্তু ভারতের মতো বহু ভাষার দেশে যদি প্রত্যেক জায়গা থেকেই চাকরিপ্রার্থীরা নিজেদের মাতৃভাষায় বায়োডেটা পাঠাতে থাকেন, তা হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তা সমস্যার কারণ হয়ে উঠবে। কারণ, সেই সব বায়োডেটা পড়ার জন্য বিভিন্ন ভাষা জানা কর্মী রাখতে হবে প্রতিষ্ঠানকে, যেটা আদৌ বাস্তবসম্মত নয়। মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ বীর্যেন্দু গুপ্তের কথায়, ‘‘সেই কারণে সর্বজনগ্রাহ্য ইংরেজি ভাষাতেই বায়োডেটা জমা নেওয়া হয়।’’
তিন বছর আগে গুগ্ল এবং আরও একটি বেসরকারি সংস্থা যৌথ ভাবে ভারতীয় ভাষা ও ইন্টারনেটের উপরে তার প্রভাব সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা করেছিল। সেখানে দেখা যায়, কী ভাবে বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় নেট-ব্যবহার ক্রমেই বেড়েছে। ২০১১ সালে দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ছিল। সেখানে ইন্টারনেটে ইংরেজি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৬.৮ কোটি ও প্রাদেশিকভাষীর সংখ্যা ছিল ৪.২ কোটি। কিন্তু ২০১৬ সালেই এই তথ্যে উলটপুরাণ হয়। দেশে মোট ৪০.৯ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে প্রাদেশিক ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ২৩.৪ কোটি এবং ইংরেজি ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৭.৫ কোটি। ২০২১ সালে ওই সংখ্যার আরও পরিবর্তন হতে পারে বলে পূর্বাভাস ছিল রিপোর্টে। কারণ, আগামী বছর দেশে নেট ব্যবহারকারীর সম্ভাব্য সংখ্যা ধরা হয়েছে ৭৩.৫ কোটি। যার মধ্যে ইংরেজিভাষীর সংখ্যা মাত্র ১৯.৯ কোটি ও প্রাদেশিকভাষীর সম্ভাব্য সংখ্যা ৫৩.৬ কোটি হবে বলে জানানো হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞ কল্পদীপ বসু বলেন, ‘‘প্রযুক্তিগত দিক থেকে প্রাদেশিক ভাষা যে নেটে ব্যবহার করা সম্ভব, তা গুগ্ল ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে। ফলে বাংলা ভাষা দিয়ে গুগ্ল-এ সার্চ করতে চাইলে কেউ তা করতেই পারেন। কিন্তু সিংহভাগই তো সেটা করেন না।’’ সেই একই প্রশ্ন রয়েছে বাংলায় তৈরি ওয়েব সিরিজ, সিনেমা-সহ নানা বিনোদন ক্ষেত্রের দর্শক সংখ্যা নিয়েও। দর্শকদের একটি অংশের অভিযোগ, বাংলায় স্বল্প বা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের অনেক ছবিতেই কিছু অশ্লীল শব্দ ও যৌন দৃশ্য ব্যবহার করে ‘ওপরচালাকি’ করা হচ্ছে, যা শিক্ষিত দর্শকেরা সহজেই ধরে ফেলছেন। তরুণ চিত্র পরিচালক পাভেল অবশ্য বলছেন, ‘‘ওপরচালাকি শব্দটা ঠিক নয়। শব্দ বা দৃশ্য গল্পের প্রয়োজনেই ব্যবহার হচ্ছে। বিষয় ভাল হলে এগুলো নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দর্শক ছবিটা দেখবেনই।’’
কিন্তু দেখছেন কি? যেখানে নেট-মাধ্যমে ইংরেজি, হিন্দি ভাষায় তৈরি ওয়েব সিরিজ বা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের দর্শক ক্রমাগত বাড়ছে, সেখানে বাংলার ক্ষেত্রেও একই ভাবে বাড়ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
কারণ, তিন বছর আগের রিপোর্ট আরও বলছে, আগামী বছরে হিন্দিভাষী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ইংরেজিভাষীর সংখ্যার থেকে বেশি হবে। ৫৪ শতাংশ বাড়বে সেই সংখ্যা। প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে ৭৪ শতাংশ বাড়বে তামিল ও কন্নড় ভাষা, যা সব থেকে বেশি। তেলুগু ভাষার সম্ভাব্য বৃদ্ধির হার ৬০ শতাংশ। শেষ জনগণনায় শুধুমাত্র সংখ্যার নিরিখে হিন্দির পরেই সব থেকে বেশি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, অথচ তার বৃদ্ধির হার হবে মাত্র ৪৬ শতাংশ।
ফলে সংশয় থাকছেই! এই সংশয় কাটাতে চাইলে বোধহয় বাংলা ভাষার জন্য আরও অনেক বেশি কাজ করা দরকার, কেবল একুশের দিনটিতেই নয়, রোজ।