যাঁদের হাতে সেই ক্যান্টিন। — নিজস্ব চিত্র।
গাছের নীচে বাঁধানো বসার জায়গা। চারপাশে ছোট ছোট বেতের মোড়া। মাঝেমধ্যে এসে বসছেন রোগীর পরিজন, হাসপাতালের ডাক্তার, অন্য কর্মীরা। কয়েক জন
মহিলা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছেন। অতিথিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ঠান্ডা জলের গ্লাস। হাসিমুখে চাহিদা অনুযায়ী দিচ্ছেন চা-কফি, কেক-বিস্কুট, টোস্ট-অমলেট। পোশাকি নাম ‘চা-ঘর’। ঠিকানা: পাভলভ মানসিক হাসপাতাল।
হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভিতরে যাঁদের বছরে ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা কাটে, ওয়ার্ডের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে তাঁরাই শুরু করেছেন এই ক্যান্টিন। স্বাস্থ্য দফতর ও এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে যা ইতিমধ্যেই ‘ট্রায়াল রান’ শুরু করেছে। সেরে উঠেও যে সব রোগীর ঘরে ফেরা হয় না বা যাঁরা প্রায় সেরে ওঠার পথে, তাঁদেরই আনা হচ্ছে এই ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্বে।
যে পাভলভে রোগিণীদের নগ্ন করে রাখা হতো, সার দিয়ে দাঁড় করিয়ে হোসপাইপের জলে স্নান করানো হতো, মাস কয়েক আগেও যেখানে ‘সলিটারি সেল’-এর অস্তিত্ব নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল, সেখানেই এমন ‘অন্য ছবি’ কী ভাবে? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, ধাপে ধাপে মানসিক হাসপাতালের হাল বদলানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাঁদের দিয়ে ক্যাফেটেরিয়া চালানো তারই একটা ধাপ। পরের ধাপে প্রত্যেক রোগিণীর জন্য ওয়ার্ডে পৃথক লকারের ব্যবস্থা হচ্ছে, যেখানে তাঁরা নিজেদের জিনিসপত্র রাখতে পারবেন।
পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদের কথায়, ‘‘গোটা বিশ্বেই মানসিক রোগ নিয়ে ধারণা ক্রমশ বদলাচ্ছে। আমাদেরও তাল মিলিয়ে এগোতে হবে। সমাজ থেকে ওঁরা যে বিচ্ছিন্ন নন, সেই বোধটা জাগিয়ে তোলা খুবই জরুরি।’’ কিন্তু ওয়ার্ডের বাইরে ওই মহিলাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা কী হবে? সুপার বলেন, ‘‘আমাদের তরফে নজরদারির ব্যবস্থা থাকছে। এ ছাড়া, আমি ওঁদের সকলের সঙ্গেই আলাদা ভাবে কথা বলেছি। ওঁরা কেউ পালানোর চেষ্টা করবেন না। কারণ ওঁরা জানেন, যাওয়ার কোনও জায়গা নেই।’’
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে শুক্লা দাস বড়ুয়া এবং অদিতি বসু জানান, ক্যাফেটেরিয়ায় মহিলা ওয়ার্ডের বেশ কিছু আবাসিক কাজ শুরু করেছেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত ক্যাফে খোলা থাকবে। এক এক জন আবাসিক দু’ঘণ্টা করে কাজ করবেন। বাইরে থেকে এক জন ম্যানেজারকে নিয়োগ করা হয়েছে। তিনিই রান্না-সহ সব দেখভাল করবেন। অর্ডার নেওয়া এবং পরিবেশনের দায়িত্ব আবাসিকদের। হিসেব রাখাও অনেকটা ওঁরাই করবেন।
মানসিক হাসপাতালের রোগীরা অনেকেই সুস্থ হয়েও আর বাড়ি ফিরতে পারেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার ফিরিয়ে নেয় না। এই পরিস্থিতিতে সেরে ওঠা মানুষদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘চিরাচরিত পুনর্বাসনের ধারণা থেকে সরে এসে ওঁদের সমাজে ফের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছি। যাঁরা এখানে কাজ করে উপার্জন করবেন, তাঁদের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। হাসপাতালের সুপার নিজে উদ্যোগী হয়ে সেই ব্যবস্থা করবেন। এটাও তো নিজের পরিচিতিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। আমরা সেটার উপরেই জোর দিচ্ছি।’’
জ্যোৎস্না কর্মকার, বুলা সেনগুপ্ত, সাহানা খাতুনরা জানালেন, ওয়ার্ডের চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। মুক্ত পৃথিবীর স্বাদ কেমন, ধারণাটাই চলে যাচ্ছিল। এই কাজ তাঁদের নতুন করে বাঁচার দিশা দিল।
কিন্তু ক্যাফে বন্ধ হলে ওঁদের ফের ফিরতে হচ্ছে সেই চার দেওয়ালের বদ্ধ জীবনেই। সুস্থ হয়েও ফের মানসিক রোগীদের সঙ্গেই দিন গুজরান। সুস্থ হয়ে ওঠাদের থাকার জন্য কি কোনও ব্যবস্থা করতে পারে না স্বাস্থ্য দফতর? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, এ নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছে। তবে সেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।