বোমায় আহত দীপু দাস। রবিবার, শিয়ালদহে। নিজস্ব চিত্র।
ভোটের দিন বাইরে বেরোনোর মাসুল যে এ ভাবে দিতে হবে, তা ভাবিনি। ভোট দিতে গিয়ে নয়, পান খেতে বেরিয়ে বোমায় আমার পায়ের পাতার খানিকটা অংশই উড়ে গিয়েছে। হাঁটুতেও চোট লেগেছে। এখন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছি। চিকিৎসকেরা বলছেন, পচন ধরলে পা কেটে বাদও দিতে হতে পারে। কবে হাসপাতাল থেকে ছুটি পাব, তা-ও জানি না। অন্যের গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাই। পা-টাই না থাকলে গাড়ি চালাব কী করে? আমার এই ক্ষতির ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
আমার বাড়ি এ জে সি বসু রোডে কাশিমবাজার রাজবাড়ির কাছে। বাড়িতে মা, কাকা ছাড়াও স্ত্রী এবং দু’টো ছোট ছোট মেয়ে রয়েছে। পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব আমার উপরেই। গত কয়েক বছর ধরে অ্যাপ-ক্যাব চালাচ্ছি। আজ প্রথমে ভেবেছিলাম, গাড়ি নিয়ে বেরোব না। কিন্তু ভোটে রাস্তায় তেমন গাড়ি মিলবে না, এই সুযোগে কিছু বাড়তি আয় হতে পারে ভেবে শেষে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দুপুরে বাড়িতে খাওয়া সেরে আরও কিছু ক্ষণ ঘুরে এসে সন্ধ্যায় আর বেরোব না ঠিকও করে রেখেছিলাম। মেয়েরাও বায়না করছিল, ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ওদের দেওয়া কথা যে এ দিন আর পূরণ হবে না, তা ভাবিনি।
আমাদের বাড়ির পাশেই টাকি বয়েজ় স্কুলে ভোটের বুথ। দুপুরে বাড়িতে খেয়ে এ জে সি বসু রোডে ওই স্কুলের উল্টো দিকে একটা পানের দোকানে গিয়েছিলাম। পান কিনে খেতে খেতে রাস্তা পার হয়ে আবার ক্যাব নিয়ে বেরোনোর কথা ছিল। হঠাৎ শুনি জোর আওয়াজ। কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। দেখি, মোটরবাইক নিয়ে কয়েক জন পালাচ্ছে। ওদের পিছনে ছুটছেন আরও কয়েক জন। এর পরে বুঝলাম, আমার পা আর চলছে না। মাটিতে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। ছুটে এসে এক ব্যক্তি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ওই অবস্থাতেই দেখি, আমার বাঁ পায়ের পাতার খানিকটা আর নেই। সেখান থেকে মাংস খুলে ঝুলছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আশপাশটা। গোড়ালির কাছেও দেখলাম ক্ষত তৈরি হয়েছে। ওই চিৎকারের মধ্যে আমার আর দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা ছিল না। লোকজন একটা ট্যাক্সি ডেকে আমাকে ধরে তুলে দিলেন। ট্যাক্সিতে উঠে বুঝলাম, পায়ের কোনও অংশই আর নাড়াতে পারছি না। ক্রমশ অসাড় হয়ে আসছে শরীর। আমার সঙ্গে ট্যাক্সিতে এক জন উঠেছিলেন। তিনিই এনআরএসে নিয়ে গেলেন।
হাসপাতালে এর পরে কিছু ক্ষণ ফেলে রাখা হল। সঙ্গে আসা ব্যক্তিকে ফোন নম্বর দিয়ে কাকাকে খবর দিতে বললাম। কিন্তু স্ত্রীকে যেন এখনই কিছু বলা না হয়, সেটাও জানালাম। এর পরে চিকিৎসক বললেন, চার জায়গায় আঘাত লেগেছে। গোড়ালির অবস্থা বেশি খারাপ। বোমার কেমিক্যাল লেগে পায়ে পচন ধরতে পারে। অন্তত দু’দিন না কাটলে কিছুই বলা সম্ভব নয়। পরে কাকার কাছে শুনেছি, বুথ লক্ষ্য করে বোমা ছোড়া হয়েছিল। আমি ওই সময়েই বুথের সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি ছাড়াও আরও দু’জন আহত হয়েছেন।
কিন্তু এই সন্ত্রাস কিসের জন্য? এত পুলিশ থাকা সত্ত্বেও এই বোমাবাজি রোখা গেল না কেন?
বিকেলে স্ত্রীকে বোমার খবর জানানো হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে ও শুধু জানতে চাইছে, তোমার পা ঠিক হয়ে যাবে তো? গাড়ি চালাতে পারবে তো? ওকে বুঝিয়েছি, বেঁচে আছি, এটাই বড় কথা।