আমরা করব জয়।বিকেলে ম্যাচ শুরুর আগে ইডেনমুখী দর্শকদের উল্লাস।
এমন শনিবার শেষ কবে দেখেছে কলকাতা?
সপ্তাহান্তের ফুরফুরে সন্ধ্যায় পার্ক সার্কাস থেকে ধর্মতলার পথে খানিক স্খলিত মেজাজে অসহিষ্ণু হর্ন নেই কোনও চালকের। কার্যত জনহীন রাজপথে জ্যাম-জটে ঠোক্কর খাওয়ার বালাই নেই এক বারও। আর সুনসান পার্ক স্ট্রিট উড়ালপুলে উঠে কল্লোলিনীর প্রেমে আচ্ছন্ন হওয়া ছাড়া প্রায় কোনও পথই থাকে না।
আলোর মালায় সাজানো উড়ালপুল থেকেই চোখে পড়ে ইডেনের ফ্লাডলাইটের হীরকদ্যুতি। এক ধরনের অপার্থিব জ্যোৎস্না, যা এই সন্ধ্যায় শহরের ক্রিকেট-জ্বরের স্মারক হয়ে থাকবে।
তবে তুলতুলে স্টেক ও রকমারি সসেজের জন্য বিখ্যাত পার্ক স্ট্রিটের সাবেক পানশালার কর্মী শেখ তনভিরুল হক এ সব রোম্যান্টিকতার পরোয়া করলেন কই? রেস্তোরাঁর ম্লান কার্পেটে ঢাকা সিঁড়িটার নীচে সারা ক্ষণ উসখুস করছেন বাগনানের যুবক। অন্য শনিবার এই সিঁড়িটা টেবিল পেতে অপেক্ষমান তৃষ্ণার্তদের জটলায় গিজগিজ করে। এই সন্ধ্যায় তার থেকে ঢের কম ভিড়। তনভিরুল তবু বারবার নিজের চেয়ার চেড়ে উঠে পাশের রেস্তোরাঁয় কাচের দেওয়ালে চোখ রাখছেন। ‘‘আমাদের এখানে তো টিভি নেই, তাই একটু উঁকিঝুঁকি মারছি, খেলা দেখছি...এই আর কী!’’— লাজুক হেসে বললেন বিরাট কোহলির গোঁড়া ভক্তটি।
পার্ক স্ট্রিটে চেলো কাবাবের বিখ্যাত ঠেক বা সাহেবি আমলের অভিজাত টি-রুমের এই চেহারা কদাচ দেখা যায়। সাধারণত সোমবার দুপুরেও এ সব ঠেকে হুট করে ঠাঁই পাওয়া সহজ হয় না। এ দিন দেখা গেল, চায়ের আড্ডাঘরটির অর্ধেকের বেশি টেবিল ফাঁকা। কোনও রেস্তোরাঁর বাইরেই রাত আটটাতেও টেবিল পেতে বিশাল লাইন বা জটলা নেই।
নামী চিনে রেস্তোরাঁর কর্ণধার রাজীব কোঠারি বলছিলেন, ‘‘আমরা কিন্তু রেস্তোরাঁয় টিভি রাখার পক্ষপাতী নই। না-হয় এক দিন একটু কম লোকই হল।’’ বেঙ্গালুরু থেকে আসা বন্ধু দীপ্তেন্দ্র সিংহের সঙ্গে ‘জিটিজি’ (গেট টুগেদার) উপলক্ষে কলকাতার পুরনো বন্ধু অভিষেক মল্লিক, সুদীপ্ত মান্নারা কিন্তু পানভোজনের জন্য বেছে বেছে এমন একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকলেন, যেখানে বড় স্ক্রিনে টিভি-তে খেলা দেখানো হচ্ছে। তবে ইডেনে টি-টোয়েন্টির জগঝম্প শোনার জো নেই কলকাতার সাবেক ফুড স্ট্রিটে। এ তল্লাটে প্রতি ওভারের তালে-তালে স্যাক্সোফোন ও পিয়ানোর কম্বিনেশনই কলকাতার মোচ্ছবের আমেজ রচনা করে দিল।
অথচ, সন্ধে অবধি খেলা আদৌ হবে কি না, তা নিয়েই দেখা দিয়েছিল সংশয়। গিরিশ পার্ক থানার পাশে ‘ইউনিয়ন স্পোর্টিং’ ক্লাবের চিলতে ঘরটায় মুখ ব্যাজার করে বসে সুব্রত-প্রসেনজিৎ-সঞ্জীবরা। তখনও এক টানা ঝিরঝির হয়েই চলেছে। টিভি-তে সযত্নে ঢাকা-চাপা আউট ফিল্ডটার দিকে তাকিয়ে কারও মুখেই কথা সরছে না। সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী মাঠে আসার খবর কোনও চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে দেখে এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সুব্রত বলল, তা হলে বোধহয় হবে ম্যাচটা!
ভারত তখন জয়ের মুখে। পার্ক সার্কাস এলাকার এক শপিং মলের রেস্তোরাঁয় সন্ধেবেলা ম্যাচে মজে জনতা।
এর দু’ঘণ্টা বাদেই বেকবাগান রো-এ ফুটপাথে বসানো টিভি-র সামনে পাল্লা দিয়ে নাচলেন মহম্মদ সাহিল ও সঞ্জয় সিংহ।
বালিগঞ্জের বুটিকের কর্মী দুই বন্ধু ও-পাড়ায় একসঙ্গে থাকেন। স্থানীয় এক নেতার দাক্ষিণ্যে বসানো টিভি-র সামনে বুঁদ হয়ে রাতে কী খাবেন, ভুলেই গিয়েছেন তাঁরা।
সামান্য দূরে বেকবাগানের ঝকঝকে শপিং মলের ভিতরের বিহারকারীদের অবশ্য রাতের মেনু নিয়ে দুশ্চিন্তার দরকার নেই। এমনিতে মলটা সন্ধে থেকেই মাছি তাড়াচ্ছে। মাল্টিপ্লেক্সের কর্মীরা বললেন, ভারত-পাক ক্রিকেট যুদ্ধের সন্ধ্যায় সিনেমায় কারও মন নেই। কিন্তু পাঁচতলার জমজমাট পাবে, সন্ধে থেকেই নরক গুলজার। ইডেনের ক্রিকেট-উৎসব উপলক্ষে রাত একটা অবধি পানীয় পরিবেশনের অনুমতি পেয়েছেন বলে দাবি করলেন পাব কর্তৃপক্ষ। ম্যানেজার জনৈক মহিলা বললেন, তা ১৫০-২০০ লোক তো ভিড় করেছেই।
ফেসবুক সাক্ষী, পাটুলিতে ১১০ নম্বর ওয়ার্ডে শাসক দলের কাউন্সিলরও পার্টি অফিসের বাইরে জায়ান্ট স্ক্রিন টাঙিয়ে ক্রিকেট-ভোজে আমজনতাকে সাদরে নেমন্তন্ন করেছেন। সন্ধ্যায় ম্যাচ শুরুর সময়ে কোনও কোনও ক্রিকেটপ্রেমী ভারত ও পাকিস্তান, দু’দলকেই বাহবা দেওয়ার আহ্বান দিয়েছিলেন। ম্যাচ জমে উঠতে শহরের মদির পাবে মালুম হল, উল্লাসের বহরে কে বিরাট কোহলি, মহম্মদ আমির বা অমিতাভ বচ্চন, তা যেন গুলিয়ে ফেলেছে আমুদে জনতা। লং আইল্যান্ড আইসড টি বা মোয়িতোর পুনরাবৃত্তি মেঠো উল্লাসকে নাগাড়ে সঙ্গত করে গেল।
ভারতের ব্যাটিংপর্বে সামি-আমিরদের পেস শহরের রাতের পার্টি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছিল। কোহলি-যুবিদের মস্তানিতে সব উৎকণ্ঠার অবসান। বিকেলে অকাল বর্ষায় ধস্ত শহরে রাতে আলোয় আলোয় ‘বসন্তের দীপাবলি’। মুহুর্মুহু ফাটল বাজিপটকা। উদ্দাম উল্লাস পেরিয়ে প্রায় রবিবার ব্রাহ্ম মুহূর্তে ঘুমোতে গেল কলকাতা।
ছবি:সুমন বল্লভ ও শুভাশিস ভট্টাচার্য।