ফাইল চিত্র।
ক্ষমতায় এলে সরকারি বাসে মহিলাদের বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের সুবিধা। নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহারে এমনই ঘোষণা করেছে বিজেপি। কিন্তু অনেকেরই বক্তব্য, যে কোনও ধরনের সংরক্ষণ বা বিনা ভাড়ার সুবিধার মূলে এই ধারণাই রয়েছে যে, ওই শ্রেণি বা গোষ্ঠী ‘দুর্বল’। অথচ যেখানে নারী ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে সব অর্থনৈতিক স্তরের মহিলাদের বাসে যাতায়াত ‘ফ্রি’ করে কি সেই উদ্দেশ্য পূরণ হবে? বিশেষ করে এখনও যেখানে মহিলাদের পোশাক, আচরণ নিয়ে নীতি-পুলিশের দাপাদাপি অব্যাহত?
বিজেপি-র এই ঘোষণার আগেই অবশ্য দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরীবালের প্রশাসন সরকারি বাসে মহিলাদের নিখরচায় যাতায়াত চালু করেছিল। যার সপক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, নিম্ন বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক পড়ুয়া, কর্মরতা মহিলাদের আর্থিক সাশ্রয়ের কথা ভেবেই এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। উত্তর দিল্লি পুরসভার কাউন্সিলর তথা ‘ওয়ার্কস কমিটি’-র চেয়ারপার্সন অর্চনা দিলীপ সিংহ বলছেন, ‘‘মহিলাদের জন্য বাসে যাতায়াত ফ্রি করে কী হবে? বরং মহিলাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তার দিকে নজর দেওয়া হোক।’’
বিজেপি-র ঘোষণা নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা শমিতা সেন বলছেন, ‘‘এতে সমাজের এক শ্রেণির মহিলাদের যাতায়াতের খরচ কমবে, সেটা ঠিক। কিন্তু মহিলাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু বিনা ভাড়ায় যাতায়াত নারীর ক্ষমতায়নে সাহায্য করবে না।’’ তিনি আরও
বলছেন, ‘‘তার থেকেও বড় প্রশ্ন, নিখরচায় যাতায়াতের সময়ে ছেঁড়া জিন্স পরে মেয়েরা বাসে উঠতে পারবে? নাকি সেখানে অলিখিত ভাবে বিজেপি নির্দেশিত ভারতীয় সংস্কৃতির অনুসারী হতে হবে?’’ প্রসঙ্গত, সম্প্রতি মেয়েদের ছেঁড়া জিন্স পরা নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করে বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তীরথ সিংহ রাওয়ত।
তবে একে দলের মতবাদ বলে মানতে নারাজ বিজেপি নেতাদের একটা বড় অংশই। দলের মতবাদের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ খণ্ডন করে বিজেপি-র এক শীর্ষ নেতা জানাচ্ছেন, যাঁরা এই সব কথা বলছেন, তাঁরা নির্বাচনী ইস্তাহার মন দিয়ে পড়েননি। বা তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’-এর নেপথ্যে যে লিঙ্গবৈষম্য দূর করার মানসিকতা রয়েছে, সে সম্পর্কে অবহিত নন। ওই নেতার কথায়, ‘‘আমরা শুধু সরকারি বাসে মহিলাদের নিখরচায় যাতায়াতের কথা বলিনি। আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং কর্মক্ষেত্রেও মহিলাদের সমান সুযোগের কথা বলেছি।’’
বিজেপি নেতাদের একাংশ জানাচ্ছেন, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় কর্মরতা মহিলাদের বাড়ির কাজও করতে হয়। সন্তান বড় করার দায়ও তাঁদের উপরেই বর্তায়। ফলে এই সুবিধাটুকু অন্তত মহিলাদের রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রাপ্য। আর মহিলাদের পোশাক, আচরণের ক্ষেত্রে বিজেপি-র নীতি-পুলিশির যে অভিযোগ উঠছে, সে সম্পর্কে বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদারের বক্তব্য, বামফ্রন্ট আমলেও অনেক সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পোশাক নিয়ে কড়াকড়ি ছিল। কিন্তু সে সব টেকেনি। এখনও সমাজের একটি অংশে মহিলাদের অবদমিত করে রাখার প্রবণতা রয়েছে। তা
মুষ্টিমেয় কিছু বিজেপি নেতার মধ্যেও রয়েছে। কিন্তু সেটা পুরো দলের মতবাদ নয় বলে জানাচ্ছেন জয়প্রকাশবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও বাম নেতা রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে যখন কটু মন্তব্য করেন বা কোনও তৃণমূল নেতা কোনও মহিলা পার্ক স্ট্রিটে রাতে কী করছিলেন, এই প্রশ্ন তোলেন, তখন সেটা সংশ্লিষ্ট নেতা বা ব্যক্তির মানসিকতা বলে ধরা হয়েছে। তার সঙ্গে দলের মতবাদকে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না।’’
তবে নীতি-পুলিশগিরি কেউ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে, তার প্রতিবাদ হবে বলে জানাচ্ছেন নারী অধিকার-কর্মী তথা অর্থনীতির অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ। যদিও তিনি সমাজের সব স্তরের মহিলাদের বিনা ভাড়ায় যাতায়াতকে সমর্থন করছেন না। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক মাপকাঠি ছাড়া কোনও ধরনের সংরক্ষণই সমর্থনযোগ্য নয়। শাশ্বতীদেবীর কথায়, ‘‘সে কেজরীবালের সরকারের বিনা ভাড়ায় মহিলাদের যাতায়াত, তৃণমূল সরকারের সবুজ সাথী সাইকেল বা বিজেপি-র নির্বাচনী ইস্তাহারের ঘোষণা— যা-ই হোক না কেন।’’
‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’-এর তথ্য বলছে, ১৯৯৯-’০০ সালে যেখানে ভারতে কর্মরতা মহিলাদের হার ছিল ৩৪.১ শতাংশ, সেখানে ২০১১-’১২ সালে তা কমে হয় ২৭.২ শতাংশ। বর্তমানে যা আরও কমে
২০.৩১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এক অর্থনীতিবিদের কথায়, ‘‘ফলে এই পরিস্থিতিতে নিখরচায় যাতায়াতের সুবিধার থেকেও আরও বেশি সংখ্যক মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে সুযোগ পাওয়ার দিকটি সুনিশ্চিত করা দরকার। কারণ, লড়াইটা সমানাধিকারের হওয়া উচিত, নিখরচায় বাসে যাতায়াতের মতো জনমোহিনী ঘোষণার নয়!’’