—প্রতীকী ছবি।
সেফ ড্রাইভ সেভ লাইভ। আপ্তবাক্যের মতো সব সময়ে বলছেন মুখ্যমন্ত্রী, বলছে পুলিশ, প্রশাসন। বলছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাগানো বিশালাকার হোর্ডিংগুলো। পেট্রোল পাম্প বলছে হেলমেট ছাড়া মিলবে না পেট্রোল। মাঝেমধ্যেই পথ-সচেতনতায় মোড়ে মোড়ে হাজির থাকছে খুদে পড়ুয়ারা, পথচারীদের হাত ধরে বলছে ফুটপাথ ব্যবহার করুন। পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ উপলক্ষে বেরোচ্ছে রাস্তা জোড়া পদযাত্রা। সেখানে হাঁটছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও।
এ গেল মুদ্রার একটা পিঠ। অন্য পিঠ বলছে, শুধু অক্টোবর মাসেই এই শহরে বড় পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা অন্তত ১৯টি, যাতে মারা গিয়েছেন ২০ জন। আহত কমপক্ষে ১০। কলকাতা পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই হিসেবটুকুই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এ শহরে ‘পথ নিরাপত্তা’ শব্দবন্ধটিই যেন প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেপরোয়া গাড়ির দৌরাত্ম্যে পথে বেরোনোটাই যেন আতঙ্ক।
যে আতঙ্ক থেকে পার পাচ্ছেন না তুখোড় চালক থেকে নিরীহ পথচারী, এমনকী কর্তব্যরত সার্জেন্টরাও। গত বৃহস্পতিবারও একটি বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় হাসপাতালে গিয়েছেন হেস্টিংস থানা এলাকায় এজেসি বসু রোড এবং ডি এল খান রোডের সংযোগস্থলে কর্তব্যরত ট্র্যাফিক সার্জেন্ট বিশ্বজিৎ ঘোষ। ওই একই দিনে ব্রেবোর্ন রোড ও মেয়ো রোডের পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন আরও দু’জন। রবিবারই সাতসকালে মৃত্যুসংবাদ মিলেছে হেলমেটহীন স্কুটি-আরোহীর। তার দিন দুয়েক আগে মুকুন্দপুরের কাছে বেপরোয়া মোটরবাইকের ধাক্কায় আহত হয়েছেন পূর্ব যাদবপুর ট্র্যাফিক গার্ডের সার্জেন্ট অনীক পালের।
তবে সাম্প্রতিকতম দুর্ঘটনাগুলির সামগ্রিক পর্যালোচনা বলছে, এত দুর্ঘটনার কারণ যে শুধুই গাড়িচালকদের বেপরোয়া মনোভাব, তা হয়তো নয়। বেপরোয়া মনোভাবের পাশাপাশিই অভিযোগের আঙুল উঠছে গোটা পরিকাঠামোর দিকেও। তথ্য বলছে, এত বড় শহরের মাত্র পাঁচ শতাংশ রাস্তায় গাড়ি চলে। আর পরিবহণ দফতর জানিয়েছে, শহরের দু’টি প্রধান মোটর-ভেহিক্ল দফতর কসবা আর বেলতলা মিলিয়ে গত তিন বছরে নতুন দু’-চাকা ও চার-চাকা গাড়ির নথিভুক্তির সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ ৭৪ হাজার। এর পরে পুরনো গাড়ির নবীকরণ তো আছেই।
অর্থাৎ, শেষ তিন বছরে প্রায় লক্ষ দুয়েক গাড়ি বেড়েছে শহরে। কিন্তু রাস্তার পরিমাণ তো বাড়েনি এতটুকুও। ফলে রাস্তায় গাড়ির আধিক্য যে অস্বাভাবিক রকম বেড়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর এই আধিক্য বিপজ্জনক। সেই সঙ্গেই বেড়েছে ট্র্যাফিক-নৈরাজ্য। কুড়ি বছর ধরে শহরের রাস্তায় চার-চাকা চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে শম্ভু প্রসাদ বললেন, ‘‘রোজ সকালে গাড়ি বার করি এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে আর অন্য হাতে প্রাণটা ধরে। যত ক্ষণ না গাড়ি গ্যারাজে ঢোকাচ্ছি, তত ক্ষণ জীবনের নিশ্চয়তা থাকে না। চেনা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতেও এখন অস্বস্তি হয়, এত বেশি গাড়ির দাপটে। আমি না-হয় সব নিয়ম মানলাম, কিন্তু অন্য গাড়ির ভুলে প্রায়ই বিপদের মুখে পড়তে হয়।’’ তিনি জানালেন, এমন একটা দিন যায় না এখন, যে শহরের কোনও না কোনও প্রান্ত থেকে দুর্ঘটনার খবর কানে
আসে না।
শহরবাসী দেখছেন, সম্প্রতি আরও একটা বিষয় শহরে বাড়ছে হুড়মুড়িয়ে। এসইউভি ও স্পোর্টস কারের সংখ্যা। এবং শহরের ব্যস্ত রাস্তায় তারা যে প্রতাপ এবং দাপট নিয়ে চলে, যে গতিতে বাঁক নেয়, যেমন বেপরোয়া ভাবে ওভারটেক করে— তা রীতিমতো আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। এত দিন শহরের বাইরে লম্বা দূরত্বে চলার জন্যই সাধারণত বার করা হতো এই এসইউভিগুলিকে। কিন্তু খুব কম সময়েই সেই ধারণা বদলে গিয়েছে।
কিছু দিন আগেও যেখানে ফেরারি-র মতো রেসিং কার শহরে হাতে গোনা দেখা যেত কি না সন্দেহ, সেই গাড়িকেই রাত আটটা-ন’টার যানবহুল রাস্তায় অবলীলায় চলতে দেখা যায় এখন। তা-ও রীতিমতো চড়া গতিতে। যেন ভিড় রাস্তায় বড় গাড়ি চালানোর দক্ষতা মেপে নিচ্ছেন চালক। আর ভয়ে থরহরিকম্প হয়ে রয়েছে তার আশপাশের যানবাহন। রাতের শহরের চেহারাই যেন বদলে ফেলেছে এই গাড়িগুলির দাপট।
এমনটাই জানালেন ২৪/এ/১ রুটের একটি বাসের চালক। মুকুন্দপুর থেকে হাও়ড়াগামী এই বাসের চালক জানালেন, রাতের বাইপাস ভয়াবহ হয়ে ওঠে এখন। হেলমেটহীন বীরপুরুষদের সশব্দ বাইক অভিযান তো আছেই, সেই সঙ্গে তুমুল গতিতে চলা বড় চার চাকা গাড়ির বেপরোয়া মনোভাব। মাঝেমাঝেই এক চুলের জন্য দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।
সেই সঙ্গেই অবশ্য বারবার উঠে আসে পথচারীদের অসচেতনতার দিকটিও। প্রায়ই সিগন্যাল না-মেনে রাস্তা পেরোতে দেখা যায় তাঁদের। ফুটপাথের ব্যবহার করতেও অনীহা দেখান অনেকে। তবে এটাও ঠিক যে শহরের বহু গাড়ি-চলা রাস্তাতেই ফুটপাথ বিষয়টির অস্তিত্ব নেই। যেমন টালিগঞ্জ করুণাময়ী থেকে সিরিটি, সখেরবাজার হয়ে ডায়মন্ড হারবার রোডে পৌঁছনোর রাস্তাটি দিয়ে চারটি বড় বাস চলে। চলে অজস্র অটো। সঙ্গে গাড়ি আর মোটরবাইক তো আছেই। অথচ এই গোটা পথটা জুড়ে ফুটপাথের কোনও অস্তিত্ব নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ওসি র্যাঙ্কের ট্র্যাফিক কর্তা অবশ্য জানালেন, নানাবিধ কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে, বাড়ছে ঠিকই। তবে এ রাজ্যের পুলিশ যে ভাবে রোদ, জল, মানুষের গালাগালি খেয়ে কাজ করেন, তা অন্য কোনও রাজ্যে হয় না। এত সচেতনতার প্রচারও করে না অন্য রাজ্যের প্রশাসন। কিন্তু সব কিছুর আগে চালক এবং পথচারী হিসেবে সাধারণ মানুষ যদি নিজে সচেতন না হন, তবে কোনও কিছুই হবে না।
প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন রাস্তায় মোতায়েন থাকা ট্র্যাফিক পুলিশের একাংশ জানাচ্ছে, সারা শহরে এখন অটোমেটিক সিগন্যাল ব্যবস্থাই নিয়ন্ত্রণ করছে যান চলাচল। কিন্তু তা দিয়েই সবটা সামলানো যায় না বলে মত তাঁদের। পুলিশের নজরদারি একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোথাও কোথাও সিগন্যালের ভরসা। গা-ছাড়া মনোভাব দেখান অনেক পুলিশই। বর্তমানে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য মোটরবাইক, গাড়ির ক্ষেত্রে ২০০ টাকা, বাসের ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা এবং বড় মালবাহী ট্রাকের ক্ষেত্রে ২০০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এই টাকার পরিমাণটা বাড়ানো যেতে পারে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।
তবে কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বিনীত গোয়েল মনে করেন, জরিমানার টাকার পরিমাণের চেয়ে জরিমানার সংখ্যা বাড়ানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানালেন, উৎসব-পার্বণ ইত্যাদি কারণে অক্টোবর মাসে রাস্তায় গাড়ি ও পথচারী দু’টোই বেশি থাকে। সে জন্য হয়তো দুর্ঘটনাও কিছু বেশি ঘটে। তবে দুর্ঘটনা রুখতে অনেক নতুন নতুন পদক্ষেপ করা হচ্ছেন বলে জানালেন তিনি। বিশেষ কিছু দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় রাতের জন্য বিশেষ নজরদারি শুরু হয়েছে, কয়েকটি উড়ালপুল বন্ধ করা হয়েছে। স্কুলে স্কুলে নিরাপত্তা-প্রচার চলছে, চলছে চালকদের নিয়ে সচেতনতা শিবির। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘পথ দুর্ঘটনা রুখতে সর্বোত্তম চেষ্টা চালাচ্ছে কলকাতা পুলিশ। তবে রাতারাতি কোনও সমাধান হওয়ার নয়।’’