সম্মান: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তির উন্মোচন করলেন কানুপ্রিয়া। সঙ্গে তাঁর বাবা প্রভাত আগরওয়াল। শুক্রবার, এন আর এসে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
ঠিক ৪৩ বছর আগে দেশে ঘটেছিল এক নিঃশব্দ বিপ্লব!
যিনি সেই বিপ্লবের মূল কান্ডারি ছিলেন, আজও তাঁর ভাগ্যে তেমন ভাবে কোনও সরকারি স্বীকৃতি জোটেনি। বরং অপমান, লাঞ্ছনার জেরে এক সময়ে বেছে নিয়েছিলেন আত্মহননের পথ। মৃত্যুর ৪০ বছর পরে, এই প্রথম সেই চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আবক্ষ মূর্তি বসল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে। শুক্রবার সেই মূর্তির আবরণ উন্মোচন করলেন, সুভাষবাবুর হাত ধরেই জন্ম নেওয়া দেশের প্রথম নলজাতক শিশু দুর্গা তথা কানুপ্রিয়া আগরওয়াল।
৩ অক্টোবর জন্মদিনের ঠিক দু’দিন আগে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আপ্লুত মুম্বইয়ের বাসিন্দা কানুপ্রিয়া। বললেন, ‘‘আমি আজ গর্বিত। কিন্তু স্রষ্টা এমন এক জন, আজও যিনি যোগ্য সম্মান পাননি। আমাদের সকলকে সেই স্বীকৃতি আদায়ের লড়াইয়ে শামিল হতে হবে।’’ এন আর এস হাসপাতালের প্রাক্তনী সংগঠনের দাবি মেনে সেখানকার হস্টেল সুভাষবাবুর নামে করা, তাঁর মূর্তি বসানো এবং তিনি যে ঘরে থাকতেন তার দেওয়ালে ফলক লাগানোর ছাড়পত্র দেয় স্বাস্থ্য দফতর। প্রাক্তনী সংগঠনের সভাপতি, চিকিৎসক অভিজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘যে সময়ে সুভাষবাবুর কাছে আমরা পড়াশোনা করেছি, তখন ওঁর মর্ম বুঝিনি। যখন বুঝতে শুরু করলাম, তখন মনে হল, ওঁকে সম্মান জানানো আমাদের কর্তব্য।’’
১৯৬৭ থেকে ১৯৭৬— দীর্ঘ ন’বছর ধরে তিল তিল করে এন আর এসেই গবেষণাগার তৈরি করেছিলেন সুভাষবাবু। সর্বক্ষণ সেখানে যুগান্তকারী আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। কিন্তু এক অজানা কারণে ১৯৭৬ সালে তাঁকে বদলি করা হয় বাঁকুড়ায়। সুভাষবাবুর বহু অনুরোধ সত্ত্বেও তৎকালীন স্বাস্থ্যকর্তারা সেই নির্দেশ রদ করেননি। অগত্যা বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে যোগ দিলেও সপ্তাহান্তে কলকাতার বাড়িতে ফিরে হাসপাতালের ছোট পরীক্ষাগারেই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন সুভাষবাবু।
সেই যুগান্তকারী গবেষণারই ফল কানুপ্রিয়া। এ দিন তাঁর বাবা প্রভাতবাবু বলেন, ‘‘বিয়ের ১২ বছর পরেও সন্তান না হওয়ার যন্ত্রণা কুরে কুরে খেত। তখন সুভাষবাবু জানান, তিনি নতুন পদ্ধতিতে আমাদের উপরে একটি পরীক্ষা করতে চান। তাতে যে শিশু জন্মাবে, সে বিকলাঙ্গ হলেও হতে পারে। সে কথা শুনেও আমি এবং আমার স্ত্রী বেলা রাজি হয়ে যাই। কারণ, নিঃসন্তান থাকার চেয়ে অন্তত একটি সন্তানের বাবা-মা তো হতে পারব।’’ ১৯৭৪ সালে চিকিৎসক কৈলাস চৌধুরীর মাধ্যমে সুভাষবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল প্রভাতবাবু ও বেলাদেবীর। কিছু দিন চিকিৎসার পরেও অবশ্য বেলাদেবী গর্ভবতী হতে পারেননি। পরীক্ষা করে সুভাষবাবু দেখেছিলেন, বেলাদেবীর দু’টি ফ্যালোপিয়ান টিউবই অবরুদ্ধ। তখনই নিজের নতুন গবেষণা ‘টেস্ট টিউব বেবি’র পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ওই দম্পতির উপরে করতে চেয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু যে হেতু নতুন গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে সুভাষবাবু নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না, তাই বিষয়টি গোপন রাখতেই চেয়েছিলেন তিনি। আবার তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজকে কী বোঝাবেন, সে সম্পর্কে দিশাহারা হয়ে সুভাষবাবুকেও তাঁদের পরিচয় ও বিষয়টি গোপন রাখার আর্জি জানান প্রভাতবাবুরা।
আজ অবশ্য ওই বৃদ্ধও শামিল হতে চান সুভাষবাবুর স্বীকৃতি আদায়ের লড়াইয়ে। তাই এ দিন ভ্রূণ নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের সম্মেলনের সূচনা-অনুষ্ঠানে কানুপ্রিয়াকে নিয়ে হাজির ছিলেন প্রভাতবাবু।
রাজ্য কিংবা কেন্দ্রের তরফে সুভাষবাবুকে যাতে যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়, তার জন্য ইতিমধ্যেই লড়াই শুরু করেছেন বন্ধ্যত্ব রোগের চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীর। এ দিন জাতীয় গ্রন্থাগারে ওই সম্মেলনের পরে তিনি বলেন, ‘‘ভ্রূণ বিকলাঙ্গ হয়, ৯ মাস শুয়ে কাটাতে হয়, অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, প্রচুর খরচ এবং সাফল্যের হার খুব কম— নলজাতক শিশু নিয়ে এমন পাঁচটি কুসংস্কার এখনও রয়েছে। সেগুলি কাটানোই আমাদের মূল লক্ষ্য। সেটাও সুভাষবাবুর আবিষ্কারের প্রতি সম্মান জানানো হবে।’’
আর বেলাদেবী বলছেন, ‘‘বিয়ের এত বছর পরেও সন্তান না হওয়ায়, পরিচিত জনেদের থেকে কথা শুনতে হত। সেখানে সুভাষবাবু তো আমাদের ভগবান। মেয়ে জন্মানোর পরে বহু বার তিনি সস্ত্রীক আমাদের বাড়িতে এসেছেন। পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। এত বড় মনের মানুষকে কত কষ্ট নিয়ে চলে যেত হল, আজও ভাবতে পারি না।’’