ছটের দূষণ ১

কড়া নজরে ‘বাঁচল’ লেক, বর্জ্যে ভরা সুভাষ সরোবর

এক শহর, দুই সরোবর, দুই ছবি! শহরের দক্ষিণে রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজোর উপরে একাধিক নির্দেশিকা জারি করেছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৬ ০১:২৬
Share:

বিকেলেও আবর্জনায় ভরে রয়েছে সুভাষ সরোবর। — নিজস্ব চিত্র

এক শহর, দুই সরোবর, দুই ছবি!

Advertisement

শহরের দক্ষিণে রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজোর উপরে একাধিক নির্দেশিকা জারি করেছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। তার ফলে ছটপুজোর চেনা দূষণের ছবি অনেকটাই বদলে গিয়েছে এ বার। সোমবার সেখানকার জলে প্লাস্টিক বা ফুলমালা সে ভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়নি। সরোবর এলাকায় বাজি পোড়ানো বা পেল্লায় সাউন্ড বক্স (চলতি ভাষায় যাকে ডিস্ক জকি বা ডি জে বলে) বাজানোর অভিযোগ উঠলেও সেটা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম বলেই জানিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা।

শহরের উত্তরে সুভাষ সরোবরেও ছটপুজো হয়। সেখানে পরিবেশ আদালতের কোনও নির্দেশ ছিল না। এ দিন সেখানে জলে ফুলমালা ভাসতে দেখা গিয়েছে। এমনকী, প্রচুর প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগও জলে ফেলে রেখে গিয়েছেন পুজো দিতে আসা লোকজন। সেখানে ছটপুজোয় নাগা়ড়ে শব্দবাজি ফাটানো এবং ডি জে বাজানোর আওয়াজেও নাজেহাল হতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকার অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা বাসিন্দারা।

Advertisement

এ সব দেখে পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পরিবেশ আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়া প্রশাসন কি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে কখনও দূষণ ঠেকাতে পারবে না?

সত্যিই যে পারবেন না, তা ঠারেঠোরে মেনে নিয়েছেন রবীন্দ্র সরোবর এবং সুভাষ সরোবর, দুইয়ের মালিক কলকাতা উন্নয়ন সংস্থা (কেআইটি)-র কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, রবীন্দ্র সরোবরে পরিবেশ আদালতের নির্দেশ ছিল। তা দেখিয়ে পুজো দিতে আসা লোকজনকে দূষণ ছড়ানো থেকে নিরস্ত করা গিয়েছে। ‘‘আমরা নিজেরা নিয়ম বলবৎ করতে গেলে পুজো দিতে আসা লোকেরা অশান্তি জুড়ে দিতে পারেন,’’ মন্তব্য এক কেআইটি কর্তার। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, সরকার দূষণ রোধে বদ্ধপরিকর। তাই ছটপুজো মিটতেই সুভাষ সরোবর সাফ করার কাজ শুরু হয়েছে।

রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজোর সময়ে নানা ভাবে ছড়ানো দূষণ নিয়ে ফি বছরই অভিযোগ উঠত। প্রশাসন আমল না দেওয়ায় পরিবেশকর্মীরা তা নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হয়। নানা সওয়াল-জবাবের পরে পরিবেশ আদালতের বিচারপতি এস পি ওয়াংদি এবং বিশেষজ্ঞ-সদস্য পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ অনুমতি দিলেও এক গুচ্ছ নির্দেশিকা জারি করেছিল। পরিবেশ আদালত জানিয়েছিল, ছটপুজোর জন্য রবীন্দ্র সরোবের পাড় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। তার মধ্যেই পুজো সারতে হবে। লেক চত্বরে প্লাস্টিক, বাজি এবং মাইক ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বলে দেওয়া হয়, জলের বদলে পাড়েই নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে ফুলমালা ফেলতে হবে।

সোমবার সকালে রবীন্দ্র সরোবরে গিয়ে দেখা গেল, প্রতিটি গেটে পুলিশি প্রহরা রয়েছে। সেখানে হাজির হয়েছেন লেকের ভারপ্রাপ্ত কলকাতা উন্নয়ন সংস্থা (কেআইটি)-র কর্তারাও। লোকজনের হাতে বাজি দেখলেই বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়েও ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কাউকে। জলে জালের ঘেরাটোপে পুজো চলছে। ফুলপাতা ফেলা হচ্ছে পাড়ে রাখা নির্দিষ্ট ঘেরা জায়গাতেই। পুজো দিতে আসা লোকজনের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে বায়ো-টয়লেটেরও। পুলিশ জানিয়েছে, রবিবার বিকেল এবং সোমবার সকালে রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় চার কেজি বাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

ছটপুজোর পরে পরিষ্কার করা হচ্ছে রবীন্দ্র সরোবর।

পরিবেশকর্মীদের অনেকেরই অবশ্য বক্তব্য, রবিবার বিকেলের দিকে লেক এলাকায় শব্দবাজি ফেটেছে। কানে এসেছে ডি জে বাজানোর আওয়াজও। কিছু লোকজন লেকের জলে ফুলপাতাও ফেলেছেন। ভাসতে দেখা গিয়েছে কিছু প্লাস্টিকের ব্যাগও। এ সব কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্র সরোবরের নজরদারিতে কলকাতা হাইকোর্টের নিযুক্ত কমিটির সদস্য সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আদালতের সব নির্দেশ মানা হয়নি। এটা আদালতকে জানাব।’’

রবীন্দ্র সরোবরের মামলায় কেআইটি-র কৌঁসুলি পৌষালি বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, ‘‘আদালত যা যা করতে বলেছিল, সবই করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ২৯ নভেম্বর জাতীয় পরিবেশ আদালতে রিপোর্টও দাখিল করা হবে।’’ গোটা অনুষ্ঠানের ভিডিও রেকর্ডিং রয়েছে বলেও কেআইটি-র দাবি।

তবে কেআইটি এবং পুলিশের একাংশ এটাও মানছে যে, আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পরে হাতে সময় বেশি না থাকায় পুরো ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্র করে তোলা যায়নি। তার সুযোগ ছটপুজোয় আসা কেউ কেউ নিয়েছেন। কেআইটি-র এক কর্তা বলেন, ‘‘টালিগঞ্জের দিকে লেকের অরক্ষিত এলাকা থেকে কিছু লোক রবিবার ঢুকে পড়ে। সোমবার সেখানে রক্ষী ছিল।’’

পুরোপুরি সফল না হলেও আগের বারের থেকে শব্দের উৎপাত এবং দূষণ যে লেক এলাকায় কমেছে, তা দাবি করছেন পুলিশকর্তারাও। লালবাজারের এক পদস্থ অফিসারের মন্তব্য, ‘‘গত বার যা পরিস্থিতি ছিল, তার থেকে এ বছর দূষণ অনেকটাই কমাতে পেরেছি।’’ রবিবারের দূষণ নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা, পরিবেশ আদালতের নির্দেশ নিয়ে পুজো দিতে আসা লোকজনের অনেকেই সচেতন ছিলেন না। তাই কিছু গোলমাল হয়েছে। ‘‘সোমবার সকলেই নিয়ম মেনেছেন। লেকের বাইরেও কাউকে ডিজে বাজতে দেখলে, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে,’’ বলেন তিনি।

এ দিন পুজো পর্ব মেটার পরে থেকেই রবীন্দ্র সরোবর সাফ করতে নেমে পড়েছেন কলকাতা পুরসভার কর্মীরা। সকালে হাজির ছিলেন মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমারও। তিনি বলেন, ‘‘প্রতি বছরই আমরা তড়িঘড়ি রবীন্দ্র সরোবর সাফ করে দিই। এ বারও তার অন্যথা হবে না।’’

আর রবীন্দ্র সরোবরের সাফল্য দেখিয়ে কেআইটি-র দাবি, এই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ভবিষ্যতে সুভাষ সরোবরেও নিয়ম লাগু করা সম্ভব।

সত্যিই তেমনটা হবে কি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement