এ যেন রোগী এখন-তখন, ওষুধ ছ’মাসের পথ!
ইমার্জেন্সিতে গুরুতর অসুস্থ রোগী প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছেন। ফার্মাসিতে তাঁকে দেওয়ার মতো প্রাণদায়ী ইঞ্জেকশনও মজুত। অথচ রোগীকে সেই ইঞ্জেকশন না দিয়ে চিকিৎসকদের দৌড়তে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সিনিয়ারদের খুঁজে আনতে। কারণ, তিনি এসে সই না করা পর্যন্ত রোগীকে ওই ইঞ্জেকশন বা ওষুধ দেওয়া যাবে না। এই খোঁজাখুঁজিতে দেরির জেরে রোগীর অবস্থার যদি অবনতিও হয়, তা হলেও জুনিয়র ডাক্তারেরা অসহায়! সৌজন্য, দামি ওষুধের ব্যবহার নিয়ে হাসপাতালের জারি করা নতুন নিয়ম।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে সরকারি হাসপাতালে সমস্ত পরিষেবা ও সব ওষুধ ‘ফ্রি’ হওয়ার পরে রোগীকে ১০ হাজার টাকার বেশি দামি ওষুধ বা ইঞ্জেকশন দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের মতো করে বিভিন্ন ধরনের ‘রেশনিং’-ব্যবস্থা চালু করেছে কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজ। স্বাস্থ্যভবনের একাধিক কর্তাও ‘রেশনিং’–এর পক্ষেই সওয়াল করেছেন। স্বাস্থ্যভবনে ওষুধ সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক শীর্ষ কর্তার দাবি, এক শ্রেণির জুনিয়র ডাক্তার না-বুঝে বা ওষুধ সংস্থাকে তুষ্ট করতে লাখ-লাখ টাকা দামের এক-একটা ওষুধ যথেচ্ছ পরিমাণে লিখে দিচ্ছেন। এক শ্রেণির রোগী আবার হাসপাতাল থেকে নিখরচায় অতি দামি ওষুধ বা ইঞ্জেকশন নিয়ে বাইরে তা মোটা টাকায় বিক্রি করছেন বলে খবর মিলছে। তাই দামি ওষুধের ক্ষেত্রে ‘রেশনিং’ জরুরি বলে দাবি করছেন ওই স্বাস্থ্যকর্তা।
‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের ধুয়ো তুলে সরকারি অর্থের নয়ছয় বরদাস্ত করা যায় না। সরকারি ভাঁড়ার তো অফুরন্ত নয়। অতি-দামি ওষুধ এত কিনতে গেলে তো সকলের জন্য ওষুধ কেনা যাবে না। তাই একটু-আধটু রাশ টানতেই হবে,’’ মন্তব্য রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
অতএব, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে যেমন নিয়ম হয়েছে— কোনও প্রোফেসর, অ্যাসোসিয়েট বা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসরের লিখিত অনুমতি ছাড়া কোনও পিজিটি, হাউসস্টাফ বা ইনটার্ন দামি ওষুধ বা ইঞ্জেকশন রোগীকে দিতে পারবেন না। ওই ধরনের ওষুধ হাসপাতালে শুধু ইন্ডোর ফার্মাসিতেই থাকবে এবং রবিবার ও ছুটির দিন ওই ধরনের ওষুধের ব্যবহার যথাসম্ভব কমাতে হবে। কারণ, ওই দিনগুলোয় সাধারণত হাসপাতালে সিনিয়র চিকিৎসকদের দেখা পাওয়া যায় না।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও একেবারে নির্দেশ জারি করে দামি ওষুধের ‘রেশনিং’ শুরু হয়েছে মূলত আউটডোরের ক্ষেত্রে। সেখানে স্টোরের দায়িত্বে থাকা হাসপাতালের রেজিস্ট্রার কুন্তল বিশ্বাস ব্যাখ্যা দেন, ‘‘কম দামের ফার্স্ট লাইন ড্রাগ থাকা সত্ত্বেও অনেক জুনিয়র ডাক্তার প্রথমে সেটা না দিয়ে একেবারে থার্ড লাইন ড্রাগ দিয়ে বসছেন, যার দাম হয়তো ৩০-৪০ হাজার টাকা। তাই নিয়ম হয়েছে, কোনও সিনিয়র ভিজিটিং চিকিৎসককে দেখিয়ে আগে ওই ওষুধ প্রয়োগের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। তিনি সই করে অনুমতি দিলে তবেই আমরা অত্যন্ত দামি ওই ওষুধ দেব।’’ তিনি আরও জানান, আউটডোরে একটা রেজিস্ট্রি খাতা রাখা হয়েছে দামি ওষুধের ক্ষেত্রে। যাতে কোনও রোগী আগের কোর্স শেষ হওয়ার আগেই আউটডোরে এসে আবার ওই ওষুধ চাইলে তাঁকে ধরা যায়। কারণ, অনেকেই দামি ওষুধ বিনামূল্যে নিয়ে বাইরে বিক্রি করছেন বলে খবর।
উদ্দেশ্য খারাপ নয়, তা অনেকে স্বীকার করলেও, এই ‘রেশনিং’–এর ধাক্কায় অনেক ক্ষেত্রে রোগীর প্রাণ নিয়ে টানাটানি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। সেটা কী রকম?
যেমন, ৩১ জুলাইয়ের কথা। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ওই দিন দুপুরে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসেন কয়েক জন। কর্তব্যরত জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁকে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেন, ‘টেনেকটিপ্লেজ-৪০এমজি’ ইঞ্জেকশন দিতে হবে। হৃদ্রোগে প্রাণদায়ী এই ইঞ্জেকশনের একটির বাজারদর ২৫,৭০০টাকা।
এ দিকে, রবিবার বিভাগীয় কোনও সিনিয়র সেই সময়ে হাসপাতালে ছিলেন না বলে অভিযোগ। জুনিয়ার ডাক্তাররাই জানালেন, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না ইমার্জেন্সিতে ডিউটি-রত চিকিৎসকেরা। এক দিকে রোগীর প্রাণ, অন্য দিকে হাসপাতালের জারি করা নিয়ম। এই টানাপড়েনে ইঞ্জেকশন দিতে দেরি হওয়ায় রোগীর পরিজনদের সঙ্গে হাতাহাতির উপক্রম হয়। শেষ পর্যন্ত বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে ফোনে কথা বলে রোগীকে ওই ইঞ্জেকশন দিয়ে কোনও ক্রমে তাঁর প্রাণ বাঁচানো হয়।
ক্ষুব্ধ জুনিয়র ডাক্তারেরা এর পরে অজস্র প্রশ্ন সামনে এনেছেন। যেমন, সিনিয়ারেরা তো ওই সময়ে ইমার্জেন্সিতে থাকেন না। কোনও সিনিয়রকে যদি তখন ফোনে পাওয়া না যেত বা পেতে দেরি হতো, তা হলে কী হতো? যদি হাসপাতালের ইন্ডোরে ভর্তি কোনও রোগীর হঠাৎ ওই প্রাণদায়ী ইঞ্জেকশন দরকার হয়, তখন ওয়ার্ড থেকে ইমার্জেন্সি ফার্মাসিতে এসে কোনও সিনিয়র চিকিৎসককে ডেকে, সই করিয়ে ইঞ্জেকশন জোগাড় করে ফের ওয়ার্ডে ফিরে দিতে-দিতেই তো হৃদ্রোগে আক্রান্ত রোগী মারা যেতে পারেন। তখন কে দায়িত্ব নেবে? রবিবার, ছুটির দিন বা বিকেলের পরে বিশেষত রাতের দিকে ইমার্জেন্সি কেস এলে ওই ইঞ্জেকশন দেওয়ার ব্যাপারে সই করবেন কে? ওই দিনগুলিতে তো প্রায় কোনও সিনিয়রই হাসপাতালে থাকেন না।
এক পিজিটি-র কথায়, ‘‘আমরা ইমার্জেন্সিতে রোগী সামলাব, নাকি গোটা হাসপাতাল ছুটোছুটি করে সিনিয়ারদের খুঁজে এনে তাঁদের দিয়ে সই করিয়ে তার পরে ইঞ্জেকশন দেব? এটা কি সম্ভব? তার থেকে বরং চুপচাপ মরণাপন্ন রোগীকে রেফার করে দায় এড়ানো ভাল।’’ এ ব্যাপারে আরজিকর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ‘‘দামি ওষুধ অপ্রয়োজনে, যথেচ্ছ ব্যবহার করে ফেলছেন কিছু জুনিয়র ডাক্তার। সে ক্ষেত্রে এইটুকু ‘রেশনিং’ করতেই হবে। যদি সিনিয়রদের হাসপাতালে না-থাকা বা তাঁদের খুঁজে না-পাওয়াটা নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা হয়ে থাকে, তা হলে জুনিয়র ডাক্তারেরা আমাদের লিখিত অভিযোগ জানান। তখন ভাবা যাবে।’’ আর কার্ডিওলজির বিভাগীয় প্রধান কনক মিত্রের জবাব, ‘‘রবিবার বা ছুটির দিন আমরা সিনিয়ারেরা রোটেশনে হাসপাতালে থাকি। আর যদি না পাওয়া যায়, তা হলে টেলিফোনে অনুমতি নেওয়া যেতে পারে। আমরা পরের দিন এসে সই করে দেব।’’
তা হলে ‘রেশনিং’–এর নিয়মের ফলে তৈরি হওয়া সমস্যার প্রকৃত সমাধান কোথায়? একাধিক স্বাস্থ্যকর্তার মতে, অতি দামি ওষুধ বা ইঞ্জেকশনের ক্ষেত্রে উৎপাদক সংস্থাগুলি বাইরে অনেকটা ছাড় দেয়। রোগীরা এক বার তা কিনলে পরের বেশ কয়েকটা ডোজ বিনামূল্যেও দেওয়া হয়। সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে তারা যদি সরকারকেও দামি ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেয়, তা হলে সরকারের আর্থিক চাপ লাঘব হয়। আর সিনিয়র চিকিৎসকের অনুমতির বিষয়টি অনলাইনে কোনও নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট বা হোয়্যাট্সঅ্যাপ গ্রুপে করা যেতে পারে।