রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ব্যানারে ঢেকেছে সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তির রেলিংও। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে। —নিজস্ব চিত্র
কোথাও মন্ত্রীর ছবি দিয়ে নীচে লেখা, ‘মোদের আশা, মোদের ভাষা’। কোথাও সদ্য মন্ত্রিত্ব ছাড়া বিধায়কের নাম করে লেখা হয়েছে, ‘আমরা দাদার অনুগামী। মানুষের কাজে পদ লাগে না’! কিছু জায়গায় আবার আর এক মন্ত্রীর ছবি দিয়ে লেখা, ‘ছাত্র- যুব-র নয়নের মণি’ বা ‘আমরা দাদাপন্থী’!
বিধানসভা ভোট যতই এগিয়ে আসছে, ততই ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচার-ব্যানারে মুখ ঢাকছে শহর। পড়ছে পাল্টা ব্যানার-পোস্টারও। কিছু ব্যানারে রাজনৈতিক দলের ঘর গোছানোর ইঙ্গিত, কয়েকটিতে আবার শুধুই জল্পনা উস্কে দেওয়ার চেষ্টা। যার মধ্যে সাধারণ ভাবে বড় হয়ে উঠছে একটি প্রশ্ন। তা হল, সারা বছর এমনিতেই বিজ্ঞাপনী প্রচার-ব্যানারের দমবন্ধ পরিবেশে বহু ক্ষেত্রে শহরের আসল চেহারা দেখতে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ ওঠে। এ বারের নতুন ট্রেন্ড ‘দাদার কীর্তির’ প্রচার-ব্যানার শহরের চেহারাকে আরও দৃষ্টির অন্তরালে নিয়ে যাবে না তো? আরও বাড়াবে না তো দৃশ্যদূষণ?
ইতিমধ্যেই শ্যামবাজার চত্বরের অবস্থা সবচেয়ে করুণ হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। সেখানকার পাঁচ মাথা মোড়ে দাঁড়ালে এমনিতেই পুরনো কলকাতার উঁচু বাড়িগুলি দেখা যায় না। সে সব ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিজ্ঞাপনে। হোর্ডিংয়ের মুখ ঢেকে যাওয়ার ‘বিপদ’ এড়াতে ওই মোড়ের কাছে বড় গাছগুলিও অস্তিত্বের সঙ্কটে। এই প্রাক্-ভোট মরসুমে সেখানে সব চেয়ে বেশি চাহিদা সুভাষচন্দ্রের মূর্তি ঘিরে থাকা লোহার রেলিংয়ের। রাজনৈতিক দল তো বটেই, দাদার প্রচারের ব্যানারে সেই রেলিংয়ের প্রায় কোনও অংশই ফাঁকা নেই। এর পরে দখল নেওয়া শুরু হয়েছে ফুটপাত লাগোয়া বাতিস্তম্ভের। তৃতীয় স্থানে রয়েছে হাতিবাগান চার মাথার মোড়। পিছিয়ে নেই গড়িয়াহাট বা হাজরা মোড়ও। পরিস্থিতি এমন যে, কিছু জায়গায় দাঁড়িয়ে সিগন্যালও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। অতি সম্প্রতি আবার এ জে সি বসু রোড থেকে কার্ল মার্ক্স সরণি যাওয়ার পথে দাদার বিশাল ব্যানার পড়েছে উড়ালপুলের গা ঢেকেই!
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক মর্যাদা? তাতে কী এসে যায় প্রোমোটারদের!
আরও পড়ুন: সোমবার থেকে ফের বাড়ছে মেট্রো
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলছেন, “এ ভাবে ব্যানার-হোর্ডিং লাগানো আসলে সমাজকে অন্ধ করে রাখার চেষ্টা। কারও পারিপার্শ্বিক যদি কোনও কিছু দিয়ে ঢেকেই দেওয়া হয়, তা হলে তাঁর সেই পারিপার্শ্বিকের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি হবে কী করে?” অভিজিৎবাবুর আরও মন্তব্য, “শুধু দৃশ্যদূষণ নয়, এ আসলে দৃশ্যকে খুন করার শামিল। যা অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চলে আসছে।”মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব আবার বললেন, “উন্মুক্ততার অভাব মনের পরিসরকে ছোট করে। আমাদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে ফেলছে এই উন্মুক্ততার অভাব। যা যে কোনও বয়সের মানুষের কাজে প্রভাব ফেলতে পারে। গাছের মতো সুন্দর তো কোনও বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং হতে পারে না! ফলে প্রতিদিন যদি এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের বা এক নেতার সঙ্গে অন্য নেতার এই অসুন্দর রেষারেষি দেখতে হয়, তা মনকে বিষিয়ে দেবেই।”
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম মনে করেন, “যথেচ্ছ ব্যানার-হোর্ডিং লাগানো আটকাতে অবিলম্বে বিধি তৈরি করা দরকার।”তাঁর ব্যখ্যা, “আসলে মানুষের রুচি এবং বিধি মানার প্রবৃত্তি তৈরি করে তাঁর পারিপার্শ্বিক। ফলে কোনও অপরিচ্ছন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে সহজেই কিছু খেয়ে ঠোঙা ফেলে দেওয়ার কথা ভাবা যায়। সেটাই কোনও পরিচ্ছন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে করতে সঙ্কোচ হয়। যেখানে সেখানে হোর্ডিং-ব্যানার লাগিয়ে এমন এক পরিবেশে আমাদের থাকতে বাধ্য করা হয় যেখানে চাইলেও প্রকাশ্যে থুতু ফেলা বা যত্রতত্র শৌচকর্ম না করার শিক্ষা দেওয়া যায় না। আসলে যেমন বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলি, তেমনই দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনৈতিক দলগুলি।”
দীর্ঘদিন জনসংযোগ পেশার সঙ্গে যুক্ত অরিন্দম বসু অবশ্য মনে করেন, “প্রচারের ভাষা যথাযথ হলে মানুষ ব্যানার-হোর্ডিং দেখতে অপছন্দ করেন না। আসলে খেলা দেখে ম্যাচ রিপোর্ট পড়ার মতোই নিজের ধারণার সঙ্গে প্রচারের বক্তব্য মিলিয়ে নিতে চান তাঁরা। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, চোখ ঢেকে দিয়ে জোর করে প্রচারের বিষয় তুলে ধরলে মানুষ নেয় না। ফলে যা-ই করা হোক, উন্মুক্ত পরিসর রেখে না করলে মুশকিল।”