জোব চার্নকের ব্যবসাকেন্দ্র কোনও গাছতলা ছিল কি না, সে সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও, গাছতলায় হাট বসার পরম্পরার প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অবাক লাগলেও সত্যি, কলকাতার শেয়ার বাজারের শুরুটাও অনেকটা সেই রকম। আজ যেখানে এক বিখ্যাত ব্রিটিশ বহুজাতিক ব্যাঙ্কের কার্যালয়, ঊনবিংশ শতকের একটা বড় সময় জুড়ে ডালহৌসি চত্বরের সেই জায়গায় ছিল এক বিশাল নিমগাছ। তার তলাতেই বসত কলকাতার শেয়ার বাজার। উনিশ শতকের তিরিশের দশকে প্রকাশিত ইংরেজি খবরের কাগজে সরকারি ও বেসরকারি ঋণপত্রের বিজ্ঞাপন ছাড়াও ‘ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল’-এর মতো যৌথ মূলধনি সংস্থার শেয়ার কেনাবেচার খবর থেকে বোঝা যায় শহরে এই ব্যবসার বয়স। ১৯০৮ সালে গড়ে ওঠে ‘ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন’। আদি গাছতলা থেকে কয়েক জায়গা ঘুরে সংস্থা থিতু হয় ৭ লায়ন্স রেঞ্জ ঠিকানায়। ১৯২৮ সালে বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্যর স্ট্যানলি জ্যাকসন নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেন (ছবিতে ১৯৪৫ সালে ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনের দৃশ্য, উইকিমিডিয়া কমনস থেকে)।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শেয়ার বাজারে নিয়ে এসেছিল বিশাল লগ্নির ঢেউ। বেড়েছিল কাজের সামাজিক সম্মানও। পরের দশকগুলিতে স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কৃতবিদ্য মানুষেরা। সংস্থার প্রথম ভারতীয় প্রেসিডেন্ট কেদারনাথ খান্ডেলওয়াল বিএ এলএলবি পাশ করে স্টক ব্রোকার হয়েছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, সরকারি কলেজের রসায়নের অধ্যাপনা ছেড়ে এই পেশায় এসেছিলেন জিতেন্দ্রমোহন দত্ত। তিনি পরে এক্সচেঞ্জ-এর প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এমন আর এক জন মানুষ ছিলেন— কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগে অধ্যাপনার পাশাপাশি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে রসায়নের শিক্ষক এম এন রায়। স্টক এক্সচেঞ্জে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন অর্থনীতি নৃতত্ত্ব ও ইতিহাসের বিশিষ্ট পণ্ডিত অতুল সুর। ১৯৩৬ সালে কাজে যোগ দেওয়ার পর, তিনি প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জের একটি ইতিহাস লেখেন। সেটাই সংস্থার ইয়ারবুকের শুরুতে সংযুক্ত হয়।
অতুল সুরের স্মৃতিকথা শতাব্দীর প্রতিধ্বনি-তে মেলে তখনকার শেয়ার বাজারের গল্প। যেমন, বিয়ের যৌতুক হিসেবে পাওয়া বেঙ্গল কোল কোম্পানির ৫০০ শেয়ার মূলধন করে শুরু হয় আজকের এক নামী শিল্পোদ্যোগী পরিবারের আর্থিক সমৃদ্ধি। বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাজারে দুই ভাইয়ের শেয়ার কেনাবেচার লড়াইয়ে দিনের শেষে এক জনের ৯৪ লক্ষ টাকা লোকসানের ঘটনা। সে সময়ের পরিচালন ব্যবস্থার ছবি পাওয়া যায় মি. ক্লারিজ নামে এক অফিস পরিচালকের গল্পে, যিনি রোজ শৌচালয়ের পরিচ্ছন্নতা পরখ করতেন প্যানের উপর সাদা রুমাল ঘষে! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের বহু সংস্থার কলকাতার থেকে ঝাঁপ গোটানোর মতোই, কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ ঘিরেও ঘনিয়েছে অনিশ্চয়তার মেঘ, কিছু দিন ধরে। তবু এ শহর আশাবাদী— দেশের অন্যতম প্রাচীন এই স্টক এক্সচেঞ্জের গৌরব-ইতিহাস অটুট থাকবে।
আজও প্রাসঙ্গিক
“আমাদের অধিকাংশ চলচ্চিত্র একবার দেখে অথবা না দেখেই ফেলে দেওয়ার যোগ্য।” লিখেছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত (ছবি)। ভারত ও বাংলার ছবির হালহদিসের অকপট সমালোচক, ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, আজ পাল্টে যাওয়া সময়েও তাঁর ভাবনাগুলি প্রাসঙ্গিক। তাঁর স্মরণে ‘চিদানন্দ দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ ও ‘সংস্কৃতি সাগর’ গত ১৮ নভেম্বর জি ডি বিড়লা সভাগারে আয়োজন করেছিল তৃতীয় বছরের চিদানন্দ দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতা। ‘ইন্ডিয়া ফ্রম মিডনাইট টু মিলেনিয়াম’ নিয়ে বললেন শশী তারুর, ধর্ম ভাষা জাতির বিদ্বেষ মুছে আশাভরা ভারতের কথা। চিদানন্দ ও সুপ্রিয়া দাশগুপ্ত সম্মাননায় ভূষিত হলেন রোচনা মজুমদার ও সঞ্জয় পট্টনায়েক। প্রকাশ পেল দু’টি বইও: চিদানন্দের ইংরেজি অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের সাতটি কবিতার সঙ্কলন টেকঅফস অন টেগোর ও নবরূপে সুপ্রিয়া দাশগুপ্তের গল্পগ্রন্থ দিবাসুন্দরী ও অন্যান্য সুন্দরীরা (প্রকা: থিমা)।
স্মরণে মননে
মার্ক্সীয় ঘরানার বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ (১৯১৭-২০১১) আরও এক বার উঠে এলেন চর্চায়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির শিক্ষা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, স্বাধীনচেতা এই বুদ্ধিজীবীর বিভিন্ন লেখাপত্র ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পত্রপত্রিকায়— যার অধিকাংশই হয়তো এখন দুষ্প্রাপ্য। এই সব মননশীল প্রবন্ধ-নিবন্ধ থেকেই নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়ে একটি সঙ্কলনগ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন ভানুদেব দত্ত ও শোভনলাল দত্তগুপ্ত, সেরিবান প্রকাশনার উদ্যোগে। বইটির নাম নরহরি কবিরাজ: অতলান্ত জিজ্ঞাসা, আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হল গতকাল ২৪ নভেম্বর অপরাহ্নে, কলেজ স্কোয়ারে মহাবোধি সোসাইটি সভাগৃহে। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই-এর রাজ্য নেতৃবর্গ, বইটি নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করলেন দুই গ্রন্থসম্পাদক এবং সুদীপ্ত কবিরাজ।
কবির জন্য
‘শিশিরভেজা শুকনো খড় শিকড়বাকড় টানছে...’ শীত-শুরুর শহর মনে করায়, এসে গেছে ‘শীতের জাতক’ কবির জন্মদিন। আজ ২৫ নভেম্বর নব্বই পূর্ণ করছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। একগুচ্ছ অনুষ্ঠান— আবৃত্তিলোক কলকাতা ও প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশনের আয়োজনে মিনার্ভা থিয়েটারে বিকেল সাড়ে ৫টায় কবিকে নিয়ে প্রদর্শনী, বইপ্রকাশ: গুণিজনের উপস্থিতিতে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির উদ্যোগে আকাদেমি সভাঘরে সন্ধ্যা ৬টায় আলোচনা ও কবির কবিতাপাঠ, সভামুখ্য ব্রাত্য বসু। আর গীতাঞ্জলি মেট্রোর কাছে, ১৬ সোনালি পার্কে ‘কবিতা স্টুডিয়ো’য় বিকেল ৫টায় খুলে যাবে কবিতা-বইয়ের এক গ্রন্থাগার, নামটি তার শক্তিময়— ‘আনন্দভৈরবী’!
নিরীক্ষার ছবি
উৎসবের মরসুমের বাজনা বেজে চলেছে নাগাড়ে: শহর জুড়ে নাটক, চলচ্চিত্র, শিল্পের উৎসব। তারই সুরটি কণ্ঠে তুলে নিয়েছে ‘ইমামি আর্ট’, দ্বিতীয় বছরের ‘এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-কে সামনে এনে। নামেই স্পষ্ট, ছবির ফর্ম ও ইমেজে, ভাবে ও ভাষায় নিরন্তর নিরীক্ষায় বিশ্বাসী যে ছবিকরিয়েরা, তাঁদের কাজ তুলে ধরতেই এই আয়োজন। ইমামি আর্ট ভবনের পাঁচতলায় শুরু হয়েছে গত ২২ নভেম্বর, চলবে আগামী ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত। পাঁচ দিনে দেখা যাবে মোট ৫৬টি নিরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র। প্রতিযোগিতা বিভাগে ২২টি, বিশেষ ভাবে কিউরেট করা ৩৩টি ছবি দেখার সুযোগ ছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মাস্টারক্লাস, ছবি নিয়ে আলোচনা, বিশেষ প্রদর্শনে আসতে পারেন চলচ্চিত্রপ্রেমী যে কেউ। ইমামি আর্ট-এর ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে সময়সূচি ও বিশদ তথ্য।
সায়ক ৫০
১৯৭৩ সালে এগারো জন নাট্যপ্রাণ তরুণ শুরু করেছিল ছোট্ট এক নাট্যদল। পায়ে পায়ে সে পেরিয়ে এসেছে পাঁচটি দশক, ২৮টি পূর্ণাঙ্গ ও ন’টি স্বল্পদৈর্ঘ্য নাটকের তিন হাজারেরও অভিনয় করেছে দেশে বিদেশে, নাট্যপ্রযোজনার পাশাপাশি জেগে থেকেছে সমসময়ের প্রয়োজনে, নাট্য-কলাকুশলীদের বিপন্নতায়ও। ২ ডিসেম্বর পঞ্চাশ পূর্ণ করবে ‘সায়ক’, কর্ণধার মেঘনাদ ভট্টাচার্যের সুযোগ্য দিগ্দর্শনে। সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে দারুণ উদ্যাপন: নভেম্বর থেকে আগামী মার্চ পর্যন্ত পাঁচটি নাট্যোৎসব হবে কলকাতা বাঁকুড়া হরিপাল নৈহাটি ও কোচবিহারে। প্রথম পর্ব আগামী ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর, অ্যাকাডেমি মঞ্চে পাঁচ দিনে সাতটি নাটক— দিনদুপুরে সল্টলেকে, শের আফগান, মারীচ সংবাদ, সখারাম বাইন্ডার, দায়বদ্ধ, হ্যামলেট ও ভূত।
চিনেপাড়ার কথা
কলকাতার চিনেপাড়া বলতেই একটা গতে-বাঁধা ছবি ফুটে ওঠে আমাদের চোখে। কিন্তু সেখানকার মানুষদের দৈনন্দিন জীবন কাছ থেকে দেখার এবং বোঝার সময় বা সুযোগ সবার হয় না। তাই সাউথ ট্যাংরা রোড বা ব্ল্যাকবার্ন লেনের বাসিন্দাদের জীবনসংগ্রামের গল্প থেকে যায় অগোচরে। এ পাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ওঠাবসার ফলে এই অপরিচয়ের অন্ধকার খানিকটা সরাতে পারেন কেউ কেউ। নিরন্তর যাতায়াতে তাঁদের চোখেই ধরা দেয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ পাড়ার বদলও। আলোকচিত্রী, তথ্যচিত্র নির্মাতা বিজয় চৌধুরীর সুযোগ হয়েছে গত দুই দশক ধরে কলকাতার চিনা সম্প্রদায় ও তাঁদের জীবন নিজের কাজের মাধ্যমে তুলে ধরার (ছবি)। বইও লিখেছেন সম্প্রতি, কলকাতার চিনেপাড়া (প্রকা: লা স্ত্রাদা)। কলকাতার বহুস্তরী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ এই চিনেপাড়া ও মানুষদের দেখার অভিজ্ঞতাই তুলে ধরবেন তিনি আগামী ৩০ নভেম্বর সন্ধে ৬টায় অবনীন্দ্র সভাগৃহে, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক নিশীথরঞ্জন রায় প্রতিষ্ঠিত ‘সোসাইটি ফর প্রিজ়ার্ভেশন, ক্যালকাটা’র উদ্যোগে।
তিনশো বছরে
অর্থনৈতিক দর্শনের পুরোধাপুরুষ তিনি। মুক্তবাজার, শ্রমতত্ত্ব নিয়ে কোনও আলোচনাই অ্যাডাম স্মিথকে (ছবি উইকিমিডিয়া কমনস থেকে) না ছুঁয়ে এগোতে পারে না; দ্য ওয়েলথ অব নেশনস অর্থনীতি-বিজ্ঞানে আদিগ্রন্থের সম্মান পায় আজও। শুধু অর্থনীতি নয়, নৈতিক আবেগ, বিচারব্যবস্থা, জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েও গভীর ভাবে ভেবেছিলেন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবাদপ্রতিম এই অধ্যাপক। যদিও প্রয়াণের আগে নষ্ট হয়েছিল অধিকাংশ পাণ্ডুলিপি, তবু জানা যায়, ভাষা নিয়েও নিবিড় ভাবনায় মগ্ন ছিলেন তিনি। এ বছরই পূর্ণ হল অ্যাডাম স্মিথের জন্মের তিনশো বছর। তা মনে রেখে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির উদ্যোগে আগামী কাল ২৬ নভেম্বর বিকাল ৫টায় আকাদেমি সভাঘরে অ্যাডাম স্মিথের ভাষা-ভাবনা নিয়ে বলবেন অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য। উপলক্ষটি বেশ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে তাঁরই নামাঙ্কিত স্মারক বক্তৃতা। ভাষাই সেতু বাঁধবে প্রতীচ্য-প্রাচ্যের দুই আচার্যের।
সহজ সুরে
সংস্কৃতি মন্ত্রক, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র ও সহজিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘গুরু শিষ্য পরম্পরা’ প্রকল্পে শ্রীখোল প্রশিক্ষক ছিলেন তিলক মহারাজ, সঙ্গত করেছেন পণ্ডিত রবিশংকর পূর্ণদাস বাউল গোষ্ঠগোপাল দাস গৌর ক্ষ্যাপার সঙ্গে। তিনিই আবার শ্মশানবাসী সাধক, বর্ধমানে গ্রামীণ শ্মশানপ্রান্তে কালীমন্দির সংলগ্ন আশ্রমবাসী, মাতৃপূজক। এপ্রিলে প্রয়াত এই সাধক শিল্পীর স্মরণেই নিবেদিত হল একাদশ ‘সহজিয়া উৎসব’, দেব চৌধুরীর সপ্রাণ উদ্যোগে। রবীন্দ্রসদনে গত ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যা মেদুর হল দেবদাস বাউল মনসুর ফকির উমারাণী দাস গৌতম দাস বাউল স্বপন বসু তন্ময় বসু-সহ প্রবীণ-নবীন শিল্পী ও ‘সহজ সুরের পাঠশালা’-র গানে। সম্মানিত হলেন শ্রীখোল ও গিটারের গুরু গোপাল বর্মণ ও টুটুল গঙ্গোপাধ্যায়।